সুষ্ঠু গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের পরিবেশ দেখতে পাচ্ছেনা বিদেশিরা

মোহাম্মদ জাফর ইকবাল : সবার অংশগ্রহণে একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ সংসদ নির্বাচন আয়োজনে দেশে এবং বিদেশে প্রবল চাপের মুখে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। একইসাথে একতরফা প্রচারণা আর বিরোধীদের ব্যাপক ধরপাকড়ে কূটনীতিকদের সামনে প্রশ্নবানে জর্জরিত ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। বিভিন্ন কর্মসূচিতে এখন বিদেশীদের একটাই প্রশ্ন, নির্বাচনী পরিবেশ কেমন। সূত্র মতে, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির একতরফা নির্ব্চানের পর থেকেই একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য প্রকাশ্যে বক্তব্য দিচ্ছে বাংলাদেশে অবস্থানরত বিদেশীরা। এমনকি দাতা সংস্থাগুলো বলছে সবার অংশগ্রহণে একটি নির্বাচন আয়োজনের জন্য। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত কয়েকটি অনুষ্ঠানে একাদশ সংসদ নির্বাচন নিয়ে আরো বেশী সরব হয়ে উঠেছে বিদেশীরা। ফলে ২০১৪ সালের ন্যায় এবারও একটি একতরফা নির্বাচন করা আ’লীগের জন্য অতটা সহজ হবে না বলেই মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন দেখতে চায় ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)। গত বৃহস্পতিবার (১৮ অক্টোবর) ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূতের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ অন্য নির্বাচন কমিশনারদের সঙ্গে বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের এ কথা বলেন ইইউ রাষ্ট্রদূত রেনজি টেরিংক। ইইউ রাষ্ট্রদূত রেনজি টেরিংক সাংবাদিকদের আরও বলেন, নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে ইউরোপীয় ইউনিয়ন নির্বাচন বিষয়ে অভিজ্ঞ দুজন প্রতিনিধি বাংলাদেশে পাঠাবে। তারা রাজনৈতিক পরিবেশ ও নির্বাচনের সার্বিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করবে। জনবহুল বাংলাদেশে একই দিনে তিনশ’ আসনে নির্বাচনের প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, একই দিনে এত মানুষের ভোট একটা বড় চ্যালেঞ্জ। তবে এদেশে এই চর্চাটা আগে থেকেই রয়েছে। তিনি জানান, নির্বাচনে কোনও ধরনের সহযোগিতার প্রয়োজন হলে ইইউ তা কূটনৈতিকভাবে করতে প্রস্তুত রয়েছে।
নির্বাচন নিয়ে বিদেশীদের অবস্থা জানতে এবং জানাতে গত ১৫ অক্টোবর সোমবার রাজধানীর গুলশানে লেকশোর হোটেলের লা ভিটা হলে কূটনীতিকদের সঙ্গে এক মতবিনিময় অনুষ্ঠানের আয়োজন করে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক সম্পর্কবিষয়ক উপ-কমিটি। সেখানে নির্বাচন নিয়ে সার্বিক বিষয়াদি তুলে ধরা হয়। এসময় বিদেশীরা নির্বাচন কবে হবে সে সম্পর্কে জানতে চান। জবাবে সরকার দলের পক্ষ থেকে চলতি বছরের ডিসেম্বর নাগাদ অনুষ্ঠানের সম্ভাব্য সময় তুলে ধরা হয়। এ সময় কয়েকজন কুটনীতিক জানতে চান, তাহলে দেশে সভা-সমাবেশ বা নির্বাচনে প্রচারণা নেই কেন? রাজধানী সহ দেশের কোথাও বিরোধীদের তৎপরতা নেই কেন? এসময় জবাবে আ’লীগ নেতারা নির্বাচনের বিষয়টি নির্বাচন কমিশন দেখে বলে পাশ কাটানোর চেষ্টা করেন। সভায় ইউরোপ, আমেরিকা, রাশিয়া, মধ্যপ্রাচ্যসহ অনেকগুলো দেশের অর্ধশতাধিক কূটনীতিক অংশ নেয় বলে জানা গেছে।
বৈঠকে উপস্থিত একাধিক নেতা জানান, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন কবে অনুষ্ঠিত হবে এমন প্রশ্ন ছিল আমেরিকান এক কূটনীতিকের। কূটনীতিকের এমন প্রশ্নের জবাবে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, নির্বাচন অনুষ্ঠান করার সাংবিধানিক দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের। বিষয়টি তারা ভালো জানেন। তবে আমাদের ধারণা চলতি বছরের শেষ দিকে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে। সভাসূত্র আরও জানায়, একটি দেশের কূটনীতিক নির্বাচনের সময় বিএনপিকে প্রচার-প্রচারণা চালাতে সুযোগ দেয়া হবে কি না, প্রতিবন্ধকতা থাকবে কি না, সকল রাজনৈতিক দল সমানভাবে প্রচার-প্রচারণা চালাতে পারবে কি না এ বিষয়ে জানতে চান। এছাড়া ঢালাওভাবে গ্রেফতার, সিনিয়র নেতাদের বিরুদ্ধে গায়েবি মামলাসহ নানা ইস্যু তুলে ধরা হয়। জবাবে আওয়ামী লীগ নেতারা বলেন, নির্বাচনকালীন সকল প্রশাসনিক ক্ষমতা থাকবে নির্বাচন কমিশনের কাছে। নির্বাচনে যারা আসবে, সেই সকল দল প্রচার-প্রচারণার গণতান্ত্রিক অধিকার অনুযায়ী তাদের প্রচার-প্রচারণা চালাবে। এখানে আমাদের (আওয়ামী লীগ) কোনো ভূমিকা নেই। জানা গেছে, সরকার দলীয়দের এমন বক্তব্যে খুশি হতে পারেননি বিদেশীরা। তবে আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাক ড. শাম্মী আহমেদ সাংবাদিকদেও বলেন, কিছু দেশের কূটনীতিক আমাদের কাছে নির্বাচন নিয়ে আগ্রহ দেখিয়েছেন। প্রশ্ন করেছেন। এটা ছিল আমাদের নিয়মিত বৈঠকের একটি। প্রায় সময় আমরা দেশের চলমান পরিস্থিতি নিয়ে তাদের সঙ্গে মতবিনিময় করি।
সর্বশেষ গত ১৮ অক্টোবর বৃহস্পতিবার সুষ্ঠু নির্বাচন এবং দেশের সর্বশেষ পরিস্থিতি নিয়ে কূটনীতিকদের কাছে ব্রিফিং করেছেন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের আহবায়ক ড. কামাল হোসেন। গুলশানে লেকশোর হোটেলে কূটনীতিকদের সাথে দীর্ঘসময় ধওে এ বৈঠক চলে। বৈঠকের পর জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের সভাপতি আসম আবদুর রব সাংবাদিকদের বলেন, আমরা শুধুমাত্র বাংলাদেশে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত-হাইমিশনার-কূটনৈতিকদের সাথে রুদ্ধ্রদ্বার মতবিনিময় করেছি। আমদের শীর্ষ নেতা জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ড. কামাল হোসেন ৭ দফা দাবি ও ১১ দফা লক্ষ্য সম্পর্কে ব্যাখ্যা করেছেন। তাদের প্রশ্নের জবাবও তিনি দিয়েছেন। অত্যন্ত সফলভাবে এই মতবিনিময় সম্পন্ন হয়েছে। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের কাছে প্রশ্ন ছিলো আপনারা কি আলোচনা করেছেন। জবাবে তিনি বলেন, আমরা কূটনীতিকদের সাথে মতবিনিময় করেছিল। এর বেশি কিছু বলা যাবে না। বৈঠকে, যুক্তফ্রন্টের ৭ দফা দাবি ও ১১ দফা লক্ষ্যসমূহ কূটনীতিকদের সরবারহ করা হয়।  বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, চীন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাপান, জার্মানি, ফ্রান্স, অস্ট্রেলিয়া, তুরস্ক, ভিয়েতনাম, পাকিস্তান, সুইজারল্যান্ড, নরওয়ে, কাতার, মরক্কোসহ ৩০ টি দেশের কূটনীতিকরা উপস্থিত ছিলেন।
জানা গেছে, বৈঠকে কুটনীতিকরা একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের কথা পুনব্যক্ত করেন। তারা বলেন, আমরা সরকারকে বলেছি, দেশে ২০১৪ সালের ন্যায় একতরফা নির্বাচন আর দেখতে চাইনা। এমন নির্বাচন করতে হবে যাতে দেশের সকল দল অংশ নিতে পারে। ভোটাররা নির্বিঘেœ তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেন।
সূত্র মতে, বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে সবচেয়ে বেশী প্রভাব খাটায় প্রতিবেশী দেশ ভারত। দেশটিকে ক্ষমতাসীন আ’লীগের বন্ধুপ্রতীম দেশ হিসেবেও প্রচার করা হয়। ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে ভারতের ভূমিকা দেশে এমনকি বিদেশেও ব্যাপক সমালোচিত হয়েছে। তবে এবার তারা আর সেই বিতর্কিত ভূমিকায় যেতে চান না। বৃহস্পতিবার (১৮ অক্টোবর) রাজধানীর বনানী সেতু ভবনে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ শেষে বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার হর্ষবর্ধন শ্রিংলা বলেছেন, বাংলাদেশে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে কোনো নাশকতার আশঙ্কা দেখছে না ভারত। হর্ষবর্ধন বলেন, ভারত আশা করে আগামী নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য হবে। তিনি বলেন, আমরা আশা করি সবার অংশগ্রহণে নির্বাচন সুন্দর হবে। নির্বাচনে বাংলাদেশের জনগণের মতামত প্রতিফলিত হবে, এটাই গণতন্ত্রিক একটি দেশ হিসেবে তারা প্রত্যাশা করে।
সূত্র মতে, কেন্দ্র দখল, বিরোধী এজেন্টদের বের করে দেয়া, প্রতিপক্ষের সমর্থকদের হুমকি-নির্যাতনসহ বহুল সমালোচিত সর্বশেষ গাজীপুর ও খুলনা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে যুক্তরাষ্ট্রসহ কয়েকটি দেশের কুটনীতিকরা। এমন আচরণে বিদেশীদের তুলো ধুনো করছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। সরকারি দল বলছে, বিদেশীরা বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে মন্তব্য করতে পারেন না। তবে বিশ্লেষকরা ক্ষমতাসীনদের এই বক্তব্যকে ‘ভূতের মুখে রাম রাম’ বলে অভিহিত করছেন। তারা বলছেন, বাংলাদেশের চলমান অস্থিতিশীল পরিবেশ নিয়ে জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ দাতা সংস্থা গুলোর বক্তব্য নতুন কিছু নয়। এছাড়া ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচনের আগে প্রতিবেশী দেশ ভারতের ভূমিকা ছিল প্রকাশ্য। দেশটি ক্ষমতাসীন আ’লীগের পক্ষে সরাসরি অবস্থান নিয়েছিল। জাতীয় পার্টির সে সময়কার ডিগবাজির রাজনীতি এবং দলটির চেয়ারম্যান হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদের নানা নাটকীয়তার পেছনে ভারতকেই দায়ী করা হয়। এর আগে আওয়ামী লীগ বিরোধী দলে থাকা অবস্থায় এই দেশ ও সংস্থা গুলোই দেশের চলমান পরিস্থিতি নিয়ে বক্তৃতা দিয়েছিল। এমনকি অনেক দেশ বিবৃতি পর্যন্ত দিয়েছে। তখন আওয়ামী লীগ এসব নিয়ে কিছুই বলেনি। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, যখনই নিজেদের বিরুদ্ধে যায় তখন সেটি যেই হোক না কেন আওয়ামী লীগের কাছে তারা শত্রু হয়ে যায়। এবারো তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। দেশের অরাজক পরিস্থিতি, দখল, বিরোধী নেতাকর্মীদের গুম, মানবাধিকার পরিস্থিতিসহ একটি নিরপেক্ষ নির্বাচনের কথা যারাই বলছে তারাই সরকারের সমালোচনার মুখে পড়ছে।
সূত্র মতে, দেশের প্রায় সব ক’টি দল, সুশীল সমাজ এবং বিদেশীরা বাংলাদেশে সবার অংশগ্রহণে একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন দেখতে চান। তবে জাতীয় নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে যেভাবে সরকারি দলের একগুয়েমী বক্তব্য চলছে তাতে করে জনমনে শংকা তৈরি হচ্ছে এই জন্য যে, আগামী নির্বাচনের মাধ্যমে দেশে গণতন্ত্রের উত্তরণ ঘটবে, নাকি আবারো একটি একদলীয় ভোটারবিহীন নির্বাচনের প্রহসন ঘটবে? রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকেরা বলছেন, একটি অংশগ্রহণমূলক অর্থপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠান জাতির আকাংখা ও দেশের স্বার্থেই জরুরি। তাদের মতে, এর মাধ্যমে সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক পথ অনুসরণ করে বাংলাদেশ দ্রুত উন্নতির দিকে এগিয়ে যাবে, দেশ থেকে দারিদ্র্য মোচন হবে, দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা চাঙ্গা হবে।
সূত্র মতে, বাংলাদেশের চলমান অস্থিতিশীল পরিস্থিতি নিয়ে সবচেয়ে বেশী উদ্বেগ-উৎকন্ঠা জানাচ্ছে জাতিসংঘ। তারা বারবার বলছে আগামী নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণ দেখতে চায় তারা। সেই সাথে বাংলাদেশে সাম্প্রতিককালে সফরে আসা বিভিন্ন প্রভাবশালী রাষ্ট্রের প্রতিনিধিরাও একই ধরনের কথা সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে অবহিত করে গেছেন। সরকারের উচ্চপর্যায় থেকেও আগামী নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণের বিষয়ে ইতবাচক মতামত প্রকাশ করা হচ্ছে। গেল বছর সচিবালয়ে নিজ দফতরে ঢাকায় নিযুক্ত জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারী এবং ইউএনডিপির আবাসিক প্রতিনিধি রবার্ট বি. ওয়াটকিনসের সঙ্গে বৈঠক শেষে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ সাংবাদিকদের বলেছিলেন, আগামী নির্বাচনে জাতিসংঘ বাংলাদেশের সব রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণ দেখতে চায়। বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারী বেশ কয়েকটি ইস্যুতে আলোচনা করেছেন। বিশেষ করে আগামী নির্বাচন বিষয়ে জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারী জানিয়েছেন, আগামী নির্বাচন হতে হবে স্বচ্ছ, অবাধ ও নিরপেক্ষ। আমরা চাই শান্তিপূর্ণভাবে এ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হোক। সব দলের অংশগ্রহণ আমরা দেখতে চাই। সর্বশেষ সম্প্রতি বিএনপি মহাসচিবকে চিঠি দিয়ে ডেকেছেন জাতিসংঘ মহাসচিব। সেখানে নির্বাচন বিষয়ে কথা হয় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুলের সাথে। বৈঠকে জাতিসংঘ জানায়, এবার আর ২০১৪ সালের নির্বাচন দেখতে চায়না তারা। বৈঠকে একাদশ সংসদ নির্বাচনে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে অনুষ্ঠানের দাবি জানিয়েছেন বিএনপি মহাসচিব।
২০১৬ সালের নভেম্বরে ইউরোপীয় ইউনিয়নের পার্লামেন্টের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বিষয়ক কমিটির প্রতিনিধিদলের প্রধান জিন ল্যামবার্ট ঢাকায় ইইউ দূতাবাসে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে জানিয়েছিলেন, তারা বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন সামনে রেখে শক্তিশালী ও সক্ষম একটি নির্বাচন কমিশন গঠনে জোর দিচ্ছে। তিনি আরো বলেছিলেন, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় গঠিত ওই নতুন নির্বাচন কমিশনটি এমন হতে হবে, যাতে অংশগ্রহণমূলক ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনের ব্যাপারে ভোটারদের আস্থা থাকবে। আগামী নির্বাচনকে অংশগ্রণমূলক করতে সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টির কথাও বলেন প্রতিনিধিদলের সদস্যরা। জিন ল্যামবারট বলেন, বাংলাদেশের পরবর্তী জাতীয় নির্বাচন এমন একটি পরিবেশে হতে হবে, যাতে করে রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নেয়ার সুযোগকে কাজে লাগাতে পারে। এরপর ঢাকা সফরকালে ইউরোপীয় পার্লামেন্টের প্রতিনিধিদের দলের প্রধান আর্নে লিট্জ বিজিএমইএর সাথে বৈঠকের পর সাংবাদিক সম্মেলনে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, বাংলাদেশে মত প্রকাশের স্বাধীনতা সীমিত। আমি মনে করি এখানে সবাইকে তার মত প্রকাশ করতে দেয়া উচিৎ। ২০১৬ সালের ৯ জুন ইউরোপীয় পার্লামেন্টে বাংলাদেশ প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে পার্লামেন্টের সদস্যরা বলেছেন, বাংলাদেশে বিগত বিতর্কিত জাতীয় নির্বাচনের বিষাক্ত প্রভাব কেউ অস্বীকার করতে পারে না। এটা প্রাতিষ্ঠানিক অবিশ্বাসের পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। একইসাথে সহিংসতাকে উসকে দিয়েছেÑ যা আমরা এখনো প্রত্যক্ষ করছি। যত দ্রুত সম্ভব তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনই বর্তমান পরিস্থিতি থেকে বাংলাদেশের উত্তরণের একমাত্র উপায়। বাংলাদেশ পরিস্থিতির ওপর ফ্রান্সে অনুষ্ঠিত ইউরোপীয় পার্লামেন্টের অধিবেশনে এসব মন্তব্য করা হয়েছে। এতে বক্তব্য রাখতে গিয়ে ক্রিশ্চিয়ান ড্যান প্রেদা বলেন, আমি বাংলাদেশে সহিংসতার ধারাবাহিকতায় খুবই উদ্বিগ্ন। তিনি বলেন, বিগত জাতীয় নির্বাচনের পর থেকে বাংলাদেশে নাজুক রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিরাজ করছে। বিরোধী দলগুলোর বর্জনের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠিত এই নির্বাচন রাজনৈতিক পরিবেশকে উত্তপ্ত করে তুলেছে। অর্থনৈতিক দিক থেকে বাংলাদেশ আমাদের গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। এই অংশীদারের সাথে আলোচনা করে দেশটির রাজনৈতিক পরিবেশের উন্নয়নের জন্য আহ্বান জানানো উচিত।
গতবছরের ৫ মার্চ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ট্রাম্প প্রশাসনে নতুন দায়িত্ব পাওয়া সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী (ভারপ্রাপ্ত) উইলিয়াম ই টড ওয়াশিংটনের তরফে ‘শুভেচ্ছা সফরে’ ঢাকায় এসেছিলেন। সরকারের দায়িত্বশীল প্রতিনিধিদের সঙ্গে তার দু’দেশের সম্পর্কের বিভিন্ন বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। বাংলাদেশ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানে কোনো পরিবর্তন আসছে কি-না জানতে চাইলে জবাবে মার্কিন দূত স্পষ্ট করেই বলেন, ক্ষমতা পরিবর্তনে যুক্তরাষ্ট্র নীতি পরিবর্তন করতে পারে এমন কথা চিন্তাই করা যায় না। আমরা চাই চলমান উেেদ্বগ-উৎকন্ঠঅর অবসান হোক। একই বছরের ৪ মার্চ যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্র ও কমনওয়েলথ দফতরের এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল বিষয়ক মন্ত্রী অলোক শর্মাও ঢাকা সফর করেন। এ সময় তিনি অন্যান্যের মধ্যে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার সঙ্গেও বৈঠক করেন। বৈঠকের পর অলোক শর্মার সাথে আলোচনার বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সাংবাদিকদের বলেন, বাংলাদেশে সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক জাতীয় নির্বাচন দেখতে আগ্রহী যুক্তরাজ্য। দেশটি চায় বাংলাদেশে একটি প্রতিনিধিত্বশীল সরকার হোক। নির্বাচনেও এর প্রতিফলন দেখতে চায় তারা।
বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে শুধু বক্তব্য দিয়েই ক্ষান্ত থাকেনি ইউরোপীয় ইউনিয়ন। তারা এর জন্য বিবৃতিও দিয়েছে। গেল বছরের ৯ ডিসেম্বও এক বিবৃতিতে জানায়, বাংলাদেশে অবাধ সুষ্ঠু ও সবার অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন দেখতে চায় ইইউ। বিবৃতিতে বলা হয়, আন্তর্জাতিক মানদ- অসুসরণ করে একটি গণতান্ত্রিক নির্বাচন দিতে হবে। গত কয়েক বছর ধওে সংস্থাটি বাংলাদেশের সার্বিক অবস্থা নিয়ে বক্তব্য-বিবৃতি দিয়ে যাচ্ছে। চলতি বছরের ১৪ ফেব্রুয়ারি ইউরোপীয় পার্লামেন্টারি প্রতিনিধি দলের নেতা জঁ ল্যামবার্ট ঢাকায় বলেছেন, বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি বেশ জটিল মনে হচ্ছে। সূত্রমতে, এ মুহূর্তে ভারতের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা বাংলাদেশের একাদশ নির্বাচন নিয়ে কোনো কথা না বললেও গত অক্টোবরে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশ সফরে এসে ‘সবার অংশগ্রহণে স্বচ্ছ নির্বাচনের’ তাগিদ দিয়ে গেছেন। এছাড়া তারা অনানুষ্ঠানিকভাবেও একই কথা বলছেন। বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের হাই কমিশনারও একই কথা বলেছেন। এমনকি নির্বাচনে তার দেশ সহযোগিতা করবে বলেও তিনি একাধিকবার বলেছেন।
সূত্র বলছে, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির মতো যেনতেন একটি নির্বাচন করে ক্ষমতায় থাকতে চায় আওয়ামী লীগ। ক্ষমতাসীন দলটির বেশিরভাগ নেতাই সেটা চাচ্ছেন। তারা আশা করছেন, তাদের নির্বাচনী তরী পার করে দেবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ক্ষমতাসীনদের এমন মনোভাবের চিত্র স্থানীয় সরকার নির্বাচনেও দেখা যাচ্ছে। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত খুলনা ও গাজীপুর সিটি নির্বাচনে ভোট ডাকাতিই তার প্রমাণ।
ক্ষমতাসীনদের এমন জবর দখলের বিরুদ্ধে আবারো সরব হয়ে উঠেছে বিদেশীরা। অতীতে কখনো চীনকে বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে কথা বলতে দেখা যায়নি। কিন্তু এবার চীনও এ বিষয়ে বেশ সোচ্চার। তারা বলছে, বাংলাদেশে অংশগ্রহণমূলক ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতার হস্তান্তর দেখতে চায় দেশটি।  বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন দেখতে চায় যুক্তরাজ্য। সম্প্রতি ঢাকায় এক সাংবাদিক সম্মেলনে যুক্তরাজ্যের এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয়বিষয়ক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মার্ক ফিল্ড এ কথা বলেন। সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে মার্ক ফিল্ড বলেন, বাংলাদেশে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন দেখতে চায় যুক্তরাজ্য। যেখানে সব দল ভূমিকা রাখবে। যুক্তরাজ্যে বসবাসরত বাংলাদেশিদের এখানকার নির্বাচন নিয়ে আগ্রহ রয়েছে। তিনি মনে করেন, নির্বাচনের পর যে সরকার গঠিত হবে, তাতে জনমতের প্রতিফলন ঘটবে।  ডিপ্লোমেটিক করেসপনডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন  বাংলাদেশ (ডিকাব) আয়োজিত অনুষ্ঠানে মার্শা বার্নিকাট খুলনা ও গাজীপুর নির্বাচনে অনিয়ম নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র তাদের উদ্বেগের কথা জানিয়েছেন। বার্নিকাট বলেছেন, খুলনা ও অতি সম্প্রতি অনুষ্ঠিত গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে ব্যালট বাক্স ছিনতাই এবং বিরোধী রাজনৈতিক নেতা ও পোলিং এজেন্টদের ভয়ভীতি দেখানোর অভিযোগের খবরে যুক্তরাষ্ট্র উদ্বিগ্ন। এ ছাড়া বিরোধী রাজনৈতিক নেতা ও পোলিং এজেন্টদের গ্রেফতার ও পুলিশি হয়রানির বিষয়েও যুক্তরাষ্ট্র উদ্বিগ্ন। মার্শা বার্নিকাট বলেন, বাংলাদেশ সরকার একটি অবাধ, সুষ্ঠু, অংশগ্রহণমূলক ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন আয়োজনে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, যে নির্বাচনে জনগণের মতামতের প্রতিফলন ঘটবে।

Check Also

মালয়েশিয়ার পাম তেলে ইইউ’র নিষেধাজ্ঞা বাংলাদেশের শ্রমবাজারে অশনি সংকেত

বন উজাড়, কার্বন নির্গমনের ঝুঁকি এবং পরিবেশের ভারসাম্য নষ্টগত কারণ দেখিয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ মালয়েশিয়ার …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।