কোটা সংস্কার আন্দোলনকারী এক ছাত্রীর পায়ের রগ কেটে দিয়েছে ছাত্রলীগের সভানেত্রী# ঘটনায় প্রত্যক্ষদর্শীরা যা বললেন

ক্রাইমবার্তা ডেস্ক রির্পৌট:ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কবি সুফিয়া কামাল হলে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারী এক ছাত্রীর পায়ের রগ কেটে দিয়েছে ওই হলের ছাত্রলীগের সভাপতি ইফফাত জাহান এশা।

মঙ্গলবার গভীর রাতে এ ঘটনার খবর ছড়িয়ে পড়ার পর অগ্নিগর্ভে পরিণত হয় গোটা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। বিভিন্ন আবাসিক হলের ছাত্ররা জড়ো হন কবি সুফিয়া কামল হলের সামনে। রাত পৌনে তিনটায় বিজয় একাত্তর হলের গেট ভেঙ্গে প্রায় সব সাধারণ ছাত্ররা মিছিল করে ছুটে যেতে থাকেন সুফিয়া কামাল হলের দিকে। ওদিকে সুফিয়া কামাল হলেরও সব সাধরণ ছাত্রীরা রুম ও ফ্লোর থেকে বের হয়ে হলের সামনে নেমে আসেন। ভেতরে ছাত্রীরা আর বাইরে অবস্থান নেন বিভিন্ন হলের ছাত্ররা। এমন অবস্থায় রগ কাটা ছাত্রলীগ নেত্রীর গলায় জুতার মালা পড়ায় সুফিয়া কামাল হলের সাধারণ ছাত্রীরা। এরপর শিক্ষার্থীদের আল্টিমেটাম অনুযায়ী তাকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। ছাত্রলীগও তাকে বহিষ্কার করেছে সংগঠন থেকে।

ছাত্রীরা জানায় কোটা সংস্কার আন্দোলনে যোগদানকারী অনেক ছাত্রীদেরই কয়েক দিন ধরে নির্যাতন করে আসছিল এশা। যে ছাত্রীর পায়ের রগ কাটা হয়েছে তার নাম মোরশেদা আক্তার। বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের ৪র্থ বর্ষের শিক্ষার্থী। এশা কর্তৃক মারধরের শিকার হওয়া অন্য ছাত্রীরা হলেন ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের শারমিন সুলতানা তমা, তথ্য বিজ্ঞান ও গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপনা বিভাগের আফিফা আক্তার রিভু, ভূতত্ত্ব বিভাগের ঋতু ও স্বর্ণা।

ঘটনার পর থেকে মোরশেদার কাটা পায়ের ছবিসহ ঘটনার অনেক ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে ওয়েবসাইটে। ইশার গলায় জুতার মালা পড়ানো, বিজয় একাত্তর হলের গেট ভেঙ্গে ছাত্রদের দল বেধে বেরিয়ে যাওয়া, সুফিয়া কামাল হলের সামনে অবস্থান, সুফিয়া কামাল হলের সিঁড়ি ও রুমের মেঝেতে রক্তের ছবি এবং ভিডিও ছাড়া হয়েছে ইন্টারনেটে।

সুফিয়া কামাল হলে ছাত্রীর রগ কাটা এবং পরবর্তী ঘটনার সময় সেখানে উপস্থিত হন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড এ কে এম গোলাম রব্বানী এবং হলের আবাসিক শিক্ষকরা ।

ঘটনার খবর ছড়িয়ে পড়ার পর বিজয় একাত্তর হলের প্রায় সব ছাত্ররা রাত দুইটার পর থেকে বের হয়ে আসেন। কিন্তু হলের গেট বন্ধ থাকায় তারা বাইরে বের হতে পারছিলেন না। এক পর্যায়ে ছাত্রলীগের বাঁধা উপেক্ষা করে হলের গেট ভেঙ্গে তারা বের হয়ে যান এবং সুফিয়া কামাল হলের সামনে গিয়ে ঘটনার বিচার দাবি করেন।

প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ
সুফিয়া কামাল হলের আবাসিক ছাত্রী সাফয়িা শারমনি হলের রাতের ঘটনা সামনে থেকে দেখেছেন। তিনি এ বিষয়ে তার ফসেবুকে স্ট্যাটাস দয়িছেনে। তার ওই স্ট্যাটাস এখানে তুলে ধরা হলো

সুফিয়া কামাল হল থেকে বলছি…
ঘটনার সূত্রপাত আনুমানিক ১২ টার দিকে, সারাদিনের ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে গেছিলাম। এক ফ্রেন্ডের ফোনে ঘুম ভাঙ্গছে, লাফিয়ে উঠে নিচে দৌড় দিলাম। ৯ তলা থেকে নামতে নামতে দেখলাম ৩-৪ তলায় সিড়িতে রক্ত, ফ্লোরে রক্ত। ভিড় ঠেলে নিচে নামলাম, আপুদের কাছে জিজ্ঞাসা করার বলল তিনদিন ধরেই অত্যাচার চলতেছিল নিরবে, যারা পলিটিকালি হলে উঠেছে তাদের উপর, এখন এক মেয়ের পা কেটে দিয়েছে। কেউ ভয়ে মুখ খুলে নাই।

প্রত্যয় প্রদীপ্ত দুটো মুখোমুখি ভবন। এশা প্রত্যেয়ে মেয়েদের মারার সময় কিছু মেয়ে দেখে চিৎকার করছে। কিছু মেয়ে নিচে নেমে আসলে তাদেরকে বলছে ‘ত্যাঁলাপোকা দেখে চিৎকার দিছে, কিছু হয় নাই।’ কিন্তু ফ্লোরে সিড়িতে রক্ত দেখে হলের মেয়েরা একত্রিত হইছে।

এর মধ্যে এশা ওই মেয়েদেরকে নিয়ে দরজা বন্ধ করে দিছে। তারপর হলের হাউজ টিউটর ম্যামরা এসে মেয়েটাকে হাসপাতালে পাঠাইছে, এবং হলের মাঠে সব মেয়েরা তখন ক্ষ্যাঁপা। এশার বহিষ্কার স্লোগান দিচ্ছিল, এর মধ্যে এশাকে কিছু মেয়ে মাঠে নিয়ে আসছে, তখন কিছু মাইরও খাইছে।

এর মধ্যে ভাইয়ারাও চলে আসছে হলের সামনে। ম্যামরা জানতে চাইলো আমরা কি চাই? বললাম এশাকে আজীবনের জন্য বহিষ্কার, ওকে জুতার মালা পরাবো আমরা। যেহেতু কোটা সংস্কার আন্দোলন অহিংস আন্দোলন, তাই মারবো না । এর মধ্যে ভাইয়ারাও চলে আসলো উদ্ধার করতে। সামনের দিকেই ছিলাম, আস্তে করে বললাম ‘ভুয়া’ সাথে সাথে শুরু হয়ে গেল প্রক্টর তুই দুর হ, ভুয়া।

অনেক কথাবার্তার পর এশাকে নিয়ে আসা হলো সবার সামনে মাফ চাওয়ার জন্য, জুতার মালা পড়ানোর জন্য। কিন্তু প্রক্টর এশাকে জুতার মালা পরাতে দিবেন না। মেয়েরা ক্ষেপে গেল, তারপর শুরু হল ধাক্কাধাক্কি। এদিকে গোলাম ও তার সাথের লোকজন এশাকে ঘিরে বাঁচাতে চাইছেন প্রাণপণে। এ সময় রগকাটা নেত্রী সহ অনেকে মাইর খেলেন।

এদিকে দুই ভবনের গেটে তালা ঝুলিয়ে দেওয়ায় আমরা ক্যান্টিনের পিছনের গেট দিয়ে হলে মেইন গেটে চলে আসলাম, যাতে কেউ পালাতে না পারে। ভাইয়ারা তখন বাইরে অবস্থান করছেন, স্লোগান দিচ্ছেন। এদিকে ধ্বস্তাধ্বস্তির এক পর্যায়ে এশাকে জুতার মালা পড়ানো হলো, হাউস টিউটর কাছ থেকে মৌখিক বিবৃতি নেওয়া হলো।

এরপর ম্যামরা ধ্বস্তাধ্বস্তির এক পর্যায়ে প্রক্টর এবং এশাকে হাউস টিউটর ভবনের ভিতরে ঢুকিয়ে কলাপসিপল গেট বন্ধ করে দিল। তখন মেয়েরা হাউস টিউটর ভবনের সামনে অবস্থান নিল, তারপর আমরা আমাদের দাবি এবং স্লোগান সমানতালে চলতে থাকলো। ভিতরে আমরা বাইরে ভাইয়ারা। সুফিয়া কামাল হল থেকে তিনটি দাবি দেওয়া হয়েছে যে হলে কোন আনুষ্ঠানিক রাজনীতি থাকবে না, ছাত্রীদের উপর অত্যাচারের বিচার এবং আমাদের ভাইবোনদের উপর অত্যাচারের বিচার করতে হবে। রাত ৪ টার দিকে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়েছে, ভাইয়ারা ফিরে গেছেন। মেয়েরা তাদের দাবি আদায়ে গণস্বাক্ষর করছে।

সুফিয়া কামাল হলের ঘটনা সম্পর্কে ঢাবি ভিসি
কবি সুফিয়া কামাল হলের ঘটনার পর উদ্ভুত পরিস্থিতি নিয়ে সাংবাদিকদের ব্রিফিং করেছেন ঢাবি ভিসি মো. আখতারুজ্জামান। তিনি রাতে এই ব্রিফিং করেন।

ভিসি বলেন, ‘দুঃখজনক। এটা একটি অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা। আমি তাৎক্ষণিক প্রক্টরের সঙ্গে যোগাযোগ করে প্রক্টরের টিমকে ওখানে পাঠিয়েছি। হল প্রশাসনকে বলেছি, মেয়েদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে। তারপর আমি বিস্তারিত জেনেছি। আমি অবহিত হয়েছি— হলের ইফাত জাহান এশা আরেকটি মেয়েকে মেরেছে। যা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও ছড়িয়ে পড়ে। যার নিন্দা জানানোর ভাষা আমাদের নেই। হল প্রশাসনকে বলেছি, দোষী মেয়েটিকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করতে। আগামীকাল এর আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করা হবে। প্রকৃত ঘটনা জানতে একটি তদন্ত কমিটিও করে দেবো। কেউ যেন সীমালঙ্ঘন না করে। আইনহীনতা, বিচারহীনতা চলতে পারে না। সে যেই হোক, বিচার হবে।

ইফাত জাহান এশাকে এর আগেও বহিষ্কার করা হয়েছিল এবং পুনরায় বহিষ্কারাদেশ প্রতাহ্যার করা হয়। এবারও কি সেরকম হবে কিনা সাংবাদিকরা জানতে চাইলে ভিসি বলেন, ‘আমরা সজাগ থাকবো, সেরকম যাতে না হয়। রাজনৈতিক পরিচয় যাই থাকুক, কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

 

Please follow and like us:

Check Also

ঈদে স্ত্রীর জন্য মাংস কিনতে না পারায় দিনমজুর স্বামীর আত্মহত্যা

জামালপুরের বকশীগঞ্জে স্ত্রীর জন্য মাংস কিনতে না পেরে চিঠি লিখে আত্মহত্যা করেছেন হাসান আলী (২৬) …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।