স্ত্রীর তথ্যে মিলল রংপুরে নিখোঁজ আইনজীবীর লাশ* স্ত্রীর সহপাঠি দুই স্কুলশিক্ষক আটক

ক্রাইমবার্তা ডেস্করিপোট:  জাপানি নাগরিক কুনিও হোশি ও মাজারের খাদেম রহমত আলী হত্যা মামলার প্রধান আইনজীবী রথীশ চন্দ্র ভৌমিকের (বাবু সোনা) লাশ পাওয়া গেছে। স্ত্রী স্নিগ্ধা সরকারের তথ্যের ভিত্তিতে মঙ্গলবার মধ্যরাতে শহরের তাজহাট মোল্লা পাড়ায় একটি নির্মাণাধীন বাড়িতে তার লাশ পাওয়া যায়। র‌্যাবের মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক মুফতি মাহমুদ খান রাত দেড়টায় এ তথ্য জানিয়েছেন। তিনি বলেন, লাশ শনাক্তের জন্য নিকটাত্মীয়দের খবর দেয়া হয়েছে।

সূত্র জানিয়েছে, রাত পৌনে দুইটায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত লাশ উদ্ধার বা শনাক্ত করা যায়নি। এর আগে পরিবারের উদ্যোগে মঙ্গলবার দিনভর রংপুর শহরের বাড়ির পাশের ডোবায় তল্লাশি চালানো হয়। সেখানে একটি রক্তমাখা শার্ট পাওয়া যায়। নতুন করে পুলিশ আরও দু’জনকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করছে। এ নিয়ে পুলিশের হেফাজতে রয়েছেন ছয়জন।

মঙ্গলবারও নগরীতে গণঅনশন, মানববন্ধন ও বিক্ষোভ সমাবেশ করেছে বিভিন্ন সংগঠন। আইনজীবীরা এক সমাবেশ থেকে রথীশকে উদ্ধারের দাবি জানিয়ে ২৪ ঘণ্টার সময়সীমা বেঁধে দেন। অন্যথায় আন্দোলনের হুমকি দেয়া হয়।

মঙ্গলবার নিখোঁজ আইনজীবীর সন্ধানে পরিবারের পক্ষ থেকে দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বাবু পাড়ায় নিজ বাড়ির পেছনে একটি ডোবায় তল্লাশি চালানো হয়। এ সময় পুলিশ-র‌্যাবের বিপুল সংখ্যক সদস্য উপস্থিত ছিলেন। ডোবায় তল্লাশি চালানোর সময় সেখানে একটি রক্তমাখা শার্ট পাওয়া যায়।

ওই শার্ট পাওয়ার পর পুলিশের তদন্ত কার্যক্রম নতুন মাত্রায় ভিন্ন দিকে মোড় নিয়েছে। ওই রক্তমাখা শার্টের মধ্যে নিখোঁজ আইজীবীর কোনো সম্পর্ক আছে কিনা- এ নিয়ে পুলিশের পক্ষ থেকে কোনো ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি। তবে তারা কোনো সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দিচ্ছেন না। শার্টটি এখন মাহিগঞ্জ পুলিশ ফাঁড়ির উপ-পরিদর্শক শাহ আলমের হেফাজতে রয়েছে বলে ওই পুলিশ কর্মকর্তা নিশ্চিত করেছেন।

রংপুর পুলিশের এএসপি (সার্কেল-১) সাইফুর রহমান সাইফ বলেন, ডোবায় তল্লাশির সময় যে শার্টটি পাওয়া গেছে সেখানে রক্তের মতো দাগ রয়েছে। কাদা পানিতে দাগটি ঠিক স্পষ্ট নয়। তাই শার্টের ‘ফরেনসিক’ পরীক্ষার পর বোঝা যাবে শার্টটি কার এবং ওই দাগ রক্তের কিনা। তিনি আরও জানান, ঘটনায় জড়িত থাকতে পারে এমন সন্দেহে তাজহাট উচ্চ বিদ্যালয়ের দু’জন শিক্ষককে মঙ্গলবার আটক করা হয়েছে। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করে নিখোঁজ ঘটনায় কোনো ক্লু পাওয়া যায় কিনা তা দেখা হচ্ছে।

পরিবারের পক্ষ থেকে দায়ের করা মামলাটির তদন্তে নেমেছে পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার একাধিক দল। তবে নানা তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে তদন্ত কার্যক্রম শুরু করা হয়েছে। পুলিশ হেড কোয়ার্টার থেকে নিখোঁজের ঘটনায় তদন্ত অগ্রগতি সম্পর্কে সার্বক্ষণিক তদারকি করা হচ্ছে বলেও ওই পুলিশ কর্মকর্তা জানান। নতুন করে আটকরা হলেন- তাজহাট উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মতিয়ার রহমান ও কামরুল ইসলাম। আইনজীবী রথীশ চন্দ্র ভৌমিকের স্ত্রী স্নিগ্ধা সরকার তাজহাট উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক। আটকরা হলেন তার সহকর্মী ও পারিবারিকভাবে ঘনিষ্ঠ। এর মধ্যে কামরুল ইসলামের সঙ্গে অতি ঘনিষ্ঠতা নিয়ে পারিবারিক বিরোধ ছিল এবং এ নিয়ে প্রায় মারধরের ঘটনাও ঘটত বলে পুলিশের একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে। তাই পুলিশের সন্দেহের তীর এখন তার দিকে।

রক্তমাখা শার্ট সম্পর্কে রথীশ চন্দ্রের ছোটভাই সুশান্ত ভৌমিক সুবল বলেন, যে শার্টটি ডোবায় পাওয়া গেছে তাতে রক্তসদৃশ দাগ দেখা গেলেও শার্টটি তার নিখোঁজ দাদা রথীশ চন্দ্র ভৌমিকের নয়।

পুলিশের একজন দায়িত্বশীল উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা জানিয়েছেন, পরিবার থেকে পরিষ্কার কোনো তথ্য না পাওয়ায় তদন্ত নিয়ে দ্বিধান্বিত আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো। কারণ রথীশ চন্দ্র নিখোঁজের ঘটনায় পরিবার থেকে স্পষ্ট কোনো তথ্য দেয়া হচ্ছে না। বাড়ির লোকজন নানা বিষয় এড়িয়ে যাচ্ছেন। তাদের পারিবারিক মর্যাদা, রাজনৈতিক কারণ ও ধর্মীয়ভাবে বিষয়টি স্পর্শকাতর- তাই পুলিশ তার পরিবারের লোকজনকে বেশি জিজ্ঞাসাবাদ করছে না।

তিনি বাড়ি থেকে যে মোটরসাইকেলে পরিচিতজনের সঙ্গে চলে গেছেন এমন কোনো প্রত্যক্ষদর্শী পাওয়া যায়নি। পরিবারের দাবি তিনি সকাল সাড়ে ৬টায় বাড়ি থেকে বেরিয়েছেন আর তার মোবাইল ফোন ৭টার পর বন্ধ হয়। পুলিশ ও বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার কাছে মোবাইল ফোনসংক্রান্ত যে তথ্য রয়েছে তাতে দেখা যায়, ভোর ৫টার পর থেকে তার মোবাইলের সুইচ বন্ধ ছিল। ফলে সঠিক তথ্য নিয়েও বিভ্রান্তিতে পড়েছেন পুলিশের তদন্ত কর্মকর্তারা।

পুলিশের হেড কোয়ার্টার থেকে নিখোঁজের ঘটনায় তদন্ত অগ্রগতি সম্পর্কে সার্বক্ষণিক তদারকি করা হচ্ছে। এ বিষয়টি রংপুর পুলিশের দায়িত্বশীল একাধিক সূত্র থেকে জানা গেছে।

সোমবার থেকে থানায় আটকরা হলেন- ডিমলা কানন গোটলার আলম শেখের ছেলে দেলোয়ার হোসেন, হায়দার আলীর ছেলে রফিক মিয়া, ছালাম মিয়ার ছেলে জিয়ারুল মিয়া ও আজহারুল মিয়ার ছেলে বাহারুল মিয়া। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ আইনজীবী রথীশ চন্দ্র ভৌমিক নিখোঁজ ঘটনার কোনো রহস্যের হদিস পাননি বলে কোতোয়ালি থানার ওসি মো. বাবুল মিয়া জানান। তিনি বলেন, তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ততা পাওয়া গেলে তাদের গ্রেফতার দেখানো হবে।

আইনজীবী রথীশ চন্দ্রের ছোটভাই সুশান্ত ভৌমিক এ ঘটনায় বাদী হয়ে কারও নাম উল্লেখ না করে একটি মামলা করেছেন। ওই মামলার সূত্র ধরে পুলিশের পাশাপাশি ছায়া তদন্ত শুরু করেছে র‌্যাব, পিবিআই, সিআইডি, এনএসআই, ডিজিএফআইসহ সব গোয়েন্দা সংস্থা। তবে এখন এ ঘটনায় নির্দিষ্ট করে কোন পথে তদন্ত কার্যক্রম পরিচালিত করবে তা নিয়েও আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো বিপাকে পড়েছেন। আইনজীবী নিখোঁজের ঘটনায় মঙ্গলবার আদালত পাড়ায় আইনজীবী সমিতির পক্ষ থেকে বিক্ষোভ সমাবেশ ও মানববন্ধন করা হয়। সমাবেশ থেকে আইনজীবীরা ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আইনজীবী রথীশ চন্দ্র ভৌমিককে উদ্ধারের জন্য পুলিশ প্রশাসনকে সময় বেঁধে দেন। অন্যথায় কঠোর কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে বলে সমাবেশ থেকে ঘোষণা দেয়া হয়েছে। রংপুর প্রেস ক্লাবের সামনে হিন্দ, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ এবং জেলা পূজা উদযাপন পরিষদের উদ্যোগে সকাল ১০টা-বিকাল ৫টা পর্যন্ত গণঅনশন কর্মসূচি পালন করা হয়। সেখানে অনুষ্ঠিত সমাবেশে বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনের নেতারা কর্মসূচির সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে বক্তৃতা করেন।

গণঅনশন চলাকালে সমাবেশে বক্তৃতা করেন কুড়িগ্রাম আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট আব্রাহাম লিংকন, আওয়ামী লীগ রংপুর জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট রেজাউল করিম রাজু, মহানগর সাধারণ সম্পাদক তুষার কান্তি মণ্ডল, বাংলাদেশ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক স্বপ্না বিশ্বাস, রংপুর জেলা কমিটির সভাপতি বনমালী পাল, পূজা উদযাপন পরিষদ জেলা কমিটির সভাপতি সুব্রত সরকার মুকুল, কেন্দ্রীয় কমিটির সহসম্পাদক রত্না বোষ, কালীবাড়ি কমিটির সাধারণ সম্পাদক বাবন প্রসাদ, শিল্পকলা একাডেমির কেন্দ্রীয় সদস্য অভিনেতা বিপ্লব প্রসাদ, ছাত্রলীগ জেলা সভাপতি মেহেদি হাসান রণি, সুব্রত সরকার প্রমুখ।

এ ছাড়া বাবু সোনার নিজ এলাকা মাহিগঞ্জে এলাকাবাসী মানববন্ধন ও সমাবেশ করেছে। সমাবেশে সব স্তরের বিপুলসংখ্যক মানুষ অংশ নিয়েছে। মানববন্ধন থেকে দ্রুত বাবু সোনাকে উদ্ধারের দাবি জানানো হয়। একই দাবিতে বদরগঞ্জেও কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়েছে। হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ বদরগঞ্জ শাখার আয়োজনে ওই মানববন্ধন করা হয়। এর আগে সংগঠনের নেতারা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী বরাবর একটি স্মারকলিপি দেন।

মানববন্ধন চলাকালে সমাবেশে বক্তৃতা করেন- সাবেক ট্রাস্টি ও প্রাক্তন এমপি অধ্যাপক পরিতোষ চক্রবর্তী, পৌর মেয়র উত্তম কুমার সাহা, পূজা উদযাপন পরিষদের বদরগঞ্জ কমিটির আহ্বায়ক সুবোধ কুমার কুণ্ডু গোবিন্দ, যুগ্ম আহ্বায়ক ব্রজেন্দ্র কুমার সিংহ, হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের বদরগঞ্জ শাখার সভাপতি মাস্টার ধনঞ্জয় রায়, মুক্তিযোদ্ধা মাহবুবার রহমান হাবলু প্রমুখ।

সার্বিক পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে রংপুর পুলিশ সুপার মিজানুর রহমান জানান, আমরা সব তথ্য সংগ্রহ করার কাজ করছি। এখনই বলার মতো কোনো তথ্য হাতে নেই। সময় হলে সব জানা যাবে। আমরা প্রকৃত ঘটনা উদঘাটনের জন্য এবং নিখোঁজ আইনজীবীকে অক্ষত উদ্ধারের জন্য সব প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।

Please follow and like us:

Check Also

‘জলবায়ুু পরিবর্তন’ —– ঝুঁকিতে উপকূলের ৪০ শতাংশ কৃষিজমি

বাস্তুচ্যুত হওয়ার আশঙ্কা দুই লাখ ৪০ হাজার কৃষকের আবু সাইদ বিশ্বাস,সাতক্ষীরাঃ ‘জলবায়ুু পরিবর্তনে সবচেয়ে বড় …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।