দেশজুড়ে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ অব্যাহত ফের হামলা, শতাধিক আহত,৯ থানায় ২৮ মামলা, গ্রেফতার ১৪,আজও রাজপথে নামার ঘোষণা

  দেশজুড়ে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ অব্যাহত,ফের হামলা, শতাধিক আহত,ধানমণ্ডি-সায়েন্স ল্যাবরেটরি-এলিফ্যান্ট রোডে সংঘর্ষ, গুলি, টিয়ার শেল * ৯ থানায় ২৮ মামলা, গ্রেফতার ১৪ * অঘোষিত পরিবহন ধর্মঘটে দুর্ভোগ, ৩ দিন ধরে বন্ধ দূরপাল্লার বাস * সাংবাদিকদের মারধর, গাড়ি-ক্যামেরা ভাংচুর * আজও রাজপথে নামার ঘোষণা

ক্রাইমবার্তা  ডেস্ক রিপোট  নৌমন্ত্রী শাজাহান খানের পদত্যাগ এবং নিহত দুই শিক্ষার্থীর ঘাতক বাসচালকের ফাঁসিসহ ৯ দফা দাবিতে গড়ে ওঠা শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ঘিরে রোববারও নানা সহিংস ঘটনা ঘটেছে। ঢাকাসহ প্রায় সারা দেশেই অষ্টম দিনেও অব্যাহত ছিল তাদের বিক্ষোভ। রাজধানীর ঝিগাতলা-ধানমণ্ডি, সায়েন্স ল্যাবরেটরি, এলিফ্যান্ট রোড এলাকায় আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা চালায় পুলিশ ও সশস্ত্র যুবকরা। পৌনে ২ ঘণ্টাব্যাপী এ সংঘর্ষে উভয়পক্ষের মধ্যে দফায় দফায় ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া চলে। এ সময় গোটা এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। আশপাশের এলাকায়ও এর রেশ ছড়িয়ে পড়ে। সাধারণ পথচারী ও দোকানদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। দোকানপাট ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়।

রাজধানীর বিভিন্ন ঘটনায় এদিন সাংবাদিক, পুলিশ, পথচারীসহ শতাধিক আহত হয়েছেন। আহতদের মধ্যে ২৮ জনের অবস্থা গুরুতর। তাদের মধ্যে কয়েকজনকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও পপুলার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। শনিবারও ধানমণ্ডি-ঝিগাতলায় শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা হয়েছিল। এ নিয়ে দু’দিনে আহতের সংখ্যা দাঁড়াল দু’শতাধিক। গত কয়েকদিনের ঘটনায় রাজধানীর ৯ থানায় ২৮টি মামলা হয়েছে। গ্রেফতার করা হয়েছে ১৪ জনকে।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, রোববার দুপুরে সায়েন্স ল্যাবরেটরি এলাকায় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে অংশ নেয়া হেলমেট পরা যুবকদের হাতে পিস্তল, রামদা, কিরিচ ও লাঠিসোটা দেখা গেছে। এ সময় ফাঁকা গুলি বর্ষণের ঘটনাও ঘটেছে। ঘটনার সময় দায়িত্ব পালনরত সাংবাদিকদেরও মারধর করে ওই যুবকরা। তখন গণমাধ্যমের কয়েকটি গাড়ি, ক্যামেরা ও মোবাইল ফোন ভাংচুর করা হয়। পুলিশ বিক্ষোভকারীদের ওপর নির্বিচারে লাঠিচার্জ করে। পাশাপাশি ৩০-৩৫ রাউন্ড টিয়ার শেল নিক্ষেপ করে। যদিও ১৫ রাউন্ড টিয়ার শেল নিক্ষেপের কথা স্বীকার করেছে পুলিশ। এদিন রাজধানীর উত্তরা, ফার্মগেট, রামপুরা, মিরপুর, প্রগতি সরণিসহ রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে আন্দোলনকারীরা অবস্থান নেয়। এর মধ্যে উত্তরায়ও ধাওয়া-পাল্টাধাওয়ার ঘটনা ঘটে। ফার্মগেটেও শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার অভিযোগ পাওয়া গেছে। রামপুরায় আওয়ামী লীগ মিছিল বের করলে শিক্ষার্থীরা ধাওয়া দেয়। মিরপুরে শিক্ষার্থীদের মিছিলে পুলিশ-শ্রমিক বাধা দেয়। আগের ৭ দিন রাজপথে থাকা শিক্ষার্থীদের বেশিরভাগ ছিল স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী। কিন্তু অষ্টম দিনে আন্দোলনে নামা শিক্ষার্থীদের অধিকাংশই ছিল সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। তাদের কারও কারও হাতে লাঠিসোটা ও রড ছিল।

ঢাকার বাইরে বিভিন্ন শহরেও শিক্ষার্থীরা এদিন আন্দোলনে নামে। বিক্ষোভ করেছেন- রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, বরেন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়, হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এবং শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। এছাড়া হবিগঞ্জ, ভোলা, নরসিংদী, টাঙ্গাইল, চুয়াডাঙ্গা, গৌরীপুর, দশমিনাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ হয়েছে। এর মধ্যে ময়মনসিংহে শ্রমিকদের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের ধাওয়া-পাল্টাধাওয়ার ঘটনা ঘটে। যাত্রাবাড়ী-কাঁচপুর মহাসড়কে পুলিশ ভ্যানে শিক্ষার্থীরা হামলা চালায়। এতে দুই পুলিশ সদস্য আহত হন। চট্টগ্রামে আন্দোলন শেষে শিক্ষার্থীরা ক্লাসে ফিরে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। তবে ঢাকায় বিভিন্ন স্থানে আজও রাজপথে নামার ঘোষণা দিয়েছে শিক্ষার্থীরা। ২৯ জুলাই রাজধানীর বিমানবন্দর রোডে সড়ক দুর্ঘটনায় দুই শিক্ষার্থী নিহত ও কয়েকজন আহত হয়। ঘটনার পর থেকে শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে আছে। ২ আগস্ট ওই আন্দোলন ঢাকার বাইরে বিভিন্ন শহরে ছড়িয়ে পড়ে। ৮ দিনের আন্দোলনে রাজধানীর স্বাভাবিক যান চলাচল বিঘ্নিত হয়। বিশেষ করে ২ আগস্টের পর শিক্ষার্থীরা নগরীর বিভিন্ন পয়েন্ট দখল করে অবস্থান নিলে গোটা রাজধানী অচল হয়ে পড়ে। সেই ধারা রোববারও অব্যাহত ছিল। এদিনও রাজধানীর গণপরিবহন চলাচল করেনি। মালিক-শ্রমিকরা অঘোষিত ধর্মঘট পালন করেন। দেশের অন্যান্য শহর থেকে ঢাকামুখী দূরপাল্লার বাস পরিবহন তৃতীয় দিনের মতো বন্ধ ছিল। ফলে সড়কপথে দেশের অন্য শহর থেকে রাজধানী কার্যত বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। ঢাকায় গণপরিবহন না থাকায় এবং দূলপাল্লার বাস চলাচল না করায় চরম ভোগান্তিতে পড়েন সাধারণ মানুষ। হেঁটে গন্তব্যে পৌঁছান নারী-শিশু-বৃদ্ধসহ বিভিন্ন বয়সী মানুষ। তবে বেশি ভোগান্তিতে পড়েন রোগী ও বিদেশগামীরা।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রোববার গণভবনে এক অনুষ্ঠানে বক্তৃতাকালে শিক্ষার্থীদের ক্লাসে ফিরে যাওয়ার আহ্বান জানান। তিনি শিক্ষক ও অভিভাবকদের অনুরোধ জানিয়ে বলেন, তারা গত কয়েক দিন যা করেছে, তাতে বাধা দেয়া হয়নি। কারণ তাদের অনুভূতি-সেন্টিমেন্ট আমরা বুঝতে পারি। প্রধানমন্ত্রী ছাত্রছাত্রীদের নিরাপত্তার স্বার্থে রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে স্কুল-কলেজে পাঠাতে অভিভাবকদের অনুরোধ করেন।

সরকারের কয়েকজন মন্ত্রী এদিনও শিক্ষার্থীদের ক্লাসে ফিরে যাওয়ার আহ্বান জানান। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল একটু কঠোর ভাষায় বলেন, ধৈর্যের সীমা আছে। সেটা অতিক্রম করলেই ব্যবস্থা নেয়া হবে। শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে বলেন, তোমাদের বিজয় হয়েছে। উদ্দেশ্য সফল হয়েছে। সরকার দাবি মেনে নিয়েছে। দ্রুততার সঙ্গে তা বাস্তবায়ন করা হবে। বিজয় ধরে রাখতে এখন তোমাদের ক্লাসে ফিরে যেতে হবে। নইলে অর্জন নষ্ট হবে। রাজপথে থাকা শিক্ষার্থীদের ক্লাসে ফিরিয়ে নিতে করণীয় নির্ধারণে তিনি এদিন রাজধানীর বিভিন্ন স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের নিয়ে বৈঠক করেন।

আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের এসব ঘটনার জন্য মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও বিএনপিকে দায়ী করেন। অন্যদিকে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, যৌক্তিক আন্দোলনকে নস্যাৎ করতে সরকার সুপরিকল্পিতভাবে বিএনপিকে জড়িয়ে মিথ্যা বলছে।

আগের সাত দিনের ধারাবাহিকতায় রোববার সকাল থেকেই রাস্তায় নেমে আসে শিক্ষার্থীরা। স্কুল-কলেজের পোশাক ও আইডি কার্ড নিয়ে রাস্তা অবরোধ করে। তবে কারও কারও গলায় তা ছিল না। সকালের বৃষ্টি, দুপুরের ভ্যাপসা গরম উপেক্ষা করে সারা দেশে শিক্ষার্থীরা অষ্টম দিনের মতো এ আন্দোলনে অংশ নিয়ে সড়কে অবস্থান নেয়। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা যানবাহন বন্ধ না করে রাজধানীজুড়ে শৃঙ্খল ও লেন অনুসরণ করে গাড়ি চলাচলে সহায়তা করে। পাশাপাশি লাইসেন্স যাচাই-বাছাই করেছে। ঢাকায় এ কাজে শিক্ষার্থীদের সহায়তা করেছে ডিএমপির বিভিন্ন বিভাগের ট্রাফিক পুলিশ।

রাজধানীর কিছু স্থানে সকাল থেকে এভাবে শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি চললেও শাহবাগ, ধানমণ্ডি, সায়েন্স ল্যাবরেটরি, উত্তরা, মিরপুর, প্রগতি সরণি ও রামপুরা ব্রিজ এলাকায় বেলা ১১টার পর থেকে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হতে থাকে। বিশেষ করে জিগাতলা এলাকার ঘটনার খবর ছড়িয়ে পড়লে শিক্ষার্থীরা মারমুখী হয়ে ওঠে। রাজধানীর বিভিন্ন পয়েন্টে অবস্থান নেয়া শিক্ষার্থীদের হাতে হাতে উঠে আসে লাঠি, রড। অবস্থানস্থলের আশপাশে তারা যা পেয়েছে, তাই হাতে তুলে নিয়েছে। প্রথম থেকে নয় দফা দাবি তোলা হলেও বিভিন্ন স্থানে রোববার তা তিন দফায় নেমে আসার স্লোগান শোনা যায়। এগুলো হচ্ছে- শাজাহান খানের পদত্যাগ, নিরাপদ সড়ক এবং শনিবার ধানমণ্ডিতে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলাকারীদের বিচার।

জানা গেছে, আহতদের মধ্যে ১৫ জনকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হয়। তাদের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নুসরাত জাহান, সুস্মিতা রয়েল লিসা, মারুফ, তুষার, শিমন্তী, বুয়েটের রাকিন, ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটির এনামুল হক ও তামিমের নাম জানা গেছে।

শাহবাগ থেকে মিছিল ও সংঘর্ষ : বেলা সাড়ে ১১টার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একটি মিছিল বের হয়। সেটি শাহবাগে আসে। বেলা ১২টা ২০ মিনিটে শাহবাগ থেকে সায়েন্স ল্যাবরেটরির উদ্দেশে বিক্ষোভ মিছিল শুরু হয়। মিছিলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছাড়াও বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ, স্কুলের কয়েক হাজার শিক্ষার্থী অংশ নেয়। মিছিলটি ১২টা ৪০ মিনিটে সায়েন্স ল্যাবরেটরিতে পৌঁছায়। সেখানে আগে থেকে অবস্থান করতে থাকা বিভিন্ন স্কুলের শিক্ষার্থীরা স্বাগত জানিয়ে বিক্ষোভে অংশ নেয়। মিছিলটি যখন সায়েন্স ল্যাবে পৌঁছায়, তখনও এর শেষ মাথা ছিল শাহবাগ মোড়ে। মিছিলকারীরা সায়েন্স ল্যাবরেটরিতে কিছু সময় অবস্থান নেয়। পরে ১২টা ৪৫ মিনিটে মিছিলটি জিগাতলার দিকে রওনা দেয়। কিছু পরে মিছিলটি আওয়ামী লীগের ধানমণ্ডির দলীয় অফিসের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করলে পুলিশ আন্দোলনকারীদের ওপর টিয়ার শেল ছোড়ে। জবাবে শিক্ষার্থীরা পুলিশকে লক্ষ করে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে। এভাবে শুরু হয় সংঘর্ষ। আন্দোলনকারীদের অভিযোগ, পুলিশের সঙ্গে ছাত্রলীগ-যুবলীগের নেতাকর্মীরাও তাদেরও ওপর হামলা চালায়। ওইসব যুবককে সকাল থেকে ধানমণ্ডি ও সায়েন্স ল্যাবরেটরি এলাকায় মোটরসাইকেল নিয়ে মহড়া দিতে দেখা গিয়েছিল। তিন পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ, ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া, পুলিশের টিয়ার শেল নিক্ষেপের মধ্য দিয়ে টানা পৌনে দু’ঘণ্টা ধানমণ্ডির সিটি কলেজ মোড় এবং এলিফ্যান্ট রোড এলাকা অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। পুলিশের সঙ্গে থাকা যুবকদের লাঠির আঘাতে এ সময় কয়েকজন সাধারণ মানুষ আহত হন। বাণিজ্য বিপণির অন্যতম কেন্দ্র এলিফ্যান্ট ও নিউমার্কেটের দোকানপাট, মার্কেট সব বন্ধ হয়ে যায়। মাকের্টের ভেতর আটকে পড়ে অনেক সাধারণ মানুষ। এ সময় সিটি কলেজ পয়েন্ট আটকে থাকায় মিরপুর থেকে মতিঝিলমুখী কোনো পরিবহন চলাচল করতে পারেনি।

এরপর দুপুর দেড়টার দিকে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা পিছু হটে অবস্থান নেয় এলিফ্যান্ট রোডের মাঝামাঝি স্থানে। অপরদিকে সায়েন্স ল্যাবরেটরি মোড়ে অবস্থান নেয় পুলিশ। আন্দোলনরত শিক্ষার্থী ও পুলিশ মুখোমুখি অবস্থান করে। এ সময় ঢাকা কলেজের দিক থেকে অনেক যুবক হেলমেট পরে, হাতে লাঠি, রড নিয়ে যোগ দেয় পুলিশের সঙ্গে। এরপর এলিফ্যান্ট রোডে অবস্থানরত ছাত্রদের ধাওয়া দেয় পুলিশ ও যুবকরা। এ সময় প্রকাশ্যে অস্ত্র বের করে কয়েকজন যুবক গুলিবর্ষণ করে বলেও জানায় প্রত্যক্ষদর্শীরা। তবে সংঘর্ষের এক পর্যায়ে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা পুলিশ ও যুবকদের ধাওয়া করে। এর কিছুক্ষণ পর পাল্টা পুলিশ ধাওয়া করে। এক পর্যায়ে আন্দোলনরত ছাত্ররা এলিফ্যান্ট রোড থেকে আরও কিছু পিছু হটে। এ সময় শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য করে পুলিশ কয়েক রাউন্ড টিয়ারসেল নিক্ষেপ করে। এতে পুরো এলিফ্যান্ট যেন রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। পুলিশ ও ছাত্রদের এই সংঘর্ষ আশপাশের মার্কেটের ভবন থেকে উৎসুক জনতা দেখতে থাকে।

পৌনে ৩টার দিকে এক পর্যায়ে ছাত্রদের পিছু হটিয়ে এলিফ্যান্ট রোড দখলে নেয় পুলিশ ও যুবকরা। পরবর্তীতে সেখান থেকে টিয়ারগ্যাস ও ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে বাটা সিগন্যাল পর্যন্ত দখলে নেয়া হয়। পুলিশের সঙ্গে যোগ দেয়া যুবকরা পরে বাটা সিগন্যাল থেকে হাতিরপুল বাজারের রাস্তা পর্যন্ত মিছিল করে।

এদিকে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা দাবি করেন, মিছিলটি যখন বিজিবি গেট হয়ে সায়েন্স ল্যাবরেটরির দিকে ফিরে যাচ্ছিল পুলিশ তখন কোনো প্রকার উসকানি ছাড়া টিয়ারসেল মারে। অজ্ঞাত যুবকরা তাদের ওপর গুলিবর্ষণ করে। এতে কমপক্ষে ৪০ জন আহত হন।

পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে রমনা বিভাগ (ধানমণ্ডি জোন) অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মো. আবদুল্লাহিল কাফী  বলেন, আমরা জানতে পারি শাহবাগ থেকে বাম ছাত্রসংগঠন, কোটা আন্দোলনকারী এবং ছাত্ররা একত্রে মিছিল সহকারে আসছে। এরপরও আমরা তাদেরকে বাধা দেইনি, মিছিলটি যখন সায়েন্স ল্যাবরেটরি হয়ে আসে তাতেও বাধা দেয়া হয়নি। তারা যখন আওয়ামী লীগের পার্টি অফিসের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করে তখন আমরা সড়কে অবস্থান নেই। এ সময় তারা পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল মারতে থাকলে পুলিশ তখন আত্মরক্ষার্থে বেশ কয়েক রাউন্ড টিয়রসেল ছোড়ে। তিনি জানান, পরিস্থিতি পুলিশের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।

উত্তরায় সংঘর্ষ : রাজধানীর উত্তরায় হাউস বিল্ডিং গোলচত্বরে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে একদল যুবকের সংঘর্ষ ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। এতে আহত হয় ছাত্রলীগের তুরাগ থানার সভাপতি শফিকুল ইসলাম ও সাধারণ সম্পাদক আরিফুর রহমানসহ বেশ কয়েকজন। তাদেরকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। শিক্ষার্থীরা তিনটি মোটরসাইকেল ভাংচুর করে। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা বিকাল ৪টার পর রাস্তা ছেড়ে দিলে বিমানবন্দর ও ঢাকা-ময়মনসিংহ রোডে যান চলাচল স্বাভাবিক হয়।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রাসেল হোসেন যুগান্তরকে বলেন, দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আমাদের আন্দোলন চলবে। শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে কেউ বাধা দেয়ার চেষ্টা করলে আমরা তাদের প্রতিহত করব। সোমবার আমরা একই সময় একই জায়গায় কর্মসূচি পালন করব।

মিরপুরে বাধা : মিরপুরে অষ্টম দিনে পুলিশ এবং একদল যুবক কর্মসূচি পালনে বাধা দিয়েছে বলে বিক্ষোভকারীরা অভিযোগ করেছেন। সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, রোববার সকাল থেকেই গোল চত্বর এলাকা ঘিরে রাখে পুলিশ। বেলা ১১টার দিকে মিরপুর-২ নম্বর থেকে প্রায় তিনশ’ শিক্ষার্থী একটি মিছিল নিয়ে মিরপুর-১০ নম্বর গোলচত্বর এলাকার দিকে এগুতে থাকে। তারা ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স কার্যালয়ের সামনে পৌঁছলে ৬০-৭০টি মোটরসাইকেলে করে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা সেখানে যান। ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীরা হাততালি দিয়ে মিছিলকে স্বাগতে জানালেও শিক্ষার্থীদের গোলচত্বরে ঢুকতে দেননি। তারা শিক্ষার্থীদের বলেন, ‘আমরা তোমাদের আন্দোলনের সঙ্গে আছি। তোমরা চলে যাও।’ পরে শিক্ষার্থীদের মিছিলকে মিরপুর-২ এর দিকে ফেরত পাঠানো হয়। এ সময় মিরপুর ১০ নম্বর গোল চত্বর এলাকায় ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও শ্রমিক লীগের বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মী চোখে পড়ে।

বেলা ১২টার দিকে মিরপুর কমার্স কলেজের সামনে রাস্তা বন্ধ করে দিয়ে আন্দোলনকারীরা বিক্ষোভ করতে থাকে। এ সময় রাস্তায় দুই পাশ দিয়ে বিপুলসংখক পুলিশ তাদের ঘিরে রাখলে দুই পক্ষের মধ্যে উত্তেজনা তৈরি হয়। পরে সংরক্ষিত মহিলা আসনের এমপি সাবিনা আক্তার তুহিন উভয়পক্ষের সঙ্গে কথা বললে পুলিশ নমনীয় অবস্থানে যায়। একপর্যায়ে শিক্ষার্থীরা মিছিল নিয়ে মিরপুর ১০ নম্বরের দিকে যেতে থাকে। মিছিলটি ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অফিসের সামনে গেলে মিছিলটিকে মিরপুর ২ নম্বরের দিকে ঘুরিয়ে দেয়া হয়। পরে বিকাল ৩টার দিকে তারা মিছিল নিয়ে মিরপুর ১০ নম্বর গোল চত্বরে ঢুকে পড়ে। এ সময় পুলিশ এবং শিক্ষার্থীদের মধ্যে চরম উত্তেজনা দেখা দেয়। এ অবস্থায় শিক্ষার্থীরা প্রায় আধা ঘণ্টা গোল চত্বরে অবস্থান নেয়। আজ সোমবার তারা ফের রাস্তায় নামবে বলে ঘোষণা দিয়ে বিকাল সাড়ে ৩টার দিকে গোল চত্বর ত্যাগ করে।

প্রগতি সরণি-রামপুরা : সকালের দিকে রামপুরা ব্রিজের সামনে অবস্থান নেয় রামপুরার ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। তাদের সঙ্গে বনশ্রীর রাজধানী আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থীরাও যোগ দেয়। দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে বাড্ডা থেকে রামপুরার দিকে ‘জয় বাংলা’, ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিতে দিতে আওয়ামী লীগের কর্মী-সমর্থকদের একটি মিছিল আসে। শিক্ষার্থীদের কাছাকাছি এসে মিছিলটি থেমে যায়। এ সময় শিক্ষার্থীরা উত্তেজিত হয়ে ইটপাটকেল ছুড়তে থাকে। একপর্যায়ে লাঠি নিয়ে ধাওয়া দিলে আওয়ামী লীগের মিছিলটি ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। এদিকে রামপুরায় বেলা পৌনে ১টার দিকে শিক্ষার্থীদের মুখোমুখি অবস্থান নেয় একদল যুবক। মেরুল-বাড্ডা থেকে রামপুরা ব্রিজের দিকে লাঠিসোটা নিয়ে এগোতে থাকে তারা। রামপুরা ব্রিজের কাছে তখন স্টেট ইউনিভার্সিটি, ইমপেরিয়াল কলেজ, খিলগাঁও ওমেন্স স্কুল ও কলেজসহ বেশ কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা সড়কে অবস্থান করছিল। ওই যুবকদের দেখে শিক্ষার্থীদের মধ্যে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। এ সময় স্টেট ইউনিভার্সিটির সামনের লাঠি ও বাঁশ নিয়ে শিক্ষার্থীরাও অবস্থান নেয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে রামপুরা সেতুর ওপর পুলিশ অবস্থান নেয়। রামপুরা থানার ওসি প্রলয় কুমার সাহা যুগান্তরকে বলেন, শিক্ষার্থীদের একজন আহত হয়েছে, এমন গুজবে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছিল। আমরা তাদের লাঠিসোটা ফেলে রাস্তার একপ্রান্তে অবস্থান নিতে বলেছি।

অন্যদিকে প্রগতি সরণি রোডে নদ্দা থেকে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার গেট পর্যন্ত রাস্তা অবরোধ করে রাখে শিক্ষার্থীরা। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের হাতে ছিল রড ও লাঠি। তারা ওই সড়কে কোনো যানবাহন চলাচল করতে দেয়নি। তবে রোগীবাহী গাড়ি এবং কিছু মোটরসাইকেল চলতে দেয়া হয়েছে ওই সড়কে।

ফার্মগেটে হামলা : ফার্মগেটে এশিয়া প্যাসিফিক ইউনিভার্সিটির একদল শিক্ষার্থী আন্দোলনে নামে। তাদের মিছিলের ওপর হামলা হয়েছে। দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে ফার্মগেট মোড়ের দিকে মিছিল নিয়ে যেতে চাইলে একদল যুবক এ হামলা চালায়। ওই সব তরুণের মাথায় হেলমেট ছিল। তারা লাঠিসোটা নিয়ে মিছিলের ওপর হামলা করে। মুহূর্তেই মিছিলটি ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। মিছিলকারীরা এরপর ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসে ঢুকে পড়ে। হামলাকারীরা ইউনিভার্সিটির ভবনের কাচ ভাংচুর করে। ১৫ মিনিট পর হামলাকারীরা চলে যায়।

ঢাবিতে বিকালে হামলা : আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার প্রতিবাদে বিকালে ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিপীড়ন বিরোধী শিক্ষার্থীবৃন্দ’ সমাবেশ করে। তাতে ছাত্রলীগ হামলা চালিয়েছে বলে সমাবেশকারীরা অভিযোগ করেছে। তাদের দাবি, রোববার বিকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে মোটর সাইকেল মহড়া থেকে এ হামলা করা হয়। মহড়ার নেতৃত্বে ছিলেন কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন ও সাধারণ সম্পাদক গোলাম রব্বানী। তবে সভাপতি শোভন হামলার ঘটনা অস্বীকার করে বলেন, এ ধরনের কোনো ঘটনা ঘটেনি।

এদিকে হামলার পর দ্রুত রাজু ভাস্কর্য এলাকা ত্যাগ করে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। এর বাইরে বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হলে আন্দোলনকারী তিন শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে শিবির করার অভিযোগ এনে মারধরের খবর পাওয়া গেছে।

সাংবাদিকদের ওপর হামলা : ধানমণ্ডি-সায়েন্স ল্যাবরেটরি-এলিফ্যান্ট রোড এলাকায় সংঘর্ষ চলাকালে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলাকারী যুবকরা অন্তত পাঁচজন সাংবাদিককে মারধর করেছে। সায়েন্স ল্যাবরেটরি মোড়ে লাঠিসোটা হাতে যুবকদের হাতে মারধরের শিকার হন প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক আহমেদ দীপ্ত। ওই এলাকায় আরও মারধরের শিকার হন অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসের (এপি) ফটো সাংবাদিক এএম আহাদ, দৈনিক বণিক বার্তার পলাশ শিকদার ও ফ্রিল্যান্স ফটো সাংবাদিক রাহাত করিম। আহত সাংবাদিকদের বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হয়েছে। হামলাকারীরা রাহাতের ক্যামেরা ছিনিয়ে নেয়। রড, লাঠি দিয়ে মারধর করে তাকে রক্তাক্ত করা হয়।

২৮ মামলা : এদিকে গত কয়েক দিনের ঘটনায় রোববার সন্ধ্যা পর্যন্ত রাজধানীর বিভিন্ন থানায় ২৮টি মামলা দায়ের হয়েছে। মোট ১৪ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। মামলাগুলোর মধ্যে পুলিশের মিরপুর ও উত্তরা বিভাগে ৩টি করে, ওয়ারী বিভাগে ২টি, রমনা ও মতিঝিল বিভাগে ৬টি করে মামলা হয়। এছাড়া শাহবাগ, তেজগাঁও, লালবাগ ও গুলশান বিভাগে একটি করে মামলা হয়েছে। ডিএমপির উপকমিশনার (অপরাধ) মুনতাসিরুল ইসলাম এ তথ্য নিশ্চিত করেন।যুগান্তর

Check Also

বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে, এগিয়ে যাবে: স্মৃতিসৌধে পরিদর্শন বইয়ে রাষ্ট্রপতি

মহান স্বাধীনতা দিবসে ঢাকার সাভারের জাতীয় স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে মহান মুক্তিযুদ্ধের বীর শহীদদের প্রতি …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।