বিবিএসের শ্রমশক্তি জরিপের তথ্য চার কোটি ৮২ লাখ প্রকৃত বেকার

বেসরকারি খাতে কাঙ্ক্ষিত বিনিয়োগ না হওয়াসহ তিন কারণে বাড়ছে বেকারের সংখ্যা * আইএলও’র বেকারের সংজ্ঞা বাংলাদেশের জন্য প্রযোজ্য নয় : বিশেষজ্ঞ * কর্মক্ষম তবে শ্রমশক্তির বাইরে তারাও প্রকৃত বেকার : ড. সালেহউদ্দিন

উচ্চশিক্ষিত বেকার মো. শরিফুল ইসলাম সাজু। বাড়ি কুড়িগ্রাম জেলা সদরের বেলগছা ইউনিয়নের ডাইরপাড়া গ্রামে। তিনি দু’বছর আগে মাস্টার্স শেষ করেছেন। অনার্সে পড়ার সময় থেকেই চাকরির সন্ধানে আবেদন করতে থাকেন। বিভিন্ন চাকরিতে লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেও দেখা গেছে মৌখিক পরীক্ষায় আর হয়ে ওঠেনি। এভাবে চাকরি খুঁজতে খুঁজতে এখন হতাশ তিনি। আর কোনো চাকরিতেই দরখাস্ত করছেন না।

কোনো কাজও করছেন না। এখন বাড়িতেই শুয়ে-বসেই সময় কাটে। সাজুর মতো এ রকম বেকারের সংখ্যাই বেশি। তবে সরকারি জরিপের তথ্যে বেকারের খাতায় এদের নাম উঠছে না। দেশে সাজুসহ তার মতো প্রকৃত কর্মহীন মানুষের সংখ্যা ৪ কোটি ৮২ লাখ ৮০ হাজার। এর মধ্যে কর্মক্ষম কিন্তু শ্রমশক্তিতে যোগ হয়নি এমন মানুষের সংখ্যা ৪ কোটি ৫৬ লাখ। অথচ আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) সংজ্ঞা অনুযায়ী এদের বেকার বলা হচ্ছে না।

একটু ঘুরিয়ে বলা হচ্ছে, এরা কর্মের সঙ্গে যুক্ত নয়, এরা শ্রমশক্তির বাইরে। বেকার বলা হচ্ছে ২৬ লাখ ৮০ হাজারকে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০১৬-১৭ অর্থবছরের শ্রমশক্তি জরিপের প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা গেছে এ চিত্র। সম্প্রতি শ্রমশক্তি জরিপ ২০১৬-১৭ প্রতিবেদনটি প্রকাশ করে সংস্থাটি।

বিশেষজ্ঞরা আইএলও’র বেকারের সংজ্ঞাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন। তারা বলেন, এ সংজ্ঞা বাংলাদেশের জন্য প্রযোজ্য নয়। তাদের মতে, বেসরকারি খাতে কাঙ্ক্ষিত বিনিয়োগ না হওয়াসহ তিন কারণে দেশে বেকারত্ব বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে জিডিপি প্রবৃদ্ধির সঙ্গে কর্মসংস্থানের সমন্বয় নেই। অর্থাৎ যে হারে প্রবৃদ্ধি হচ্ছে একই হারে কর্মসংস্থান বাড়ছে না। ফলে এই প্রবৃদ্ধি কর্মসংস্থান তৈরিতে তেমন ভূমিকা রাখছে না। এ ছাড়া বেসরকারি খাতে কাঙ্ক্ষিত বিনিয়োগ না হওয়া এবং সরকারি বিনিয়োগের কার্যকর ব্যবহার হচ্ছে না। এসবের নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে কর্মসংস্থানে। ফলে বেকারের সংখ্যা বাড়ছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

বিবিএসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে মোট কর্মোপযোগী মানুষের সংখ্যা ১০ কোটি ৯১ লাখ। এর মধ্যে কর্মে নিয়োজিত ৬ কোটি ৮ লাখ মানুষ। বাকি ৪ কোটি ৮২ লাখ ৮০ হাজার মানুষ কর্মক্ষম তবে শ্রমশক্তির বাইরে। এর মধ্যে শিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত ও অশিক্ষিত নারী-পুরুষ আছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, আইএলও’র সংজ্ঞার মধ্যে না পড়লেও বাংলাদেশে এরাই হচ্ছে প্রকৃত বেকার। আইএলও’র সংজ্ঞায় বেকার হচ্ছে যারা জরিপের সময় থেকে গত এক মাসের মধ্যে কাজ খুঁজেছেন, কিন্তু পাননি। তাদেরই বেকার হিসেবে ধরা হয়েছে। অন্যদিকে যারা সপ্তাহে ১ ঘণ্টা কাজ করেছেন (মূল্য পরিশোধ হোক বা না হোক) তারা কর্মে নিয়োজিত হিসেবে ধরা হয়েছে। তা ছাড়া যারা এক মাসের মধ্যে কোনো কাজ খোঁজেননি তারা শ্রমশক্তির বাইরে রয়েছেন। বিশেষজ্ঞদের মতে, আইএলও বেকারের যে সংজ্ঞা নির্ধারণ করেছে তা বাংলাদেশের জন্য প্রযোজ্য নয়। কর্মে নিয়োজিত ৬ কোটি ৮ লাখ মানুষের মধ্যে কৃষিক্ষেত্রে আছেন দুই কোটি ৪৭ লাখ, শিল্পে এক কোটি ২৪ লাখ এবং সেবা খাতে যুক্ত দুই কোটি ৩৭ লাখ মানুষ। কর্মক্ষম তবে শ্রমশক্তির বাইরে থাকা ৪ কোটি ৮২ লাখ ৮০ হাজারের মধ্যে নারীর সংখ্যা তিন কোটি ৬৩ লাখ ৩৩ হাজার এবং পুরুষ এক কোটি ১৯ লাখ ৪৭ হাজার।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বৃহস্পতিবার বলেন, আইএলও’র সংজ্ঞা মেনে জরিপ করায় প্রকৃত বেকারের সংখ্যা উঠে আসছে না। এর ফলে আসল বেকারের হিসাব পাওয়া যায় না। আইএলও’র বেকারের সংজ্ঞা বাংলাদেশের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। কেননা এ হিসাবে দেখানো হচ্ছে, দেশে বেকার সংখ্যা অনেক কম। কিন্তু প্রকৃত চিত্র হচ্ছে বেকার অনেক বেশি। বিশেষ করে শিক্ষিত বেকার অনেক বেড়েছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, যারা কর্মক্ষম কিন্তু শ্রমশক্তির বাইরে তারাও প্রকৃত অর্থে বেকার। এর মধ্যে খুব অল্পসংখ্যক রয়েছে, যারা কাজ করতে চান না। সেটি আলাদা কথা। তাই এক কথায় বলা যায়, দেশে বেকারের সংখ্যা অনেক বেশি।

জরিপ পরিচালনার দায়িত্বপ্রাপ্ত এলএমআইএস প্রকল্পের পরিচালক কবির উদ্দিন আহমেদ  বলেন, শ্রমশক্তির বাইরে থাকা ১৫ বছর বয়সের ওপরের এই মানুষগুলোর মধ্যে গৃহিণীদের একটি অংশ আছে। একটি অংশ আছে যারা বর্তমানে লেখাপড়ার সঙ্গে যুক্ত নয়। কোনো ধরনের প্রশিক্ষণের সঙ্গেও এরা যুক্ত নয়। কিংবা কোথাও কোনো কাজও এরা করছে না। এই অংশকে শ্রমবাজারে যুক্ত করা উচিত বলে মনে করে বিবিএস। তিনি বলেন, আইএলও’র সংজ্ঞা অনুযায়ী এরা বাংলাদেশে বেকার হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে না। আবার কাজ করছে এ ধরনের পরিসংখ্যানের সঙ্গেও যুক্ত হচ্ছে না। এদের সম্পর্কে বলা হচ্ছে শ্রমশক্তির বাইরে থাকা জনগোষ্ঠী।

২০১৫-১৬ অর্থবছরের শ্রমশক্তির বাইরে (বেকার) ছিল ৪ কোটি ৬৬ লাখ। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে এ সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৪ কোটি ৮২ লাখ ৮০ হাজার। তুলনামূলক পর্যালোচনা করলে দেখা যায় এ ধরনের কর্মহীন মানুষের সংখ্যাও বেড়েছে।

ঢাকায় নিযুক্ত বিশ্বব্যাংকের লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন বলেন, বিবিএসের জরিপে আইএলও’র সংজ্ঞা অনুযায়ী যে বেকার সংখ্যা দেখানো হয়েছে, বাস্তব অবস্থা তার ধারেকাছেই নয়। বাস্তবে বেকারের সংখ্যা অনেক বেশি। কেননা শ্রমশক্তির বাইরে থাকা মানুষগুলোর অধিকাংশই মহিলা ও তরুণ। এরা অনেকেই সামাজিক, পারিবারিক ও কর্মস্থলের পরিবেশের অভাবসহ নানা বাঁধার কারণে কর্মে যুক্ত হতে পারছে না। আর একটি অংশ আছে যারা দীর্ঘদিন ধরে কাজ খুঁজতে খুঁজতে হতাশ হয়ে পড়েছেন। যখন জরিপ চলে তখন হয়তো কাজ খোঁজা বাদ দিয়েছেন। ফলে তারা বেকারের তালিকায় আসেননি। আরেক ধরনের কর্মক্ষম মানুষ রয়েছেন যারা দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থায় কাজ পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা দেখেন না বলেই কাজ খোঁজেন না। তারা মনে করে যেহেতু কাজ পাব না সেহেতু খামাখা কেন স্টাম্প, ব্যাংক ড্রাফট বা দরখাস্ত লিখে অর্থ ব্যয় করব। ফলে তারাও কিন্তু বেকারের সংজ্ঞার মধ্যে আসেনি। প্রকৃতপক্ষে এরাও তো আসল বেকার।

বেকার বৃদ্ধির কারণ হিসেবে ড. জাহিদ হোসেন বলেন, যেখানে প্রতি বছর প্রবৃদ্ধি বাড়ছে তার আগের অর্থবছরের চেয়ে বেশি হারে। কিন্তু তার কোনো প্রতিফল কর্মসংস্থানে পড়ছে না। তাছাড়া সরকারি বিনিয়োগ বাড়লেও যেভাবে প্রকল্প বাস্তবায়নে খরচ হচ্ছে তা মানসম্মত হচ্ছে কিনা সেটি নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ খুব কম হচ্ছে। যেটা হচ্ছে সেটা হয়তো পুরনো যন্ত্রপাতি রিপ্লেসমেন্ট হচ্ছে। তাহলে সেটা তো কর্মসংস্থান বাড়াচ্ছে না। এক্ষেত্রে শিল্পের সম্প্রসারণও হচ্ছে না। এর বাইরে নতুন বিনিয়োগ যেগুলো আসছে সেগুলোর বেশির ভাগই অটোমেশন হচ্ছে।

সম্প্রতি প্রকাশিত প্রতিবেদনে খণ্ডকালীন বেকারের একটি চিত্রও তুলে ধরা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, দেশে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে টাইম রিলেটেড আন্ডার ইমপ্লয়েডের (খণ্ডকালীন বেকার) সংখ্যা ১৪ লাখ ৬৫ হাজার। যারা সপ্তাহে ৪০ ঘণ্টার কম কাজ করে। ১৫ থেকে ৬৫ বছর বয়সের এসব মানুষের মধ্যে পুরুষ ৯ লাখ ২৬ হাজার এবং মহিলার সংখ্যা ৫ লাখ ৩৯ হাজার। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে সম্ভাব্য শ্রমশক্তি তৈরি হয়েছে প্রায় ২৪ লাখ ৩৪ হাজার। এর মধ্যে পুরুষের সংখ্যা ৮ লাখ ৪৬ হাজার আর নারীর সংখ্যা ১৫ লাখ ৮৭ হাজার।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, জরিপের তথ্য সঠিকভাবে উঠে আসে কিনা এ বিষয়ে পরিসংখ্যান নিয়ে সব সময়ই প্রশ্ন থেকে যায়। তিনি বলেন, বাস্তবতা বিবেচনা করে বলতে পারি দেশে ২৬ লাখ ৮০ হাজারের চেয়ে প্রকৃত বেকার অনেক বেশি। তাছাড়া আমাদের ঘনবসতিপূর্ণ দেশে যারা শ্রমশক্তির বাইরে রয়েছে তাদের অধিকাংশই বেকার।

সূত্র জানায়, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির ২০১২ সালের এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলেছে, বাংলাদেশে প্রতি বছর নতুন ২২ লাখ কর্মক্ষম মানুষ শ্রমবাজারে প্রবেশ করে। কিন্তু কাজ পায় মাত্র ৭ লাখ। বাকি ১৫ লাখ থাকে বেকার। এর মধ্যে উচ্চশিক্ষিত অর্থাৎ স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে যারা শিক্ষাজীবন শেষ করেছেন তারাও রয়েছেন। প্রতি বছর এই ১৫ লাখ শ্রমশক্তি বেকারের সংখ্যা শুধু বাড়িয়েই চলেছে।যুগান্তর

Please follow and like us:

Check Also

ঈদে স্ত্রীর জন্য মাংস কিনতে না পারায় দিনমজুর স্বামীর আত্মহত্যা

জামালপুরের বকশীগঞ্জে স্ত্রীর জন্য মাংস কিনতে না পেরে চিঠি লিখে আত্মহত্যা করেছেন হাসান আলী (২৬) …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।