থানা থেকে মাত্র দেড়শ গজ দূরে দিনের আলোতে ব্রাশফায়ার কেন? রক্তাক্ত কেন পাহাড়? উদ্দেশ্য বা কি? বাইরের কোন শক্তির ইন্ধন আছে কিনা

ক্রাইমবার্তা ডেস্করিপোট:  থানা থেকে মাত্র দেড়শ গজ দূরে দিনের আলোতে ব্রাশফায়ার। রক্তের দাগ লালচে থেকে কালচে হয়েছে সবে। আবারও ব্রাশফায়ার। যেন সিনেমার শুট! একই কায়দায় দু’টি হত্যাকাণ্ড। ফের অশান্ত পাহাড়! ফের ব্লাডশাড (রক্তপাত)!

ব্যবধান মাত্র একদিন। তবে ফায়ার হয় প্রায় একই সময়। রাঙ্গামাটির নানিয়ারচরের উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান শক্তিমান চাকমা দুর্বৃত্তের গুলিতে নিহত হন বৃহস্পতিবার। একদিন পর (শুক্রবার) নিহতের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় অংশ নেয়ার পথে ফের গুলিতে ৫ জন নিহত হন। নিহত ৫ জন ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) সদস্য।

এ দু’টি হত্যাকাণ্ডে উত্তাপ ছড়িয়েছে পাহাড়ে। প্রশ্ন উঠছে শান্তিচুক্তির ভবিষ্যৎ নিয়েও। এ-ও প্রশ্ন এখন-তাহলে কি পাহাড়ে শান্তি ফিরবেই না! ভ্রাতৃঘাতি সংঘাতে লাশের পর লাশ পড়ছে। কিন্তু এই সংঘাতের মূলে কী? এর শেষ-ই বা কোথায়? কেন-ই বা নিজেদের শক্তি ক্ষয় করছে পাহাড়িরা? নাকি আবারও ব্যাপকতায় ফিরবে পাহাড়ের সংঘাত!

কথা হয়, নিরাপত্তা বিশ্লেষক ব্রিগেডিয়ার (অব.) সাখাওয়াত হোসেনের সঙ্গে। দীর্ঘদিন থেকেই পাহাড়ের সংঘাত নজরে রাখছেন তিনি। লিখছেন, পাহাড়ের নানা সমস্যা আর সমাধানের প্রসঙ্গ তুলে।
khagrachari
এই বিশ্লেষক বলেন, ১৯৯৭ সালে যে শান্তিচুক্তি হয়, ‘তা পাহাড়িদের জন্য সার্বজনীন ছিল না। শান্তিচুক্তি অনুষ্ঠানেই ‘পার্বত্য চট্টগ্রামে পূর্ণ স্বায়ত্বশাসন চাই’ স্লোগান দিয়ে চুক্তির বিরোধিতা করে ইউপিডিএফ। চুক্তি সম্পন্ন হলো দুই দশক। কিন্তু লাশের সারি দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে।’

এখন কেন সংঘাত-এমন প্রশ্নের জবাবে সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘প্রথমত, শান্তিচুক্তির অধীনে সকল পাহাড়ি বা সংগঠনগুলোকে আনা যায়নি। অর্থাৎ নানা অভিযোগ এবং দাবির বিষয়ে পাহাড়িরা এখনও সোচ্চার। এই প্রশ্নেই বাঙালি-পাহাড়ি এবং পাহাড়ি-পাহাড়িরা সংঘাতে লিপ্ত হচ্ছেন।’

দ্বিতীয় কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘ইউপিডিএফ এবং সমমনা সংগঠনগুলো মনে করে সন্তু লারমার দল জনসংহতি সমিতি (জেএসএস) সরকারের সঙ্গে হাত মিলিয়ে পাহাড়িদের সঙ্গে বেঈমানি করেছে। জেএসএস বিভিন্ন নির্বাচনে অংশ নিয়ে সুবিধা নিচ্ছে এবং সরকারকে সুবিধা দিচ্ছে। অন্যদিকে পাহাড়িদের দাবি-দাওয়ার ব্যাপারে সরকার এবং সন্তু লারমার দল উদাসীন। চুক্তি বাস্তবায়ন না হওয়াও এই সংঘাতপূর্ণ অশান্তির কারণ।’

তিনি বলেন, ‘সংঘাতের তৃতীয় কারণ হচ্ছে, ভূমি সংস্কারে জটিলতা। পাহাড়ের ভূমি সমস্যার সমাধান সরকারগুলো করতে পারেনি। আর এসব কারণেই নিজেরা বিভাজিত হচ্ছেন এবং সংঘাতে জড়াচ্ছেন। মূলত পাহাড়ে এখন যেসব হত্যাকাণ্ড তার পেছনে নেতৃত্ব এবং আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করেই এবং এর পেছনে মূলত উল্লেখিত কারণগুলোই দায়ী।’

কি হতে পারে পাহাড়ে-এর জবাবে বলেন, ‘পাহাড় শান্ত ছিল না। অস্থায়ী অশান্তি ছিল-ই বটে। এটি যেন স্থায়ী না হয়, তা এখনই আমলে নিতে হবে। অস্ত্র কোথা থেকে আসছে, কারা দিচ্ছেন, তা এখনই জানতে না পারলে বিপদ বাড়বে’।
পাহাড়ে চলমান সংঘাত নিয়ে কথা বলা হয় পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) সভাপতি ও পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় সন্তু লারমার সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘সংঘাত নিয়ে এই মুহূর্তে কোনো মন্তব্য করতে চাই না। আমরা পর্যবেক্ষণ করছি। আমরা শান্তির পক্ষে।’

১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর ঐতিহাসিক শান্তি চুক্তির পর থেকেই ভাঙন আর মতাদর্শিক বিভক্তি দেখা দেয় পাহাড়ে। পার্বত্য চট্টগ্রামে বর্তমানে পাহাড়িদের মোট চারটি গ্রুপ সক্রিয় রয়েছে।

জেএসএস (সন্তু লারমা) ভেঙে ইউপিডিএফ গঠিত হয় চুক্তির পরপরই। এরপর জেএসএস (সন্তু লারমা) থেকে ফের জেএসএস সংস্কারপন্থী (মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা) গঠিত হয়। আর ইউপিডিএফ ভেঙে গঠিত হয় ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক)।
khagrachari
সূত্র জানায়, শান্তিচুক্তির পর থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত মোট ৪৭৬ জন নিহত হয়েছেন পাহাড়ে। আর ২০১৮ সালের ৪ মে পর্যন্ত নিহত হন ১৬ জন। আরও ৮ জন নিখোঁজ হয়েছেন এ বছর।

পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির স্বাক্ষরের ধারাবাহিকতায় ১৯৯৮ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি খাগড়াছড়িতে আনুষ্ঠানিকভাবে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে গেরিলা নেতা সন্তু লারমার নেতৃত্বে অস্ত্র সমর্পণ করে জনসংহতি সমিতির সদস্যরা। একই দিনে প্রসীত বিকাশ খীসার নেতৃত্বে খাগড়াছড়িতে শত শত বিদ্রোহী পতাকা উত্তোলন করে অস্ত্র সমর্পণ অনুষ্ঠানকে ধিক্কার জানায়। এরই ধারাবাহিকতায় পরবর্তীতে ১৯৯৮ সালের ২৬ ডিসেম্বর ঢাকায় সম্মেলনের মধ্য দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের পূর্ণ স্বায়ত্ত্বশাসনের দাবিতে ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) গঠিত হয়। শুরু হয় সন্তু ও প্রসীতের নেতৃত্বে দুই সংগঠনের আধিপত্য রক্ষার লড়াই।

২০০৮ সালে জেএসএস ভেঙে সুধা সিন্দু খীসার নেতৃত্বে গঠিত হয় জেএসএস (এমএন) গ্রুপ। শুরু হয় ত্রিমুখী সংঘাত। কখনো জেএসএস-ইউপিডিএফ আবার কখনো জেএসএস (সন্তু)-জেএসএস (এমএন)। কখনো, কখনো নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষ। এই সংঘর্ষে এ পর্যন্ত প্রাণ হারিয়েছে সাড়ে ৬ শতাধিক যুবক। ১৫ নভেম্বর-২০১৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামের অন্যতম আঞ্চলিক দল ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) ভেঙে আরও একটি নতুন দল গঠিত হয়েছে। ১৫ নভেম্বর-২০১৭ সালে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে আত্মপ্রকাশ করা দলটির নাম ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক)।

অন্তত চারটি ধারায় বিভক্ত পার্বত্য চট্টগ্রামের আঞ্চলিক রাজনীতি এবং এ বিভক্তিরই সর্বশেষ বলি হলেন নানিয়ারচর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান শক্তিমান চাকমা। তিনি ছিলেন জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) একাংশের কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি। শক্তিমান চাকমাদের এ অংশটি জনসাধারণ্যে সংস্কারপন্থী জেএসএস নামে পরিচিত হলেও তারা নিজেরা লেখে জেএসএস (এমএন লারমা)।

পাহাড় প্রসঙ্গে কথা হয়, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি এবং সরকারের সমাজকল্যাণমন্ত্রী রাশেদ খান মেননের সঙ্গে। বলেন, পাহাড়িরা নিজেরা এ বেলায় কেন সংঘাতে জড়াচ্ছে, তা বুঝে আসছে না। তবে এই সংঘাত কোনোভাবেই শুভ ইঙ্গিত না।
তিনি বলেন, আমরা শান্তিচুক্তির পক্ষে। আওয়ামী লীগ সরকার যখন পার্বত্য শান্তিচুক্তি করে, তখন আমরাও স্বাগত জানিয়েছি। যদিও নানা প্রশ্ন ছিল। এরপর বিএনপি ক্ষমতায় এসে চুক্তির ব্যাপারে একেবারে উদাসীন ছিল। বরং তারা এই সময়ে চুক্তি নষ্ট করার সকল পরিকল্পনা করেছিল।
khagrachari
মেনন বলেন, সরকার পাহাড়ে শান্তি রক্ষায় বদ্ধপরিকর। পাহাড়ে এখন মূল সমস্যা হচ্ছে ভূমির সংস্কার। চুক্তি অনুযায়ী যেভাবে ভূমি সমস্যার সমাধান করার কথা, তা অবিলম্বে বাস্তবায়ন করতে হবে। চুক্তির অন্যান্য শর্তও পূরণ করা এখন সময়ের দাবি।

অপরদিকে পাহাড়ে অশান্তির জন্য সরকারগুলোকেই দায়ী করলেন বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম। তিনি বলেন, যে চেতনার মধ্য থেকে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা তা বাস্তবায়ন না হওয়ার কারণেই এই অশান্তি।

তিনি বলেন, অশান্তি তো সমতলেও। অধিকার আদায়ের জন্যই পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ সৃষ্টি। অথচ সমাজে বৈষম্য বাড়ছে। সমতলের আদিবাসীরাও সব হারিয়ে ফেলছে। পাহাড়ে বাঙালি গিয়ে লুট করছে। পাহাড়ের সম্পদ আর পাহাড়িরা রাখতে পারছে না। এই বৈষম্য রাষ্ট্রীয়ভাবেই করা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন করতে পারলেই পাহাড়-সমতলে শান্তি ফিরবে।jagonews24

Please follow and like us:

Check Also

২৫ হাজার সরকারি টিউব অয়েলে উঠছে না পানি: দুষ্পাপ্য পানযোগ্য পানি: সাতক্ষীরার জনজীবনে হাঁসফাঁস

আবু সাইদ বিশ্বাস, সাতক্ষীরাঃ তীব্র খরা: বৃষ্টি হীনতা ও পানিতে লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ায় উপকূলীয় জেলা …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।