রহমত মাগফিরাত নাজাতের মাস রমযান

মিয়া হোসেন : সময় মতো খাওয়া দাওয়া করা এবং সময় মতো নামায আদায় করাসহ সময়ের গুরুত্ব তুলে ধরেছে পবিত্র মাহে রমযান। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন পবিত্র রমযান মাসে মুসলমানদের জন্য জান্নাত নিশ্চিত করতে বেশ কিছু কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন। এ মাসে এসব কর্মসূচি পালনের মাধ্যমে জীবনকে একটি নিয়মানুবর্তীতার মধ্যে আনা সম্ভব। সারাদিন রোযা রেখে ইফতার করার পর ক্লান্তি আসে। এ ক্লান্তি দূর করার জন্য তারাবীহ’র নামাযের ব্যবস্থা করেছেন। সারা বিশ্বে এশার নামাযের সময় তারাবীহর নামায আদায় করা হয়ে থাকে। এ নামাজের গুরুত্ব সম্পর্কে হাদীস শরীফে অনেক বর্ণনা এসেছে।
সিহাহ সিত্তার প্রসিদ্ধ গ্রন্থ বুখারী ও মুসলিম শরীফে হযরত আবু হুরাইরা (রা.) হতে বর্ণিত হয়েছে, হযরত নবী করীম (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি রমযান মাসের রাত্রিতে ঈমান ও সতর্কতা, হিসাব-নিকাশের চেতনা সহকারে নামায আদায় করবে, তার পূর্বের যাবতীয় গুনাহ মাফ করে দেয়া হবে। হাদীসে উল্লেখিত ‘কিয়ামে রমযান’ দ্বারা তারাবীর নামায উদ্দেশ্য করা হয়েছে বলে অধিকাংশ মুহাদ্দিসীনদের মতামত। তারাবীহ অর্থ আরাম করা, বিশ্রাম করা। বিশেষ নামাযের নাম ‘তারাবীহ’ রাখা হয়েছে এ জন্য যে, এতে প্রতি চার রাকাত নামায অন্তর কিছুক্ষণ বসে বিশ্রাম গ্রহণ করা হয়। ফলে প্রতি চার রাকাত নামাযেরই নামকরণ করা হয়েছে ‘তারাবীহ’। তারাবীহ’র নামাযের নিয়ম সাহাবীদের কাজ দ্বারা জানা গেছে। তাই ঠিক যে সময়ে তারা উহা পড়েছেন, এর জন্য ইহাই সঠিক সময়। আর তারা উহা পড়েছেন এশার ফরয নামাযের পর বিতরের নামাযের পূর্বে। নবী করীম (সা.) এ নামায পড়েছেন। কিন্তু তিনি রীতিমতো প্রত্যেক রাতে পড়েন নাই। এর কারণ স্বরূপ তিনি নিজেই বলেছেন, “রাতের এই তারাবীহর নামায তোমাদের প্রতি ফরয হয়ে যাওয়ার ভয় করছি আমি।” তাঁর এই ভয়ের কারণ ছিল যে, “যেসব অ-ফরয কাজ নবী করীম (সা.) আল্লাহর নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে ও কাছাকাছি সময়ে স্থায়ীভাবে করেন, তাহাই তাঁর উম্মতের উপর ফরয করা হয়।” মহানবী (সা.)-এর যুগে ইহা মুসলমানগণ নিজস্বভাবে ও নিজ নিজ ঘরে বসে আদায় করতেন। মুহাদ্দিসগণের সম্মিলিত মতে ইহা মুস্তাহাব অর্থাৎ ইহা ফরয বা ওয়াজিব নহে। ইমাম শাফেয়ী, ইমাম আবু হানিফা, ইমাম আহমদ এবং মালিকী মাযহাবের কিছু ফিকাহবিদদের মতে, এ নামায জামায়াতের সাথে পড়া উত্তম। হযরত ওমর ফারুক (রা.) ও সাহাবাগণ (রা.) এ নামায জামায়াতের সাথে পড়েছেন এবং তারপর থেকে মুসলমান জাতি এ নামায এই নিয়মে পড়ে আসছে। ফলে ইহা ঈদের নামাযের ন্যায় মুসলমানদের জাতীয় অনুষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। কতক আলেমের মতে ইহা সুন্নাতে মুয়াক্কাদা। কেননা খুলাফায়ে রাশেদীন ইহা সর্বদা পড়তেন।
তারাবীহ নামাযের রাকাত সংখ্যা বিভিন্ন হাদীসে বিভিন্ন রকম উদ্ধৃত হয়েছে। সহীহ বুখারী ও মুসলিমে বিভিন্ন রকম বর্ণনা পাওয়া যায়। সায়েব ইবনে ইয়াযীদ হতে বায়হাকী বর্ণনা করেছেন, “আমরা (সাহাবাগণ) হযরত ওমরের (রা.) বিতরের নামাযসহ বিশ রাকাত নামায পড়তাম।” তাবরানী হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) হতে বর্ণনা করেছেন, “নবী করীম (সা.) রমযান মাসে বিতর ছাড়া বিশ রাকাত নামায পড়তেন। কিন্তু এ হাদীসদ্বয়ের সনদ দুর্বল। তবে হযরত মা আয়েশা (রা.) হতে বর্ণিত হাদীসে আট রাকাতের বর্ণনা পাওয়া যায়। তিনি বলেন, “নবী করীম (সা.) রমযান মাসে ও অন্যান্য সময়ের ফরয ছাড়া মোট এগার রাকাতের অধিক নামায (রাতের বেলা) পড়তেন না।” মুসনাদে আহমদে উদ্ধৃত হয়েছে হযরত আয়েশা (রা.) বলেন, “রাসূলে করীম রাত্রি বেলা আট রাকাত নামায পড়তেন, অত:পর বিতর পড়তেন। এরপর বসে বসে দুই রাকাত নামায পড়তেন।” ইমাম ইবনে তাইমিয়া বলেছেন, তারাবীহ নামাযের নির্দিষ্ট রাকাত সংখ্যা নবী (সা.) হতে প্রমাণিত হয়েছে বলে মনে করাই মূলগতভাবে ভুল। কেননা তিনি রাকায়াতের সংখ্যা বিশ বা আট নির্দিষ্ট করে যান নাই। বরং তাঁর ও সাহাবীদের থেকে বিভিন্ন সংখ্যা বর্ণিত হয়েছে।
এ পর্যায়ে ‘তারাবীহ নামায’ চালু হওয়ার ইতিহাস সংক্ষেপে আলোচিতব্য। হযরত আয়েশা (রা.) বর্ণনা করেছেন, নবী করীম (সা.) এক রাতে মসজিদে নামায পড়লেন। মাসটি ছিল রমযান। তখন অনেক লোক নামাযে তার সাথে শরীক হয়ে গেল। দ্বিতীয় রাতেও তিনি নামায পড়লেন। এবারও অনেক লোক তার সাথে শরীক হলো। পরে তৃতীয় রাতেও এরকম হলো। মসজিদে নামাযে অনেক লোক একত্রিত হয়ে গেল। চতুর্থ রাতে মসজিদে এতো লোকের সমাবেশ হয়ে গেল যে, “মসজিদে লোক সংকুলান না হওয়ার উপক্রম হল।” কিন্তু সে রাতে নবী করীম (সা.) ঘর হতে বের হলেন না। লোকেরা ‘নামায’ ‘নামায’ বলে অনেক ডাকাডাকি করলো। কিন্তু তাতেও তিনি বের হয়ে আসলেন না। রাত শেষ হলে ফজরের নামাযের পর নবী করীম (সা.) দাঁড়িয়ে সমবেত লোকদের সম্মুখে ভাষণ দিলেন। বললেন, “গত রাতে তোমাদের যে অবস্থা হয়েছিল, আমার নিকট উহা কিছুমাত্র গোপন নহে। কিন্তু আমি ভয় করছি যে উহা তোমাদের ওপর ফরজ করে দেয়া না হয়। কেননা ফরজ করে দেয়া হলে তোমরা ইহা আদায় করতে অক্ষম হয়ে পড়বে, যা করার সামর্থ্য তোমাদের হবে না।”
রমযানে দিনের বেলা একাধারে ১২-১৪ ঘণ্টা পর্যন্ত ক্ষুধার্ত পিপাসার্ত থাকার পর ইফতার করা ও পানাহার করা হলে শরীর এমনিতে নিঃশক্তি হয়ে ঢলে পড়তে চায়। তখন তারাবীহ নামায পড়া খুবই কষ্টকর। এরপরও যে তা আদায় করবে সে তো অনেক অনেক পুরস্কারের অধিকারী হবেই। নাসায়ী ও মুসনাদে আহমদ গ্রন্থে প্রসিদ্ধ সাহাবী হযরত আবদুর রহমান ইবনে আওফ (রা.) হতে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেছেন, হযরত রাসূলে মকবুল (সা.) বলেছেন, “নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালা রমযান মাসের রোজা থাকা তোমাদের জন্য ফরজ করে দিয়েছেন। আর আমি তোমাদের জন্য সুন্নাতরূপে চালু করেছি রমযান মাসব্যাপী আল্লাহর ইবাদতে দাঁড়ানো। কাজেই যে লোক এ মাসের রোজা পালন করবে আর আল্লাহর সামনে দাঁড়াবে ঈমান ও চেতনা সহকারে, সে তার গুনাহ হতে নিষ্কৃতি লাভ করে সেই দিনের মতো নিষ্পাপ হয়ে যাবে যেদিন তার মা তাকে প্রসব করেছিল।” হাদীসের ভাষায় ‘ওয়া ছানানতু লাকুম কিয়ামাহু’ দ্বারা তারাবীহ নামাযের চালুর ব্যাপারে বলা হয়েছে। হাদীসের ‘ঈমান’ অর্থ উহাকে সত্য বলে জানা এবং এর মর্যাদা ও ফজিলত সম্পর্কে পূর্ণ আস্থাবান ও বিশ্বাসী হওয়া। আর ‘ইহতিসাব’ অর্থ এর দ্বারা কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টি ও বিপুল সওয়াবের ইচ্ছা পোষণ করা, ইখলাসের বিপরীত লোক দেখানো কিংবা অন্য কোনো উদ্দেশ্যে এই কাজ না করা। ‘পূর্ববর্তী গুনাহ মাফ হয়ে যাবে’ বাহ্যত ইহাই মনে হয় যে, তারাবীহ নামায সঠিকভাবে পড়লে সগীরা ও কবীরা সব রকমের গুনাহই মাফ হয়ে যাবে। কিন্তু ইমামুল হারামাইনের মতে, কেবলমাত্র সগীরা গুনাহ্ই এর দ্বারা মাফ হবে, কবীরা গুনাহ নহে। তবে আল্লাহ চাহে তো সব গুনাহই মাফ হতে পারে।

Please follow and like us:

Check Also

ঢাকায় প্রথম মহিলাদের ঈদের জামাত

বাংলায় মুসলমান সমাজে নারীদের প্রতিকূলতার ইতিহাস অনস্বীকার্য। নারীদের শিক্ষা, চিকিৎসা, বিবাহ ও অন্যান্য ব্যাপারে ইসলামের …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।