‘প্রথম রোজার দিন (বৃহস্পতিবার) রাতে একটা রুটি দিয়েছিল খেতে:‘কোনও মেয়ে যেন সৌদি আরব না যায়’

ক্রাইমবার্তা রিপোট  ঢাকা: শুক্রবার (১৮ মে) রাত ১২টা। রাজধানীর হযরত শাহজালাল বিমানবন্দর থেকে বেরিয়ে এলেন শিউলি আক্তার পিংকি। মেয়ের জন্য বাইরে অপেক্ষা করছিলেন বাবা বাবুল সাজি। বাবাকে পেয়েই কান্নায় ভেঙে পড়েন পিংকি। মেয়েকে বুকে আগলে নিজের কান্না সংবরণ করে তার কান্না থামানোর প্রাণপণ চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু কিছুতেই মেয়ের কান্না থামছিল না। প্রায় ১৫ মিনিট চেষ্টার পর পিংকির কান্না থামে। তখন বাবার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়তে শুরু করে। দেশে ফেরা এবং পরিবারকে কাছে পাওয়ার আনন্দে এভাবেই কেটে যায় কিছুটা সময়। প্রায় পৌনে এক ঘণ্টা পর পিংকি স্বাভাবিক হন। সৌদি আরবের দাম্মাম শহরের যে বাসায় তিনি কাজ করতেন সেখানকার বর্ণনা দেন।
পিংকি বলেন, সৌদি আরব যাওয়ার পর জানতো না কোথায় সে কাজ করছে। বাসার মালিকের নামও জানা ছিল না তার। ভাষাও বোঝেন না তাই, ইশারায় নির্দেশ বুঝে নিয়ে সব কাজ করতেন। প্রতিদিন তিনতলা বাসা ধুয়ে-মুছে পরিষ্কার করতে হতো তাকে। প্রতিটি তলার ১০টি বড় বড় রুম ছিল। এমনকি ছাদও পরিষ্কার করতে হতো প্রতিদিন।
তিনি বলেন, ‘সকালে উঠে থালা-বাসন পরিষ্কার করতাম। এরপর সারাদিন পানি দিয়ে ঘর-বাড়ি পরিষ্কার করতে করতে পুরো শরীর ভিজে যেতো। শুকনা কাপড় পরারও সময় পেতাম না। রাতে ভেজা কাপড়েই ঘুমিয়ে পড়তাম, টের পেতাম না। সকালে ওঠার পর বুঝতাম গায়ের কাপড় ভেজা ছিল। পরের দিন আবার একই কাজ। এত কাজের বিনিময়ে সকালে একটা আর রাতে একটা রুটি খেতে দিতো। হাতে-পায়ে ধরে ভাত চাইলেও দিত না। ওরা অনেক ভালো-মন্দ খাবার খেতো, আমাকে দিতো একটা রুটি। আমার মতো কেউ যেনও আর সৌদি আরব না যায়।’
পিংকি বলেন, ‘কয়েকদিন কাজ করার পরে অসুস্থ হয়ে পড়লে আমাকে  নিয়ে যাওয়া হয় একটি ক্যাম্প। নোংরা আর প্রচণ্ড গরমে থাকতে হয়েছে সেখানে।’
তিনি আরও বলেন,  ‘প্রথম রোজার দিন (বৃহস্পতিবার) রাতে একটা রুটি দিয়েছিল খেতে। আমরা ৯ জন মেয়ে মিলে তাদের ভাত দেওয়ার অনুরোধ করার পর সেহরিতে ভাত দেয়। আলু আর পেঁয়াজের পাতার ভাজি দিয়ে ভাত খেয়েছি। ইফতার করেছি এক গ্লাস পানি দিয়ে। দুই ঘণ্টার পর ভাত দিয়েছে আলু আর পেঁয়াজ পাতার ভাজি দিয়ে।’
চোখের পানি মুছতে মুছতে পিংকি বলেন, ‘সৌদি আরব যাওয়ার পর খাওয়ার খুব কষ্টে ছিলাম ভাই। আপনিই বলেন, খেতে না পাওয়ার চেয়ে আর কী কষ্ট আছে।’
পিংকির বাবা বাবুল সাজি  বলেন, ‘আমার মেয়ের নাম শিউলী আক্তার পিংকি। ওর বয়স এখন ১৮ বছর। কিন্তু ২৬ বছর দেখিয়ে ওর পাসপোর্ট করা হয়েছে। এখনও জাতীয় পরিচয়পত্র হয়নি আমার মেয়ের। পিংকি চেয়েছিল, বেশি টাকা আয় হলে ছোট ভাইবোন দু’টির লেখাপড়া করবে। কিন্তু তাকেই হারানোর অবস্থা হয়েছিল। তাকে ফিরে পেয়েছি। আপনার দোয়া করবেন আমার মেয়ের জন্য।’
সৌদিতে পাঠাতে কত টাকা খরচ হয়েছে জানতে চাইলে বাবুল সাজি জানান, প্রতিবেশী বাতেনের মাধ্যমে আল মনসুর ওভারসিস অ্যান্ড ট্রাভেলসকে ৪৫ হাজার টাকা দিয়েছি। মেয়ের আয় থেকে বাকি ৫৫ হাজার টাকা দেওয়ার কথা রয়েছে।
পিংকি যাওয়ার সময় অনুরোধ করে বলেন, ‘আপনারা আল মনসুর বন্ধ করে দেন। বন্ধ না হলে কত মেয়েকে নিয়ে যে কষ্ট দেবে তার ঠিক নেই।’
প্রসঙ্গত, আল মনসুরের সৌদিতে পাঠানো ৯ নারীর একজন পিংকি। তার বাড়ি মুন্সীগঞ্জের টঙ্গিবাড়ী থানার দক্ষিণ কুমিরা গ্রামে। বিমানবন্দরে সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মী বলেন, ‘সবার সহযোগিতায় পিংকিসহ পাঁচজন আজ (শুক্রবার) ফেরত এসেছে। অন্য চারজনকেও ফেরত আনার চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।’

Please follow and like us:

Check Also

এদেশের সাম্প্রদায়িকতার বিশ্বস্ত ঠিকানা বিএনপি: কাদের

বিএনপির সমালোচনা করে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, বিএনপি এদেশের সাম্প্রদায়িকতার …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।