কয়েদি থেকে হবু প্রধানমন্ত্রীর আসনে

ডয়চে ভেলে : তিনি মালয়েশিয়ার দীর্ঘ সময়ের বিরোধী নেতা। গত বুধবার কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েছেন। তাঁর রাজনৈতিক জীবন ও অবশেষে রাজনীতির শিখরে প্রত্যাবর্তন বিরোধীদের আন্দোলনকে অনুপ্রাণিত করেছে, জুগিয়েছে এগিয়ে চলার খোরাক। মুক্তিলাভের পর প্রথম সংবাদ সম্মেলনে আনোয়ার ইব্রাহিম বলেন, ‘এই মুহূর্তে আমার জীবনের ট্যাগলাইন হতে পারে কারাগার থেকে প্রাসাদে।’ মালয়েশিয়ার রাজা পঞ্চম মুহম্মদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে কুয়ালালামপুরে নিজের বাড়িতে ফিরেছেন ইব্রাহিম। ২০১৫ সালে তাঁকে যে অপরাধে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছিল, তা থেকে রাজা এ প্রবীণ নেতাকে মুক্তি দিয়েছেন। ইব্রাহিমের মতে, তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।

আমি কখনও লড়াই ছাড়িনি

৭০ বছর বয়সী ইব্রাহিমের ‘পিপল্স জাস্টিস পার্টি’ ক্ষমতায় আসা চারদলীয় জোট ‘কোয়ালিশন অফ হোপ’-এর শরিক। প্রাক্তন এক সতীর্থের সঙ্গে কথিত যৌন সংসর্গের দায়ে ২০১৫ সালে ইব্রাহিমকে পাঁচ বছরের কারাবাসের সাজা দেয়া হয়। মালয়েশিয়ার বর্তমান আইন অনুযায়ী, মুক্তি পাওয়ার পাঁচ বছর পর্যন্ত কেউ প্রশাসনিক পদে থাকতে পারবেন না, যদি না রাজা তাঁকে মার্জনা করেন। এই পরিস্থিতিতে তিন বছর আগে সাজাপ্রাপ্ত ইব্রাহিমের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ সবদিক থেকেই অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিল।

তবে মালয়েশিয়ার রাজনীতি সর্বদাই চমকে ভরা। ইব্রাহিমের থেকেও বড় মাপের কোনো রাজনীতিক যদি মালয়েশিয়ায় থাকেন, তিনি ৯২ বছরের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মুহাম্মদ। এই মাহাথির কখনও ইব্রাহিমের গুরু, কখনও তাঁর বিপর্যয়ের কারণ, কখনও আবার সহযোগী।

৯ই মে’র নির্বাচনে বারিসান ন্যাশনালের পরাজয়ের ঠিক এক সপ্তাহ পর আনোয়ার ইব্রাহিম মুক্তি পেয়েছেন। ইব্রাহিম কবুল করেছেন যে, এটা সম্ভব হয়েছে মাহাথিরেরই অক্লান্ত প্রচেষ্টার ফলে। রাজার কাছ থেকে ক্ষমালাভের পর ইব্রাহিম বলেন, ‘বন্দি থাকার সময় বোঝা যায় স্বাধীনতার গুরুত্ব কোথায়। কারও ক্ষেত্রে যেন এমনটা না হয়। এ সময়টা অনেকে আমার পাশে থেকেছেন। তবে এটা ঠিক যে, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে মানুষকে কারারুদ্ধ করা আমাদের বন্ধ করতে হবে।’

রাজনীতিতে নিজের প্রত্যাবর্তন সমপর্কে ইব্রাহিম বলেন, ‘আমি কখনও লড়াই ছাড়িনি। আমি রাজনীতিতেই ছিলাম। শারীরিকভাবে না হলেও ছিলাম। মাহাথিরের শেষ বার্তাটি ছিল খুব সপষ্ট, আবেদনময়। সেই বার্তা আমি শুনেছি। তাঁর পাশেই থেকেছি।’ রাজনীতিতে ফেরার পর এবার বিদেশ সফরের পরিকল্পনা করেছেন ইব্রাহিম। তিনি বলেন, ‘আমি হার্ভার্ড ও জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা দিতে যাবো। কয়েকটি মুসলিম দেশও সফর করবো। আমাকে এটা প্রচার করতে হবে যে, যুক্তি ও সহিষ্ণুতাই ইসলামের পথ। এর মাধ্যমে দেশের নাগরিকদের স্বাধীনতা ও ন্যায়বিচারও নিশ্চিত করা যাবে।’

নাজিবের বিরুদ্ধে আমার কোনো ক্ষোভ নেই

দেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাকের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেয়া হবে? এ প্রশ্নের উত্তরে ইব্রাহিম জানান, ‘জনতার প্রতি অন্যায়, অপরাধ, চরম দুর্নীতি এ দেশের নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর জবাব তাকে দিতেই হবে। আমি অবশ্য তাঁকে ক্ষমা করে দিয়েছি। কারণ আমি এগিয়ে যেতে চাই। নাজিবের বিরুদ্ধে আমার কোনো ক্ষোভ নেই।’ মাহাথিরের সঙ্গে হাত মিলিয়ে কাজ করার ব্যাপারে ইব্রাহিম বলেন, ‘আমার লক্ষ্য দেশের মঙ্গল। মাহাথির আমার মুক্তির জন্য অক্লান্ত চেষ্টা চালিয়ে গেছেন। সংস্কারের লক্ষ্যেও তিনি অবিচল।

আমার তাঁর প্রতি ক্ষোভ থাকবে কেন?’

আনোয়ারের রাজনৈতিক জীবন শুরু হয় কুয়ালালামপুরের মালয় বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেটা ১৯৬০ সাল। তখন তরুণ ছাত্রনেতা ইব্রাহিম ‘মুসলিম ইয়থ মুভমেন্ট অফ মালয়েশিয়া’ (এবিআইএম) গঠন করেছিলেন। ১৯৮২ সাল পর্যন্ত এই সংগঠনের প্রেসিডেন্ট ছিলেন ইব্রাহিম। সে সময় তিনি সুদক্ষ বাগ্মিতায় গ্রামীণ জীবনের সমস্যার কথা তুলে ধরেছিলেন। এছাড়া তৎকালীন শাসক বারিসান ন্যাশনালের সঙ্গে ইউনাইটেড মালয়েজ ন্যাশনাল অর্গানাইজেশন (ইউএমএনও) জোটেরও তীব্র সমালোচক ছিলেন তিনি। ঘটনাচক্রে প্রধানমন্ত্রী মাহাথিরের পক্ষ থেকে ইউএমএওতে যোগ দেয়ার আমন্ত্রণ পান তিনি। ১৯৮২ সালে সেই আমন্ত্রণ স্বীকার করেন ইব্রাহিম। এরপরই তাঁর উত্থান ঘটে। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পেয়ে ১৯৯৮ সালে তিনি ‘এশিয়ান অফ দ্য ইয়ার’-এর শিরোপাও পান।

উত্থান-পতন : ইব্রাহিমের রাজনৈতিক জীবন উত্থান-পতনে ভরা। ২০১৪ সালের ভোটে যখন তার জয়ের সম্ভবনা উজ্জ্বল, ঠিক তখনই ধাক্কা খান আনওয়ার ইব্রাহিম। দশ বছর আগে স্ত্রীর গাড়িচালকের সঙ্গে যৌন সংসর্গের যে অভিযোগ থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন, আদালতের সেই নির্দেশ পালটে যায়। ফিরে আসে পুরনো অভিযোগ। আবারো জেলে যেতে হয় ইব্রাহিমকে। এদিকে রাজনীতির পট পরিবর্তন হতে থাকে। নাজিবের প্রতি বিরক্ত মাহাথির জোট ছেড়ে নয়া দল গঠন করেন। যে দলের হয়ে তিনি ২২ বছর ক্ষমতায় ছিলেন, বিরোধী জোটের নেতা হিসেবে সে দলেরই প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাককে ক্ষমতাচ্যুত করেন তিনি। ইব্রাহিমের সঙ্গে তাঁর দূরত্ব ঘুচিয়ে প্রতিশ্রতি দেন, জনতা তাঁকে ক্ষমতায় ফেরালে ইব্রাহিমের মুক্তির উদ্যোগ নেবেন তিনি স্বয়ং। ৯ই মে ভোটে জেতার পর কথা রেখেছেন মাহাথির। অবশেষে মুক্তি পেয়েছেন আনোয়ার ইব্রাহিম। রাজার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে ইব্রাহিম বলেন, ‘দেশে নতুন ভোর এসেছে। আমি জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে দেশবাসীকে ধন্যবাদ জানাতে চাই। জনতা যে দায়িত্ব আমাকে দিয়েছেন, আমি তা পূরণ করতে চাই।’ প্রধানমন্ত্রী হওয়ার উচ্চাশা কি তাঁর নেই? ইব্রাহিম বলেন, ‘আমি মাহাথিরকে সমর্থন জোগাতে চাই যাতে তিনি সংস্কারের কাজ শেষ করতে পারেন। এজন্য কোনো সময়সীমা বেঁধে দেয়ার দরকার নেই।

Please follow and like us:

Check Also

ঈদে স্ত্রীর জন্য মাংস কিনতে না পারায় দিনমজুর স্বামীর আত্মহত্যা

জামালপুরের বকশীগঞ্জে স্ত্রীর জন্য মাংস কিনতে না পেরে চিঠি লিখে আত্মহত্যা করেছেন হাসান আলী (২৬) …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।