গুহার অন্ধকার থেকে পৃথিবীর আলোয় ১২ কিশোর ও কোচ

ক্রাইমবার্তা রিপোট: ডেস্ক : অবশেষে অপেক্ষার অবসান। থাইল্যান্ডের ‘থাম লুয়াং নাং নন’ গুহার অন্ধকারে দীর্ঘ ১৭ দিন আটকে থাকার পর পৃথিবীর আলোয় এসেছে ১২ কিশোর ফুটবলার ও তাদের কোচ। তিন দিনের অভিযান শেষে ডুবুরি দলের সহায়তায় তাদের গুহা থেকে বের করে আনা হয়েছে।
উদ্ধারকারীরা জানিয়েছেন, সকলকেই নিরাপদে বের করে আনা হয়েছে।
রোববার গুহায় আটকে পড়াদের উদ্ধারে জোরালো অভিযান  শুরু হয়। রোববার প্রথম দফা অভিযানে চারজনকে ও সোমবার দ্বিতীয় দফায় আরো চার বালককে গুহা থেকে উদ্ধার করা সম্ভব হয়। মঙ্গলবার চার কিশোর ও কোচসহ পাঁচজনকে উদ্ধার করা হয়।
গতকাল মঙ্গলবার  স্থানীয় সময় সকাল ১০টা ৮ মিনেটে তৃতীয় দফা অভিযান শুরু হয় বলে উদ্ধার চলাকালীন সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছেন, দলের নেতা নারংসাক ওস্তানকর্ন। থাই নেভি সিলের এক ফেসবুক বার্তায় জানান হয়েছিল, গত দুই দিনের চেয়ে আজকের(মঙ্গলবার) অভিযানটি শেষ হতে বেশি সময় লাগবে।
এদিকে, রোববার প্রথম দফায় উদ্ধার হওয়া ৪ বালককে কাচের জানালায় তাদের পরিবার দেখতে পেয়েছে। কোন ধরনের সংক্রমণের আশংকায় তাদের একেবারে আলাদা করে রাখা হয়েছে। বালকদের নিউমোনিয়ার লক্ষণ দেখা দিয়েছে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। তাদেরকে সপ্তাহখানেক নিবিড় চিকিৎসায় রাখা হতে পারে।
উল্লেখ্য, গত ২৩ জুন ওয়াইল্ড বোয়ার নামের থাই ফুটবল দলটির সদস্যরা উত্তর থাইল্যান্ডের চিয়াং রাই এলাকায় অবস্থিত ‘থাম লুয়াং নাং নন’ গুহায় আটকা পড়ে। ঘটনার নয় দিন পর (২ জুলাই) দুজন ব্রিটিশ ডুবুরি তাদের খুঁজে পান।
গুহাটি বৃষ্টির পানিতে পূর্ণ হয়ে যাওয়ায় আটকে পড়া বালকদের উদ্ধার করা সম্ভব হচ্ছিলো না। তবে গুহায় পানি আরও বাড়তে পারে এমন আশংকায় উদ্ধার কাজ শুরু করা হয়। অভিযানে ৪০ জন থাই ডুবুরি ও ৫০ জন আন্তর্জাতিক ডুবুরিরা অংশ  নেন।
অভিযানে একমাত্র মৃত্যুর ঘটনা থাই নৌবাহিনীর সাবেক ডুবুরি সামান কুনান। নেভি সিলের অবসরপ্রাপ্ত এই সদস্য অক্সিজেন-স্বল্পতায় মারা যান।
যেভাবে গুহার ভেতর ১৩ জন : গত ২৩ জুন শনিবার ১২ কিশোর ফুটবলার তাদের টিমের কোচসহ গুহার ভেতরে গিয়েছিল। বিবিসির থাই সার্ভিস জানায়, কিশোররা ফুটবল প্র্যাকটিস করতে সকাল ১০টার দিকে ন্যাশনাল পার্কে যায়। তারপর তাদের সহকারী কোচ একাপোল ফেসবুকে একটি লাইভ ভিডিও পোস্ট করেছিলেন সকাল ১০টা ৪২ মিনিটে। থাম লুযাং-খুনাম নাঙ্গনন ন্যাশনাল পার্কের একজন কর্মী দুপুর তিনটার দিকে লক্ষ্য করেন যে, গুহার প্রবেশমুখের সামনে ১১টি সাইকেল রাখা আছে। তখন তারা অনুসন্ধান করতে শুরু করেন। ওই কিশোরদের একজনের মা-বাবাও ন্যাশনাল পার্কের কর্মকর্তাদের জানান, তারাও তাদের ছেলের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছেন না।
পরের দিন ২৪ জুন, শনিবার পার হয়ে রোববার সকাল একটা থেকে তাদের খোঁজার কাজ শুরু হয়। শনিবার রাতে সেখানকার পুলিশকে শিশুদের নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার বিষয়ে অবহিত করার পর এই অনুসন্ধান শুরু হয়। ৯ দিন পর তাদের সন্ধান পাওয়া যায়।
যেভাবে আটকা পড়ে ভেতরে : স্থানীয় সংবাদমাধ্যমে বলা হচ্ছে, ফুটবল দলটি গুহার ভেতর ঢোকার পর থেকেই প্রচুর বৃষ্টি হতে শুরু করে। সেখানে জমে যাওয়া জঙ্গলের পানিও ঢুকে যায় গুহার ভেতরে। পানি এত বেড়ে যায় যে, এক পর্যায়ে বন্ধ হয়ে যায় গুহায় প্রবেশের মুখও। গুহার ভেতরে পানির উচ্চতা খুব দ্রুত বেড়ে গেলে কোচসহ কিশোর ফুটবলাররা ভেতরে আটকা পড়ে। আরও উঁচু জায়গা খুঁজতে খুঁজতে তারা চলে যায় গুহার আরও গভীরে। এই থাম লুয়াং গুহা ১০ হাজার ৩১৬ মিটার লম্বা এবং থাইল্যান্ডে যত গুহা আছে দৈর্ঘ্যরে বিচারে এটি চতুর্থ।
ভূতুড়ে গুহা : থাইল্যান্ডের যে গুহায় দেশটির ১২ ক্ষুদে ফুটবলার ও তাদের কোচ আটকা পড়েছে সেটি নিয়ে স্থানীয় লোকজনের মুখে মুখে অনেক গল্প চালু আছে। একটি গল্পে বলা হয়েছে এর নাম কীভাবে ‘থাম লুযাং- খুন নাম নাং নন’ হলো? এর অর্থ হলো  ‘পাহাড়ের ভেতরে বিশাল এই গুহায় ঘুমিয়ে আছেন একজন নারী। তার রক্ত থেকে এই পাহাড়েই জন্ম হয়েছে এক নদীর।’ গল্পটিতে বলা হয়েছে, যে দক্ষিণ চীনের চিয়াং রুং শহরের এক রাজকন্যা একজন অশ্বারোহী পুরুষের সাথে সম্পর্কের পর গর্ভবতী হয়ে পড়েন। তারা তখন সমাজের ভয়ে ভীত হয়ে শহর থেকে পালিয়ে দক্ষিণের দিকে চলে আসেন। যখন তারা এই পাহাড়ি এলাকায় এসে পৌঁছান তখন রাজকন্যার স্বামী তাকে বলেন সেখানে বিশ্রাম নিতে। স্বামী তখন খাবারের সন্ধানে বের হয়ে যান। তখন রাজকন্যার পিতার লোকেরা তাকে দেখতে পায় এবং তাকে হত্যা করে।
রাজকন্যা সেখানে কয়েকদিন অবস্থান করে তার স্বামীর জন্যে অপেক্ষা করতে থাকে। তিনি যখন নিশ্চিত হন যে তার স্বামী আর ফিরে আসবে না তখন তিনি তার চুলের একটি ক্লিপ নিজের পেটের ভেতরে ঢুকিয়ে দেন। তারপর তার মৃতদেহ তখন একটি পর্বতে পরিণত হয় এবং তার শরীর থেকে যে রক্ত ঝরেছিল সেটা প্রবাহিত হয়ে ‘নাম মায়ে সাই’ নামের এক নদীর জন্ম হয়।
অতীতে হারিয়েছিল যারা : স্থানীয় থাই সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুসারে, স্থানীয় বান জং গ্রামের একজন নেতা বলেছেন, ১৯৮৬ সালে এই গুহার ভেতরে একজন বিদেশী পর্যটক নিখোঁজ হয়ে গিয়েছিলেন। সাতদিন নিখোঁজ থাকার পর তাকে নিরাপদে অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছিল। কিন্তু সে সময় কোন বন্যা ছিল না বলে তিনি জানিয়েছেন। চীনের একটি বিশ্ববিদ্যালযরে একজন শিক্ষকও ২০১৬ সালের আগস্ট মাসে ওই গুহার ভেতরে নিখোঁজ হয়ে গিয়েছিলেন বলে বলা হচ্ছে। তিন মাস তার কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি।
চীনা ওই শিক্ষক ন্যাশনাল পার্কের একটি দোকানে তার সাইকেল জমা রেখে দোকানদারকে বলেছিলেন তিনি মেডিটেশন বা ধ্যান করার জন্যে গুহার ভেতরে যাচ্ছেন। তখন তার খোঁজে তল্লাশি অভিযান শুরু হয়েছিল। গুহার ভেতরে তাকে পাওয়া না গেলেও তিন মাস পর তাকে পাশের একটি অবকাশ কেন্দ্রে পাওয়া যায়।

Check Also

মালয়েশিয়ার পাম তেলে ইইউ’র নিষেধাজ্ঞা বাংলাদেশের শ্রমবাজারে অশনি সংকেত

বন উজাড়, কার্বন নির্গমনের ঝুঁকি এবং পরিবেশের ভারসাম্য নষ্টগত কারণ দেখিয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ মালয়েশিয়ার …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।