ক্রাইমবার্তা রিপোট : আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে বিশেষ সভায় দেয়া বক্তব্যে কমিশনার মাহবুব তালুকদার গায়েবি মামলা, নির্বাচনী কর্মকর্তাদের তথ্য সংগ্রহসহ পুলিশের বেশকিছু কার্যক্রমের কঠোর সমালোচনা করেন। নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কিছু নেতিবাচক ভূমিকার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, সিডিউল ঘোষণার আগে যে পুলিশ গায়েবি মামলা করেছে, সিডিউল ঘোষণার পর তার পক্ষে রাতারাতি পাল্টে গিয়ে নির্বাচনে নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করা কি সম্ভব হবে?
তবে পুলিশ নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন না করলে নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়বে। আমরা কোনোভাবেই আসন্ন জাতীয় নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হতে দিতে পারি না। সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের খারাপ উদাহরণ জাতীয় নির্বাচনে দেখতে চান না বলে এই কমিশনার বৃহস্পতিবার তার দেয়া লিখিত বক্তব্যে জোরালোভাবে নিজের অবস্থান তুলে ধরেন।
মাহবুব তালুকদার বর্তমান কমিশনের মেয়াদে অনুষ্ঠিত সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনগুলোর উদাহরণ তুলে ধরে বলেন, কুমিল্লা ও রংপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন সুনামের সঙ্গে করতে পারলেও বাকি ৫টির ক্ষেত্রে তা ছিল না। গাজীপুর ও বরিশাল সিটি নির্বাচনে পুলিশের ভূমিকা নিয়ে রীতিমতো প্রশ্ন উত্থাপন করেন তিনি। তুলে ধরেন বেশ কিছু উদাহরণ।
ইসির তদন্তে উঠে আসা পুলিশ বিভাগের কর্তাব্যক্তিদের প্রশ্নবিদ্ধ ভূমিকার কথাও বলেছেন অনুযোগের সুরে। তিনি চার পৃষ্ঠার লিখিত বক্তব্যের একস্থানে উল্লেখ করেন, গাজীপুর সিটি নির্বাচনে জেলা প্রশাসক ১৭৯ জন প্রিসাইডিং কর্মকর্তার তালিকা দিয়েছিল, যা রিটার্নিং কর্মকর্তা গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানান। পরে তা জেলা প্রশাসক অফিসের নিু পর্যায়ের কর্মকর্তার স্বাক্ষরসহ একটি ফরওয়ার্ডিং দিয়ে চিঠি পাঠিয়েছিল।
ওই নির্বাচনে পুলিশের বিষয়ে তিনি বলেন, বিরোধী দলীয় নেতাকর্মীদের গ্রেফতার এবং এ সংক্রান্ত রিটার্নিং কর্মকর্তার পাঠানো ১১টি চিঠি গ্রহণে অস্বীকৃতি জানায় পুলিশ। এর মধ্যে চারটি চিঠির দায়সারা জবাব দেয় পুলিশ।
নির্বাচনের সময় বিরোধী দলের প্রার্থীর লোকজনকে গ্রেফতার ও হয়রানি করা প্রসঙ্গে বলেন, ‘গাজীপুরে নির্বাচনকালে ইউনিফর্মধারী পুলিশ ও সাদা পোশাকের পুলিশ অনেক ব্যক্তিকে বাসা কিংবা রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে যায় বলে অভিযোগ আছে। অনেককে অন্য জেলায় নিয়ে যাওয়া হয়। তাদের একজন ছাড়া পুলিশ অন্যদের বিষয়ে কোনো স্বীকারোক্তি করেনি। নির্বাচনের পর দেখা যায়, তাদের অনেকে কেরানীগঞ্জ কেন্দ্রীয় কারাগারে আছে। গ্রেফতার না করলে তারা কারাগারে গেলেন কীভাবে? এ প্রশ্নের কোনো জবাব পাওয়া যায়নি।’
বরিশাল সিটি নির্বাচন নিয়ে মাহবুব তালুকদার জানান, তিনি এককভাবে এ সিটি নির্বাচনের দায়িত্বে ছিলেন। কিন্তু দুঃখের বিষয়, পাঁচ সিটির মধ্যে সবচেয়ে খারাপ ছিল বরিশাল। সকালে ভোট গ্রহণ ভালো হলেও বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্নমুখী অনিয়ম শুরু হয়। বেলা ১১টার মধ্যে প্রতীয়মান হয়, এভাবে ভোট গ্রহণ চলতে পারে না। একপর্যায়ে কমিশন মনে করে, ভোট গ্রহণ কার্যক্রম পুরোপুরি বন্ধ করা প্রয়োজন। পরে কমিশন ভোট গ্রহণ বন্ধ করতে সম্মত হলেও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সামাল দেয়া, নির্বাচন সংশ্লিষ্টদের নিরাপত্তা দেয়া সম্ভব হবে কি না, তা ভেবে নির্বাচন বন্ধ করা থেকে আমরা বিরত থাকি।
এ নির্বাচনের বিষয়ে মাহবুব তালুকদার রিটার্নিং অফিসারের বক্তব্য তুলে ধরে বলেন, ‘কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিরোধী প্রার্থীদের পুলিশ কর্তৃক অযাচিতভাবে হয়রানি করা হয়েছে। আবার সরকারি দলের প্রার্থীর আচরণবিধি ভঙ্গের ঘটনায় পুলিশকে নিষ্ক্রিয় ভূমিকায় দেখা গেছে। শুধু তাই নয়, উল্টো বিরোধী প্রার্থীর প্রচার-প্রচারণায় পুলিশের অযাচিত হস্তক্ষেপের অভিযোগ রয়েছে।’
কমিশনার তার লিখিত বক্তব্যে আরও বলেন, নির্বাচনের সার্বিক পর্যালোচনায় তদন্ত কমিটির বক্তব্য, ‘বরিশাল সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে ভোট গ্রহণের দিন থেকে অনেক ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক ছিল না এবং ভারপ্রাপ্ত পুলিশ কমিশনার এ বিষয়ে আন্তরিক ছিলেন না। নির্বাচন কমিশনের নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও পুলিশ কর্তৃপক্ষ নির্বাচন কমিশনের পর্যবেক্ষক ও সহকারী রিটার্নিং অফিসারদের নিরাপত্তায় কোনো পুলিশ সদস্য নিয়োগ দেননি। ভোট কেন্দ্রসহ নির্বাচনী এলাকায় অনেক ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ছিল নাজুক। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা অনেক ক্ষেত্রে রিটার্নিং অফিসার ও সহকারী রিটার্নিং অফিসারের নির্দেশনা অনুসরণ করেননি। কিছু কিছু ক্ষেত্রে ভোট কেন্দ্রে ও ভোট কেন্দ্রের বাইরে প্রচুর বহিরাগতের অবস্থান ছিল।’
মাহবুব তালুকদার বলেন, প্রায় ৫ হাজার পৃষ্ঠার সংযুক্ত ডকুমেন্টসহ টাইপ করা ৭১ পৃষ্ঠার মূল তদন্ত রিপোর্টটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমি দুটি স্থান মাত্র উল্লেখ করলাম।
ওই নির্বাচনের অভিজ্ঞতা থেকে সংসদ নির্বাচন কীভাবে সুন্দর করা যায়, সেই পথ বের করার কথাও বলেন তিনি।
এরপর এ সময়ের সবচেয়ে আলোচিত বিষয় গায়েবি মামলা নিয়ে কমিশনার বলেন, বর্তমানে বহুল আলোচিত গায়েবি মামলা এখন আর গায়েবি আওয়াজ নয়। হাইকোর্টও বলেছেন, এই ধরনের মামলায় পুলিশের ভাবমূর্তি বিনষ্ট হয়। ঢাকা পুলিশ কমিশনার গায়েবি মামলা না করতে পুলিশ বাহিনীতে নির্দেশনা দিয়েছেন। তারপরও অনেকক্ষেত্রে এই ধরনের মামলা চালু রয়েছে। তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, সিডিউল ঘোষণার আগে যে পুলিশ গায়েবি মামলা করেছে, সিডিউল ঘোষণার পর তার পক্ষে রাতারাতি পাল্টে গিয়ে নির্বাচনে নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করা কি সম্ভব? পুলিশ নির্বাচনে সব থেকে বড় সহায়ক শক্তি উল্লেখ করে বলেন, পুলিশ নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন না করলে নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়বে।
গায়েবি মামলা ইস্যুতে ইসিতে দেয়া বিএনপির আবেদন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, কিছু সংখ্যক গায়েবি মামলার আসামিদের তালিকা বিরোধী দল থেকে নির্বাচন কমিশনে পাঠানো হয়েছে। মামলাগুলো পুরনো হলেও এসব মামলায় অজ্ঞাতনামা আসামিদের অনেকের আদালত থেকে জামিন নেয়া হয়তো সম্ভব হবে না। কোনো কোনো সম্ভাব্য প্রার্থীর বিরুদ্ধে মামলা থাকার কারণে তারা প্রচারকাজ চালাতে ভয় পাচ্ছেন। এই ভীতি সর্বক্ষেত্রে অমূলক নয়। নির্বাচনী ব্যবস্থাপনাকে স্বাভাবিক রাখার স্বার্থে নির্বাচন-পূর্ব সময়ে প্রার্থীরা যাতে হয়রানির শিকার না হন, সেজন্য ব্যবস্থা নেয়া দরকার। এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশন থেকে যে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে, তা যথাযথভাবে প্রতিপালন করা প্রয়োজন।
তিনি বলেন, গ্রেফতারের বিষয়ে উচ্চ আদালতের যে নির্দেশনা রয়েছে তা কোথাও প্রতিপালন হচ্ছে না। নির্দেশনাটিতে মানবিক অধিকার ও মানবিক মর্যাদা সমুন্নত রাখার যে অভিব্যক্তি রয়েছে, তা প্রতিপালিত হলে পুলিশের আচরণবিধি লঙ্ঘনের প্রবণতা অনেকাংশে কমে যেতে পারত। মাহবুব তালুকদার বলেন, কমিশন আশ্বাস দিলেও সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড কার্যকর ছিল না। নির্বাচনে সবার জন্য সমান সুযোগ তৈরিতে পুলিশের বিরাট ভূমিকা রয়েছে। পুলিশ সবার সঙ্গে সমান আচরণ করলে তা সম্ভব হতে পারে।
নির্বাচনী কর্মকর্তাদের তথ্য যাচাই প্রসঙ্গে তিনি বলেন, নির্বাচন কর্মকর্তাদের তথ্য সংগ্রহে পুলিশ দুই মাস আগেই মাঠে নেমেছে। তারা প্রিসাইডিং, সহকারী প্রিসাইডিং অফিসার ও পোলিং কর্মকর্তাদের বিষয়ে নানা ধরনের তথ্য সংগ্রহ এবং জিজ্ঞাসাবাদ করছে। এই ধরনের তথ্যানুসন্ধানে পুলিশকে কোনো নির্দেশনা দেয়া হয়নি। কে কী উদ্দেশ্যে এসব কর্মকাণ্ড করছে তা রহস্যজনক। অতি উৎসাহী কিছু পুলিশ সদস্যের এই কর্মকাণ্ডে ব্যাপক বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছে, যার দায় কমিশনের ওপর এসে পড়ে।
এবারের সংসদ নির্বাচনকে গুরুত্বপূর্ণ আখ্যায়িত করে এই কমিশনার বলেন, শুধু দেশবাসী নয়, বিশ্ববাসী আমাদের নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। এই নির্বাচন আমাদের আত্মসম্মান সমুন্নত রাখার নির্বাচন। আমরা কোনোভাবেই এ নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ হতে দিতে পারি না। আমরা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে তার দায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারীবাহিনীর ওপর বর্তাবে। আর আইনশৃঙ্খলা বাহিনী প্রশ্নবিদ্ধ হলে আমরাও তার দায় এড়াতে পারব না। আশা করি, জাতির এই ক্রান্তিলগ্নে আমাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে আমরা দেশবাসীর প্রত্যাশা পূরণ করতে পারব।