সবার দৃষ্টি উচ্চ আদালতে — খালেদা জিয়ার জামিন আদেশ আজ

ক্রাইমবার্তা ডেস্করিপোর্ট:     জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে হাইকোর্টের দেয়া জামিন বহাল থাকবে কিনা জানা যাবে আজ (সোমবার)। খালেদা জিয়াকে হাইকোর্টের দেয়া জামিনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের লিভ টু আপিলের শুনানি শেষে আদেশের জন্য এ দিন ধার্য করেছেন আপিল বিভাগ। প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বাধীন চার বিচারপতির বেঞ্চ আদেশের দিবেন আজ। সুিপ্রম কোর্টের ওয়েবসাইটের প্রকাশিত আজকের কার্যতালিকায় বিষয়টি ২ ও ৩ নম্বরে রয়েছে। এদিকে খালেদা জিয়ার জামিন হবে কিনা তা জানতে সবারই এখন দৃষ্টি থাকছে উচ্চ আদালতের দিকেই। কারণ সাবেক এই্ প্রধানমন্ত্রীর কারামুক্তির পথ এখন আপিলের রায়ের উপর নির্ভর করছে। তার জামিন নিয়ে আইন অঙ্গণ থেকে শুরু করে সরকারের উচ্চ মহল ও বিরোধী দলীয় জোটেও চলছে নানা পর্যালোচনা। খালেদা জিয়াকে হাইকোর্টের দেয়া জামিন আপিলে বহাল থাকবে বলে প্রত্যাশা করছেন বিএনপি আইনজীবীরা। আর রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা বলেছেন, খালেদা জিয়াকে জামিন দেয়া ঠিক হবে না।
গত ১৪ মার্চ আপিল বিভাগ খালেদা জিয়াকে হাইকোর্টের দেয়া জামিন ১৮ মার্চ পর্যন্ত স্থগিত করেন। একই সঙ্গে রাষ্ট্রপক্ষকে লিভ টু আপিল করতে বলেন উচ্চ আদালত। ওই দিনই খালেদা জিয়ার জামিন স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার চেয়ে আবেদন করেন খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা। গতকাল রোববার রাষ্ট্রপক্ষ, দুদক এবং খালেদা জিয়ার আবেদন শুনান্ িজন্য আপিল বিভাগের কার্যতালিকায় ৯ ও ১০ নম্বরে ছিল। সকাল ৯টা ৪০ মিনিটের দিকে শুনানি হয়। প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বে চার বিচারপতির বেঞ্চ রাষ্ট্রপক্ষের আবেদন শুনানি শেষে আদেশের জন্য এ দিন ধার্য করেছেন। বেঞ্চের অন্য বিচারপতিরা হলেন, বিচারপতি মো. ইমান আলী, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী ও বিচারপতি মির্জা হোসাইন হায়দার।
আদালতে খালেদা জিয়ার পক্ষে উপস্থিত ছিলেন ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার, অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন, এ জে মোহাম্মদ আলী, অ্যাডভোকেট আব্দুর রেজাক খান, জয়নুল আবেদীন, ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন, বদরোদ্দোজা বাদল, কায়সার কামাল, এ একে এম এহসানুর রহমান প্রমুখ। এছাড়াও কয়েকজন বিএনপি নেতাকেও আদালতে দেখা যায়। রাষ্ট্রপক্ষে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম, অতিরিক্ত অ্যার্টনি জেনারেল মমতাজ উদ্দিন ফকির। দুদকের পক্ষে খুরশিদ আলম খান। এছাড়াও আওয়ামী ও বিএনপি সর্মথিত সিনিয়র, জুনিয়র আইনজীবীরা। জামিন আবেদন সংবাদ সংগ্রহ করার জন্য সকাল থেকেই আদালত প্রাঙ্গণে ও বিভিন্ন গণম্যাধ্যমের কর্মরত সাংবাদিকদের উপস্থিত হতে থাকেন। এছাড়াও সরকারি বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার ছিলেন সদস্যদের উপস্থিতি দেখা যায়। এদিকে হাইকোর্ট এলাকায় প্রতিটি প্রবেশ গেটে সর্তক অবস্থায় দায়িত্ব পালন করতে দেখা যায় আইন শৃংখলা বাহিনীর সদস্যরা। আদালতে প্রবেশ করতে পুলিশ হরয়ানি করছেন বলে অভিযোগ করেনে আইনজীবীরা। এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে তারা বলেন, সাদা পোশাসধারীরা সহজের প্রবেশ করছেন অথচ আমরা এখানে প্র্যাকটিস করি আমাদেরকে পরিচয়পত্র প্রদর্শণ করলেও নানাভাবে হরয়ানি করছে। তারা বলেন, আইনজীবী, ক্লার্ক ও মোয়াক্কেলদের পুলিশ ভিতরে ঢুকতে দিচ্ছে না। আবার ঘণ্টার পর ঘণ্টার দাঁড়িয়ে থাকার পর কিছু আইনজীবীকে ঢুকতে দিলেও পুলিশের অযথা হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে।
শুনানিতে যা হল:
শুনারি শুরুতে দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান বলেন, হাইকোর্টে চারটি যুক্তিতে খালেদা জিয়াকে হাইকোর্ট জামিন দিয়েছেন। তিনি বলেন, একটি মাদক দ্রব্য মামলায় দুই বছরের সাজা হয়েছিল একজনের। বিচারপতি শাহাবুদ্দীন আহমেদ জামিন দেন নাই। হাইকোর্টে আমরা এই যুক্তি দেখিয়েছিলাম। হাইকোর্ট গ্রহণ না করে সাংঘর্ষিক আদেশ দিয়েছেন। বিচারিক আদালত তাকে দন্ডবিধির ৪০৯, ১০৯ ধারায় তাকে পাঁচ বছরের সাজা দিয়েছেন। ১৯৪৭ সালের দূর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫ এর (২) ধারায় দূর্নীতির অপরাধ প্রমাণ হওয়ায়ও আদালত তাকে সাজা দেয়নি। এসময় খুরশীদ আলম খান বলেন, তিনি একই সুবিধা দুইবার পেতে পারেননা। তিনি বলেন, তিনি বয়স্ক মহিলা এবং শারিরিকভাবে অসুস্থ একারণে বিচারিক আদালত দশ বছরের সাজা না দিয়ে পাঁচ বছরের সাজা দেয়া সমুচিন মনে করেছেন।
এসময় আদালত চানতে চান, এটি কি বিচারিক আদালত গ্রহণ করেছেন, জবাবে খুরশীদ আলম খান বলেন হ্যা গ্রহণ করেছেন। এসময় আদালত বলেন, পাঁচ বছরের সাজা দেয়ায় উনার শারিরিক অবস্থা কি ভাল হয়ে গেছে? জবাবে খুরশীদ আলম খান বলেন, এ মামলায় রায়ের আগে ও পরে দুই মাস ২৫ দিন যাবত কারাগারে আছেন। হাইকোর্টে উনাকে চার মাসের জামিন দিয়েছেন। পেপারবুক প্রস্তুুত হলে শুনানি হোক । সে পর্যন্ত তিনি (খালেদা জিয়া) জেলে থাকুক। আপিল নিষ্পত্তি হলে তিনি আবার জামিন আবেদন চাইতে পারবেন।
তখন আদালত বলেন, এই উপমহাদেশে জয়ললিতা, লালুপ্রসাদ যাদব কতদিন কারাগারে ছিলেন? জবাবে খুরশীদ আলম খান বলেন, জয়ললিতার দুর্নীতি মামলায় বিচারিক আদালত তাকে দোষী সাব্যস্থ করেছে। সুপ্রিম কোর্টেও এ রায় বহাল ছিল। তার সহযোগী শশীকলা এবং অন্য আরেকটি মামলায় লালু প্রসাদ যাদব এখনো কারাগারে আছেন। কাজেই দুই মাস ২৫ দিনের মধ্যে জামিন পাবেন এট ঠিক হবে না।
এসময় অ্যাটির্নি জেনারেল বলেন, আমি সারসংক্ষেপ বলতে চাই। তবে খালেদা জিয়ার আইনজীবী এজে মোহাম্মদ আলী এতে আপত্তি তোলে বলেন, এখনতো আপিলের শুনানি হচ্ছে না। মামলার সারবত্তায় (মেরিট) যাওয়ার দরকার কি? এই পর্যায়ে প্রধান বিচারপতি বলেন, আমরা মামলাটি একটু ভাল করে শুনি। আপনারাই বলেছেন, আমরা গতদিন শুনিনাই। আমরা আপনাদের কথা পরে শুনবো। অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, এটা হলো একটা সারসংক্ষেপ। বিচারিক আদালতের রায়ে একজন সাক্ষীর মাধ্যমে প্রমাণ হয়েছে, এতিমখানার টাকা উত্তোলনে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে খালেদা জিয়ার অনুমোদন ছিল। এরমধ্যে তারেক রহমান ও তার ভাগ্নে চারলাখ টাকা তুলে নিয়েছে। তারা কিভাবে এ টাকা তুলে নিলো? এসময় আদালত বলেন, এটাকি ব্যক্তি নামে ছিল। অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, হ্যা ব্যক্তি নামে ছিল। আদালত জানতে চান, মামলাটি কখন হয়েছিল? জবাবে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ২০০৯ সালে হয়। এসময় অ্যাটর্নি জেনারেল মামলার ধারাবাহিক ঘটনার বর্ণনা দিয়ে বলেন, খালেদা জিয়া বিভিন্ন অজুহাতে সময়ক্ষেপণ করেছেন। তিনি জামিনের অপব্যবহারও করেছেন। তিনি কোর্টকে পাত্তাই দিচ্ছেন না। তিনি মিসকনডাক্ট করেছেন।
খালেদা জিয়ার জামিনের বিরোধিতা করে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, রাষ্ট্রীয় অর্থ আত্মসাৎ হবে, আর তার সঙ্গে জড়িত থাকবেন রাষ্ট্রে প্রধান ব্যক্তি, তিনি কোনো অনুকম্পা পেতে পারেন না। যখন বিচারিক আদালতে বিচার চলছিল, তখনকার অবস্থা আর এখনকার অবস্থা এক নয়। এখন খালেদা জিয়া একজন দন্ডিত আসামি। তাঁর বয়স ও অসুস্থতা বিচারিক আদালত আগে বিবেচনা করে ১০ বছরের জায়গায় পাঁচ বছর সাজা দিয়েছেন। তাঁর সাজা খাটা শেষ হয়ে যাবে আর তার আপিল শুনানি শেষ হবে না এমন তো কখনো হয়নি। এটা অ্যাবসার্ড। অবশ্যই শুনানি হবে।
এরপর খালেদা জিয়ার আইনজীবী এজে মোহাম্মদ আলী বলেন, আপিল বিচারাধীন থাকাবস্থায় হাইকোর্ট জামিন দিতে পারে নাও দিতে পারে। তবে জামিন দেয়াটাই স্বাভাবিক। তার বক্তব্য চলাকালে আদালত বিরতিতে যান। বেলা সাড়ে এগারোটায় শুনানি শুরুতেই এজে মোহাম্মদ আলী বলেন, ৪২৬ ধারায় মামলার সারবত্তা যাচাই করে হাইকোর্টের জন্য বাধ্যতামুলক নয়। হাইকোর্টে আবেদন আসবে তারা এটা পুরোটাই দেখবে। তারপর তারা জামিন দিবে কি দিবেনা সিদ্ধান্ত জানাবেন। আপিল বিভাগ হস্তক্ষেপ করে না, যতক্ষণ পর্যন্ত এখানে বিচারের বিচ্যুতি না ঘটে।
এসময় আপিল বিভাগের বিচারপতি মো. বিচারপতি ইমান আলী জানতে চান, বিচারিক আদালত দন্ড দিলে হাইকোর্টকি দন্ড দিতে পারে? জবাবে এজে মোহাম্মদ আলী বলেন, অনেক মামলায় হাইকোর্ট জামিন দিয়েছেন। শুধু আপিল বিভাগ এটাতে হস্তক্ষেপ করেন নাই। এজে মোহাম্মদ আলী বলেন, উনি (অ্যাটর্নি জেনারেল) অনেক বড় গল্প বললেন। আমি এটার জবাব দেয়া সমোচিন মনে করি না। মামলাটি আদালতের স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় চলুক। আমি মনে করি হাইকোর্টে জামিনের সিদ্ধান্ত সঠিক।
এরপর খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, এটা খালেদা জিয়ার মামলা তাই এ মামলার গুরুত্ব অনেক। তিনি না হলে আমরাও আসতাম না সরকারও এতা উৎসাহি হতো না। হাইকোর্টের ক্ষমতা আছে জামিন দেয়ার। এরপর দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান পাকিস্তানের পারভেজ মোশারফ, জিম্বাবুয়ের রবার্ট মুগাবের মামলার নজির তুলে ধরেন। এরপর আদালত আদেশের জন্য সোমবার দিন ধায করেন। এ সময় অ্যাটর্নি জেনারেল দাঁড়িয়ে বলতে থাকেন, গত পরশু একটি রায়ে এতিমখানার জায়াগায় নির্মিত ১৮তলা ভবন এতিমখানাকে বুঝিয়ে দিতে বলেছেন। অতএব এ মামলাতেও এতিমদের টাকা উধাও হয়েছে। এ সময় খালেদার অপর আইনজীবী মাহবুব উদ্দিন খোকন অ্যাটর্নি জেনারেলকে উদ্দেশ্য করে বলেন, শেখ হাসিনার মামলায় সরকার বা দুদককে এভাবে আসতে দেখিনি। যতটানা এ মামলায় দেখেছি।
আসামী ও রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীদের বক্তব্য:
অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেছেন, আমরা আদালতে বলেছি, হাইকোর্ট যে যুক্তিতে খালেদা জিয়াকে জামিন দিয়েছেন সেটা সঠিক হয়নি। রাষ্ট্র ক্ষমতায় থেকে যারা দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত হন আদালত কঠোরভাবে তার বিচার করেন। যেখানে এতিমদের অর্থ আত্মসাৎ হয়ে যাবে সেখানে জামিন দেয়া সঠিক হবে না। তবে খালেদা জিয়ার আইনজীবী ও জয়নুল আবেদীন বলেছেন, আমরা মনে করি, আইনগত যে দিকগুলো আমরা আদালতে তুলে ধরেছি ইনশা আল্লাহ সবই আমাদের পক্ষে। আমরা আশা করি হাইকোর্ট যে জামিন দিয়েছেন সেটি বহাল রাখবেন আপিল বিভাগ।

 

Check Also

স্বাধীনতার ৫৩ বছরে আজ প্রশ্ন উঠছে গণতন্ত্র কোথায়: মঈন খান

ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে রাখার জন্য বিরোধী দলের রুদ্ধে এক লাখ মামলা দেওয়া হয়েছে ও তাদের …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।