হাতুড়ির জ্ঞান পেরেকের ওপর, ছাত্রের ওপর নয়

# ঢাবিতে নিরাপদ ক্যাম্পাসের দাবিতে মানববন্ধন
# মশিউরের মুক্তির দাবিতে শ্রেণীকক্ষে তালা
স্টাফ রিপোর্টার : নিরাপদ ক্যাম্পাস ও কোটা সংস্কার আন্দোলনের নেতাদের অবিলম্বে মুক্তির দাবিতে মানববন্ধন করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। তারা বলছে, একটি ছাত্র সংগঠন কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের ওপর যে নৃশংস হামলা করেছে, তার বিচার দাবি করছি। এ দিকে কোটা সংস্কার আন্দোলনের কর্মী মশিউর রহমানকে অবিলম্বে মুক্তি দেওয়ার দাবিতে ক্লাস বর্জন কর্মসূচিতে থাকা তার সহপাঠীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের কয়েকটি শ্রেণীকক্ষে তালা লাগিয়ে দিয়েছে। আগামী রোববারের মধ্যে মশিউরের মুক্তি না হলে আবার রাস্তায় নামার পরিকল্পনার কথাও বলেছেন তারা।
গতকাল বুধবার দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের মোকাররম ভবনের সামনে শিক্ষার্থীদের মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়। মানববন্ধনে শিক্ষার্থীরা বলেন, ক্যাম্পাসে যেসব হামলা হয়েছে আমরা সব হামলার নিন্দা জানাচ্ছি। বিশেষ করে কেন্দ্রীয় লাইব্রেরী, শহীদ মিনারে একটি ছাত্র সংগঠন কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের ওপর যে নৃশংস হামলা করেছে, তার বিচার দাবি করছি। একইসঙ্গে আমরা ক্যাম্পাসে নিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।
মানববন্ধনে শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন লেখা সম্বলিত প্ল্যাকার্ড প্রদর্শন করেন। এতে লেখা ছিল-‘হাতুড়ির জ্ঞান  পেরেকের ওপর, ছাত্রের ওপর নয়’; ‘আমার ক্যাম্পাসে আমি নিরাপদ তো?’; ‘ছাত্রের দায় নিবেন না কেন?’; ‘ছাত্র হয়রানি বন্ধ কর’; ‘আমাদের ক্যাম্পাস আমাদের ঘর’; ‘এখানে কেন আমরা পর’ ইত্যাদি।
মানববন্ধনে উপস্থিত ছিলেন গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ড. ফাহমিদুল হক। তিনি বলেন, আমরা শুরু থেকে শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলনকে সমর্থন করে আসছি। কারণ এই আন্দোলন একটি যৌক্তিক আন্দোলন। কিন্তু আমরা তখনি শিক্ষার্থীদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছি, যখন কেবল শিক্ষার্থীরা নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। আজকে অনেক শিক্ষকের শিক্ষার্থীদের পাশে এসে দাঁড়ানোর কথা ছিল। কিন্তু তারাও নানা ভয়ের কারণে আসতে পারছেন না। এখানে একটি বিষয় বলা দরকার, যারা আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা চালিয়েছে, তাদের বিচার না করে উল্টো যারা নির্যাতন-নিপীড়ন ও হামলার শিকার হয়েছেন, তাদেরকে রিমান্ডে দেওয়া হয়েছে। এটা কেমন বিচার? আমরা ছাত্রদের মুক্তিরও দাবি করছি।
মানববন্ধনে সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক সামিনা লুৎফা বলেন, রাষ্ট্র যেভাবে হুকুম দিচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ঠিক সেভাবেই কাজ করছে। যখন কোটা সংস্কার আন্দোলনকে সরকার বলছে যৌক্তিক, ঠিক তখনি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনও বলছে যৌক্তিক। এটা কেমন প্রশাসন। শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার বিচার করতে প্রশাসন তৎপর নয়। তারা রাষ্ট্রের ইচ্ছা বাস্তবায়ন করতে ব্যস্ত । যেসব শিক্ষার্থী আজ নিপীড়নের শিকার তারাই আবার রিমান্ডে নির্যাতন ভোগ করছে। আমরা গ্রেফতার সব শিক্ষার্থীর নিঃশর্ত মুক্তির দাবি করছি।
মানববন্ধনে উপস্থিত ছিলেন– গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ড. গীতি আরা নাসরীন, আর্ন্তজাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক তামজীম উদ্দিন খান, অর্থনীতি বিভাগের সহকারী শিক্ষক ড. রুশাদ ফরিদীসহ আরোও অনেকে।
মশিউরের মুক্তির দাবিতে শ্রেণীকক্ষে তালা: কোটা সংস্কার আন্দোলনের কর্মী মশিউর রহমানকে অবিলম্বে মুক্তি দেওয়ার দাবিতে ক্লাস বর্জন কর্মসূচিতে থাকা তার সহপাঠীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের কয়েকটি শ্রেণীকক্ষে তালা লাগিয়ে দিয়েছে। আগামী রোববারের মধ্যে মশিউরের মুক্তি না হলে আবার রাস্তায় নামার পরিকল্পনার কথাও বলেছেন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা।
সমাজবিজ্ঞান বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী মশিউর কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরত বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের যুগ্ম-আহ্বায়ক। ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা গত ৩০ জুন সূর্যসেন হল থেকে মশিউরকে পুলিশে সোপর্দ করে। পুলিশ প্রথমে সেটা অস্বীকার করলেও পরে তাকে গ্রেপ্তারের কথা জানায়।
এরপর ৫ জুলাই অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে এক মানববন্ধন থেকে ক্লাস বর্জনের ঘোষণা দেন মশিউরের সহপাঠীরা। এর ধারাবাহিকতায় গতকাল  সকালে সামাজিক বিজ্ঞান ভবনের ৫১৪, ৫১৫, ৫১৬, ৫১৭ নম্বর কক্ষে তালা ঝুলিয়ে দেন তারা।
শিক্ষার্থীরা বলছেন, মশিউর আমাদের বন্ধু। অন্যায়ভাবে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। কয়েকদিন ধরে আমরা ক্লাস বর্জন করছি। সকালে এসে ক্লাসরুমে তালা ঝুলিয়ে দিয়েছে আমাদের বিভাগের শিক্ষার্থীরা। রোববারের মধ্যে তাকে মুক্তি না দিলে আবার হয়তো রাস্তায় নামব আমরা।
শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলনের বিষয়ে প্রশ্ন করলে সমাজবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক নেহাল করিম বলেন, ক্লাস করবে কি করবে না সেটা শিক্ষার্থীদের ইচ্ছা। আমরা তো তাদের মত প্রকাশে বাধা দিতে পারি না। তিনি বলেন, মশিউরের মুক্তির বিষয়টি বিশ্ববিদ্যালয় দেখবে। কারণ সে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। সে তো একটা ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে সব নিয়ম সম্পন্ন করে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছে। তার বিষয়টি তাদেরই দেখার কথা। আমি শিক্ষার্থীদের বলেছি, তাদের কী কী দাবি আছে তা আমার কাছে লিখিতভাবে দিতে, আমি সেগুলো প্রক্টরের কাছে পাঠাব।
বহিরাগত ইস্যুতে কর্তৃপক্ষের ইউটার্ন: ‘বহিরাগতরা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ/প্রক্টরের পূর্বানুমতি ছাড়া ক্যাম্পাসে অবস্থান ও ঘোরাফেরা এবং কোনো ধরনের কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারবে না’ বলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যে ঘোষণা দিয়েছিল তা অস্বীকার করে নতুন আরেকটি বিবৃতি দেয়া হয়েছে। বুধবার গণমাধ্যমে পাঠানো বিবৃতিতে দাবি করা হয়, গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে খ-িতভাবে তথ্য প্রচার করা হয়েছে।
বিবৃতিতে বলা হয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভোস্ট কমিটির সিদ্ধান্তের বিষয়ে দেশের কিছু গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে খ-িতভাবে তথ্য প্রচারের ফলে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে কাউকে প্রবেশ বা গমনাগমনে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয় নাই। বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রচারের মাধ্যমে অশুভ শক্তিকে উৎসাহিত না করার জন্য সংশ্লিষ্ট সকলকে অনুরোধ জানানো যাচ্ছে।
আরও বলা হয়, যেসব সিদ্ধান্ত ও পদক্ষেপের কথা প্রভোস্ট কমিটি বলেছে সেগুলো ঐতিহ্যবাহী এ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রচলিত রীতি-নীতি ও সিদ্ধান্তের আলোকে নেয়া হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে সভা-সমাবেশসহ যে কোনো ধরনের কর্মসূচী পালনের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের পূর্বানুমতি আবশ্যক হয়, এটা নতুন কিছু নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশ পথে সব সময়েই পূর্বের ন্যায়
বর্তমানেও নিরাপত্তা প্রহরী দায়িত্ব পালন করছে। তাদের দায়িত্ব পালনের অনুকূল কর্ম-পরিবেশ তৈরি করা প্রয়োজন। নিরাপত্তা প্রহরীদের দায়িত্ব ও কর্মদক্ষতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে কর্তৃপক্ষ মাঝে মধ্যে বিভিন্ন দিক-নির্দেশনা প্রদান করে থাকেন। বর্তমান পদক্ষেপ তার অংশ মাত্র।
এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য একটি পরিচ্ছন্ন ও নিরাপদ ক্যাম্পাস পরিচালনার লক্ষ্যে যা করণীয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তা করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ উল্লেখ করে এ বিষয়ে সকলের সহযোগিতা কামনা করেছে ঢাবি কর্তৃপক্ষ।
উল্লেখ্য, গত ৯ জুলাই পাঠানো বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস শুধুমাত্র এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য উন্মুক্ত। এখানে বহিরাগতরা বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ/প্রক্টরের পূর্বানুমতি ছাড়া ক্যাম্পাসে অবস্থান ও ঘোরাফেরা এবং কোনো ধরনের কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারবে না। প্রয়োজনে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহায়তা নেবেন।

Please follow and like us:

Check Also

কারিগরি বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যানকে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে যা বললেন ডিবির হারুন

ভুয়া সনদ সরবরাহে জড়িত থাকার অভিযোগে কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যানের পদ থেকে সদ্য অব্যাহতি পাওয়া …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।