বরফ গলেনি’ নির্বাচন কমিশনে

 ক্রাইমবার্অতা রিপোর্ট; নির্বাচন কমিশনের কোনো বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়নি। সিইসির কক্ষে কমিশনারদের অনানুষ্ঠানিক আলাপ-আলোচনার যে রেওয়াজ সেটিও দেখা যায়নি।

কমিশন সূত্র বলছে, গত ৭ আগস্ট থেকে ১৩ আগস্ট পর্যন্ত এই সাত দিন সিইসির সঙ্গে চার কমিশনারের কার্যত কোনো দেখা-সাক্ষাৎ হয়নি। তবে আজ মঙ্গলবার বিকেলে এই ৫ সদস্য জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে আগারগাঁওয়ে কমিশন কার্যালয়ে দোয়া মাহফিলে অংশ নেন।

নির্বাচন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করতে হলে কমিশনের কাজে সমন্বয় থাকতে হবে। অন্যথায় ভালো নির্বাচন করা সম্ভব নয়। কেননা কমিশন যদি বিতর্কিত হয় এবং তাদের ওপর যদি ভোটারদের আস্থা না থাকলে সুষ্ঠু নির্বাচন করা কঠিন হয়ে যাবে।

সিইসির সঙ্গে চার কমিশনারের এই দূরত্বের শুরু গত ৭ আগস্ট থেকে। ওই দিন সাংবাদিকদের এক প্রশ্নর জবাবে সিইসি নুরুল হুদা বলেছিলেন, জাতীয় নির্বাচনে কোথাও কোনো অনিয়ম হবে না—এমন নিশ্চয়তা দেওয়ার সুযোগ নেই।

সিইসির এই বক্তব্যে নাখোশ হন অপর চার কমিশনার মাহবুব তালুকদার, রফিকুল ইসলাম, শাহাদাত হোসনে ও কবিতা খানম। পরদিন তাঁরা গণমাধ্যমকে বলেছেন, সিইসির এই বক্তব্য নির্বাচন কমিশনের (ইসি) গ্রহণযোগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে। আগামী জাতীয় নির্বাচনে যারা অনিয়ম করতে চায়, এই বক্তব্য তাদের উৎসাহিত করবে। চার কমিশনার আরও বলেন, অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য তারা শপথ নিয়েছেন। তাই সিইসির এই বক্তব্য কোনো অবস্থাতেই কমিশনের বক্তব্য নয়।

সিইসির এই বক্তব্য এবং চার কমিশনারের প্রতিক্রিয়ার পর এক সপ্তাহ কেটে গেলেও এই সময়ের মধ্যে সিইসির সঙ্গে কমিশনারদের আলাপ-আলোচনা হয়নি। কমিশনার মাহবুব তালুকদার ও শাহাদাত হোসেনর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এই সময়ের মধ্যে সিইসি নুরুল হুদাও কমিশনারদের কাউকে নিজের কক্ষে আমন্ত্রণ জানাননি। কোনো বিষয়ে কথা বরার জন্য কমিশনারদের ডাকেনও নি।

তবে কমিশনের একটি সূত্র বলছে, ১৬ আগস্ট বৃহস্পতিবার কমিশনের একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা আছে। সেখানে সিইসি ও চার কমিশনারের থাকার কথা রয়েছে।

সিইসি ও চার কমিশনারের এই অবস্থান সম্পর্কে জানতে চাইলে সাবেক নির্বাচন কমিশনার মুহাম্মদ ছহুল হোসাইন  বলেন, সিইসির এই ধরনের বক্তব্য দেওয়া ঠিক হয়নি। কারণ এতে নির্বাচন সুষ্ঠু হবে কি না তা নিয়ে জনমনে আশঙ্কা তৈরি হয়। নির্বাচন সুষ্ঠু করার জন্য কমিশনের হাতে শক্ত আইন আছে। সুষ্ঠু না হলে নির্বাচন বন্ধ করে দেওয়ার ক্ষমতাও কমিশনের আছে। সুতরাং সিইসি যা বলেছেন তা ঠিক নয়। ছহুল হোসাইন আরও বলেন, সিইসির বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় চার কমিশনার যা বলেছেন সেটাও ঠিক হয়নি। কারণ তাদের বক্তব্য সিইসির প্রতি অনাস্থার শামিল। কমিশন এভাবে চললে সুষ্ঠু নির্বাচন করা দুরূহ হবে। তিনি বলেন, শীতল সম্পর্কের অবসান হওয়া উচিত। জাতীয় স্বার্থে বরফ তাড়াতাড়ি গলতে হবে।

কমিশন সচিবালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, অতীতে যেসব কমিশন দায়িত্ব পালন করেছেন তাদের মধ্যে কখনো এমন সমন্বয়হীনতা দেখা যায়নি। সচিবালয়ের নির্ধারিত বৈঠকের বাইরেও রেওয়াজ অনুযায়ী কমিশনারেরা নিয়মিত সিইসির কক্ষে গিয়ে আলাপ আলোচনা করেন। নির্বাচন ও নির্বাচন সংশ্লিষ্ট অন্যান্য বিষয়ে মতবিনিময় করতেন। এতে করে যে কোনো সমস্যার সমাধানে গ্রহণযোগ্য সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব হতো।

কিন্তু বর্তমান কমিশন অতীতের সেই রেওয়াজ অনুসরণ করছে না। এই কমিশন একান্ত প্রয়োজন ছাড়া কখনো কোনো বৈঠক করে না। সংবিধান অনুযায়ী সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়ার পূর্ববর্তী ৯০ দিনের মধ্যে জাতীয় সংসদের ৩০০ আসনে ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে। এই হিসেবে ৩১ অক্টোবর থেকে নির্বাচনের দিন গণনা শুরু হবে। কিন্তু কবে নাগাদ নির্বাচন নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা এবং কবে নাগাদ ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হতে পারে, সে বিষয়ে এখনো কমিশনের বৈঠকে এখনো কোনো আলোচনা হয়নি।

নির্বাচন কমিশনার শাহাদাত হোসেন আজ বলেছেন, নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য রুটিন অনুযায়ী কাজ এগিয়ে চলেছে। কিন্তু নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার বিষয় নিয়ে এখনো কমিশনে কোনো আলোচনা হয়নি।

ইসি সচিবালয় সূত্র জানায়, দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই সিইসির সঙ্গে নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদারের বিরোধ পরিষ্কার হয়ে ওঠে। বিরোধের কারণ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অনিয়ম, স্থানীয় নির্বাচনের প্রচারে নিয়ম না মেনে সাংসদদের অংশগ্রহণ, বিরোধী দলের দাবি অনুযায়ী নির্বাচনে সশস্ত্র বাহিনী মোতায়েন না করা ইত্যাদি। সর্বশেষ তিন সিটির নির্বাচনে সবচেয়ে বেশি অনিয়মের অভিযোগ উঠে বরিশালের নির্বাচন নিয়ে। মাহবুব তালুকদার বরিশালের নির্বাচন বন্ধ করার সর্বাত্মক চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু সেই সময়ে অন্য কমিশনারেরা তাঁর পাশে দাঁড়ায়নি। তবে সিইসির সাম্প্রতিক মন্তব্যকে কেন্দ্র করে অন্য কমিশনারেরা তাঁর পাশে দাঁড়িয়েছেন।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে মাহবুব তালুকদার বলেন, এ নিয়ে তিনি কোনো কথা বলতে চান না। তিনি বলেন, কমিশনের কাজে নানা বিষয়ে তার মতভেদ আছে। তবে মতবিরোধ নেই।

এ বিষয়ে ছহুল হোসাইন বলেন, সংবিধান বলেছে, কমিশন হলো একক সত্ত্বাবিশিষ্ট একটি প্রতিষ্ঠান। এখানে কারও একক সিদ্ধান্ত বা মতের কোনো মূল্য নেই। কমিশনের বৈঠকে বসে সিদ্ধান্ত নিয়ে সেটা বাস্তবায়ন করতে হবে। তা না করে যে যার মতো বিবৃতি দিতে থাকলে সিইসির সঙ্গে কমিশনারদের দূরত্ব আরও বাড়তে। সুতরাং সিইসির দায়িত্ব হবে অন্য কমিশনার সঙ্গে নিয়ে নিয়মিত বৈঠকে বসা।

Please follow and like us:

Check Also

অনিশ্চয়তার নতুন যুগে মধ্যপ্রাচ্য

ইউক্রেন-রাশিয়া রেশ কাটতে না কাটতেই ফিলিস্তিনের গাজায় শুরু হয় ইসরাইলি আগ্রাসন। এরপর থেকে অশান্ত হতে …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।