সাতক্ষীরা-৪ শ্যামনগর আসনে জামায়াতের প্রার্থীর জনপ্রিয়তা ঠেকাতে আ’লীগের নানা কৌশল

ক্রাইমর্বাতা রিপোর্ট: সাতক্ষীরা:: সাতক্ষীরা-৪ শ্যামনগর আসনে বিশদলীয় জোট মনোনিত জামায়াতের প্রার্থী মুক্তি যোদ্ধা গাজী নজরুল ইসলামের জনপ্রিয়তা ঠেকাতে মাঠে নেমেছে সরকার দলীয় প্রার্থীর সন্ত্রাসী বাহিনীসহ পুলিশ প্রশাসন। এরই অংশ হিনেবে নজরুল ইসলামের মামলা পরিচালনাকারী আইনজীবি এড.আবু বক্কর সিদ্দিককে বিনা ওয়ারেন্টে সাতক্ষীরা কোট চত্ত্বর থেকে আটক করে গতকাল কারাগারে পাঠানো হয়েছে। বিষয়টি জেলা রির্টানিং কর্মকর্তাকে জানানোর পরও কোন সূরাহ পায়নি নজরুল ইসলাম বলে তিনি অভিযোগ করেন। গোটা শ্যামনগর উপজেলা ব্যাপি ধরপাকড় অব্যাহত রয়েছে। পুলিশ বিএনপি জামায়াতের নেতাকর্মীদের বাড়ি বাড়ি যেয়ে গ্রেফতার করছে। বাড়িতে না পেলে হুমকি-ধামকি দেওয়া হচ্ছে। নির্বাচনি সিডিউয়েল ঘোষণার পর শুধু শ্যামনগর উপজেলা থেকে বিএনপি জামায়াতের শতাধীক নেতাকর্মীকে আটক করেছে পুলিশ। পুলিশ বলছে তারা শুধু অপরাধীদের আটক করছে।
সাতক্ষীরা-৪ (শ্যামনগর-কালিগঞ্জ আংশিক) আসনে মোট ভোটার ৩ লাখ ৯৩ হাজার ৭২৬। এরমধ্যে পুরুষ ভোটার ১ লাখ ৯৭ হাজার ৯২৫ ও নারী ভোটার ১ লাখ ৯৫ হাজার ৮০১ জন। অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচন পর্যন্ত আসনটি দেবহাটা ও কালিগঞ্জ উপজেলা গঠিত ছিল।
এছাড়া শ্যামনগর উপজেলা নিয়ে গঠিত ছিল সাতক্ষীরা-৫ আসন। বর্তমানে দেবহাটা উপজেলা এবং কালিগঞ্জ উপজেলার ৪টি ইউনিয়ন যুক্ত করা হয়েছে সাতক্ষীরা-৩ আসনের (আশাশুনি উপজেলাসহ) সাথে। অপরদিকে সাবেক সাতক্ষীরা-৫ আসন বিলুপ্ত করে শ্যামনগর উপজেলা এবং কালিগঞ্জের ৮টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠন করা হয়েছে সাতক্ষীরা-৪ আসন।
আসনটি ধরে রাখতে মরিয়া হয়ে উঠেছে আ’লীগ অন্যদিকে আসনটি পুনুরুদ্ধার করতে জোর তৎপরতা চালাচ্ছে জামায়াত। যে কারণে জামায়াতের প্রার্থীকে টার্গেট করে মাঠে নেমেছে আ’লী ও সরকার দলীয় প্রশাসন।
এত কিছুর পরও আ’লীগের প্রার্থী ভোটারদের আস্থা অর্জন করতে পারছে না। পুলিশ যত বেশি এলাকাতে যাচ্ছে সাধারণ মানুণ তত বেশি আ’লীগের প্রতি আস্থা হারাচ্ছে। আ’লীগের কয়েক জন নেতা কর্মীর সাথে কথা হয়। তারা জানান, নিরপেক্ষ ভোট হলে পুলিশের কারণে আ’লীগের পরাজয় নিশ্চিত। এর পরও ভোটরা ধানের শীষে প্রতি আস্থাশীল।
জামায়াতের প্রার্থী নজরুল ইসলামের জনপ্রিয়তা ঠেকাতে খোদ প্রার্থীও বিরুদ্ধে ৩০টি গায়েবী মামলা দায়ের করা হয়েছে। ্উপজেলার প্রতিটি ইউনিয়নে বিএনপি ও জামায়াতের বাছাইকৃত সকল নেতাকর্মীদের নামে মামলা দেয়া হয়েছে। ভোটরদের ভয় ভীতি দেখানো হচ্ছে। ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানদের ব্যবহার করে বিএনপি জামায়াত সমর্থিতিত লোক জনের সরকারী অনুদান বন্ধের হুমকী দেয়া হচ্ছে।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এ আসনে নৌকা প্রতীক নিয়ে বিনা প্রতিদ্বন্বীতায় বিজয়ী হন উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এসএম জগলুল হায়দার। তার কোন প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল না।
২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হয় নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এ নির্বাচনে সাতক্ষীরা-৪ আসনে মোট ভোটার ছিলেন ৩ লাখ ৩ হাজার ৯০৯ জন। এরমধ্যে বৈধ ভোট ছিল ২ লাখ ৭১ হাজার ৪২৭ জন এবং অবৈধ ভোট ছিল ১ হাজার ১৫৭। না ভোট ছিল ১। এ নির্বাচনে জাতীয় পার্টির এইচএম গোলাম রেজা লাঙল প্রতীক নিয়ে ১ লাখ ৫১ হাজার ১৪৬ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী জামায়তের গাজী নজরুল ইসলাম দাড়িপাল্লা প্রতীকে ভোট পান ১ লাখ ১৭ হাজার ৮০৫ ভোট।
২০০১ সালের পয়লা অক্টোবর অনুষ্ঠিত ৮ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এ আসনে জাতীয় পার্র্পির (নাফি গ্রুপ) কাজী আলাউদ্দিন ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে ১ লাখ ৮ হাজার ১৭২ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগের প্রর্থী নৌকা প্রতীকে পান ৬৬ হাজার ৫৬১ ভোট।
১৯৯৬ সালের ১২ জুন অনুষ্ঠিত হয় ৭ম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এ নির্বাচনে তৎকালীন সাতক্ষীরা-৪ আসনে জাতীয় পার্টির শাহাদত হোসেন লাঙল প্রতীক নিয়ে ৪৬ হাজার ৭৩০ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগের মনসুর আহমদ নৌকা প্রতীকে পান ৪৪ হাজার ২৭২ ভোট। বিএনপির ওয়াজেদ আলী বিশ্বাস ৩২ হাজার ৬৩৫ ভোট এবং জামায়তের আব্দুল গফফার পান ৩০ হাজার ১৫১ ভোট। ঐ নির্বাচনে তৎকালীন সাতক্ষীরা-৫ আসনে আওয়ামী লীগের একে ফজলুল হক ৪০ হাজার ৭২৫ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন। জামাতের গাজী নজরুল ইসলাম ৩১ হাজার ১৭২ ভোট, জাতীয় পাটির এড. আবুল হোসেন ২৫ হাজার ৬১৬ ভোট এবং বিএনপির অধ্যক্ষ আব্দুল হক পান ১৩ হাজার ৮০১ ভোট।
১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি সব দলের বর্জনের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠিত ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তৎকালীন সাতক্ষীরা-৪ আসনে বিএনপির ওয়াজেদ আলী বিশ্বাস এ আসন থেকে নির্বাচিত হন। এ নির্বাচনে তৎকালীন সাতক্ষীরা-৫ আসনে নির্বাচিত হন বিএনপির অধ্যক্ষ আব্দুল হক।
১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তৎকালনি সাতক্ষীরা-৪ আসনে আওয়ামী লীগের মনসুর আহমদ নৌকা প্রতীক নিয়ে মনসুর আহমদ ৪৪ হাজার ২২৫ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী জামায়তের জিএম আব্দুল গফফার গাজী পান ৪১ হাজার ৫৫২ ভোট। এই নির্বাচনে বিএনপির শাহাদাত হোসেন ২৬ হাজার ৬৭০ ভোট এবং জাতীয় পাটির এড. এম মুনসুর আলী ১৭ হাজার ৩৩২ ভোট পান।
ঐ নির্বাচনে তৎকালীন সাতক্ষীরা-৫ আসনে ৪৫ হাজার ৭৭৬ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন জামায়াতের প্রার্থী গাজী নজরুল ইসলাম। আওয়ামী লীগের একে ফজলুল হক ৩৭ হাজার ৩০৩ ভোট, জাতীয় পাটির আব্দুল হামিদ ৭ হাজার ৪৭৭ ভোট ও বিএনপির নজরুল ইসলাম ৩ হাজার ৮৯৬ ভোট পান।
১৯৮৮ সালের ৩ মার্চ সকল দলের বর্জনের মধ্যদিয়ে অনুষ্ঠিত চতুর্থ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তৎকালীন সাতক্ষীরা-৪ আসনে নির্বাচিত হন জাতীয় পাটির এড. এম মুনসুর আলী। সাতক্ষীরা-৫ আসনে নির্বাচিত হন জাতীয় পাটির এড. আবুল হোসেন।
১৯৮৬ সালের ৭ মে অনুষ্ঠিত তৃতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তৎকালীন সাতক্ষীরা-৪ আসনে ৪১ হাজার ১৫৯ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন আওয়ামী লীগের মুনসুর আহমেদ। বিএনপির এড. এম মুনসুর আলী পান ৩৯ হাজার ৩৯৫ ভোট। এ নির্বাচনে সাতক্ষীরা-৫ আসনে ২৫ হাজার ৬৩ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন জাতীয় পাটির এড. আবুল হোসেন। আওয়ামী লীগের একে ফজলুল হক ২১ হাজার ৮৯৭ ভোট এবং আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী বখতিয়ার আহমেদ পান ১৪ হাজার ১৭৭ ভোট।
১৯৭৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তৎকালীন সাতক্ষীরা-৪ আসনে বিএনপির এড. এম মুনসুর আলী ৩৫ হাজার ৬৬৯ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন। আওয়ামী লীগ এড. এএফএম এন্তাজ আলী ১৭ হাজার ৩১৫ ভোট ও জাসদের ক্যাপ্টেন শাহজাহান মাস্টার পান ১৩ হাজার ৬১২ ভোট। ঐ নির্বাচনে তৎকালীন সাতক্ষীরা-৫ আসনে বিএনপির ডা. আফতাবুজ্জামান ২৪ হাজার ৯১৫ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন। আওয়ামী লীগের একে ফজলুল হক পান ৯ হাজার ১২৭ ভোট।
১৯৭৩ সালের ৭ মর্চি অনুষ্ঠিত প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সাতক্ষীরা-৪ আসনে ৬২ হাজার ৭৪০ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন আওয়ামী লীগের এড. এএফএম এন্তÍজ আলী। ঐ নির্বাচনে জাসদের ক্যাপ্টেন শাহজাহান মাস্টার পান ১৩ হাজার ৭৫৭ ভোট। ঐ নির্বাচনে সাতক্ষীরা-৫ আসনে আওয়ামী লীগের মো. মোহাসিন ৪৫ হাজার ১৪৮ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন। জাসদের বিশ্বনাথ দাশ পান ৮ হাজার ১৮৮ ভোট।
সাতক্ষীরা-৪ আসনে ধানের শীষ প্রতীকে মনোনয়নপত্র দাখিলকারী জামায়াত নেতা গাজী নজরুল ইসলামের বিস্ফোরক দ্রব্য্য, অস্ত্র ও বিশেষ ক্ষমতা আইনের ৩০টি মামলা রয়েছে। এছাড়া তার নামে ১০ ভরি স্বর্ণসহ ২৭ লাখ ৮১ হাজার ৫২২ টাকার অস্থাবর ও এক হাজার ৬৭ একর কৃষি জমি ও ১৭.৫১ বিঘা অকৃষিসহ ৯ লাখ ১০ হাজার টাকার স্থাবর সম্পদ রয়েছে। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মনোনয়নপত্রের সাথে দাখিলকৃত হলফনামায় তিনি এ তথ্য উল্লেখ করেছেন।
অন্যদিকে আ’লীগের প্রার্থী জগলুলের স্থাবর সম্পদ বেড়েছে ৮গুণ, অস্থাবর ৩ গুণ
সাতক্ষীরা-৪ আসনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী এসএম জগলুল হায়দারের নামে দুটি মোটরগাড়িসহ (একটি করমুক্ত) ৪৬ লাখ ২০ হাজার টাকার অস্থাবর সম্পদ ও এক কোটি ৮০ লক্ষ ৭৯ হাজার ৬০০ টাকার স্থাবর সম্পদ রয়েছে। ৫ বছর আগে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় তার একটি মোটরসাইকেলসহ ১৬ লক্ষ ৫০ হাজার অস্থাবর ও ২১ লক্ষ টাকার স্থাবর সম্পদ ছিল। এই হিসাবে তার অস্থাবর সম্পদ বেড়েছে প্রায় তিনগুণ। আর স্থাবর সম্পদ বেড়েছে সাড়ে ৮গুণ।একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মনোনয়নপত্রের সাথে দাখিলকৃত হলফনামায় তিনি এ তথ্য উল্লেখ করেছেন।
জামায়াতের প্রার্থী মুক্তি যোদ্ধা গাজী নজরুল ইসলাম জানান, এভাবে গ্রেফতার,হয়রানি ও হুমকি-ধামকি অব্যাহত রাখলে মানুষ ভোট কেন্দ্রে যাবে কি করে। তার মামলা পরিচালনাকে আটক করেছে পুলিশ। বিষয়টি জেলা রির্টার্নি কর্মকর্তাকে জানানোর পরর কোন সূরাহ হয়নি।
উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এসএম জগলুল হায়দার জানান,ভোটের পরিবেশ খুব ভালই আছে। তার সরকারের উন্নয়ন কর্মকান্ডের সুফল ভোগ করছে সাধারণ জনগণ। তাই এবারও ভোটাররা তাকেই ভোট দিয়ে জয়যুক্ত করবেন।
এবিষয়ে সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক, রিটার্নিং অফিসার এস এম মোস্তফা কামাল বলেন, সাতক্ষীরা জেলায় চমৎকার এক নির্বাচনের মডেল সৃষ্টি করা হবে। যেনো মানুষ কয়েক যুগ এই মডেল নির্বাচনের কথা মনে রাখেন। তিনি আরো বলেন, এবারের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটাররা যাতে পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে পারেন, সেই ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হবে।

Check Also

মালয়েশিয়ার পাম তেলে ইইউ’র নিষেধাজ্ঞা বাংলাদেশের শ্রমবাজারে অশনি সংকেত

বন উজাড়, কার্বন নির্গমনের ঝুঁকি এবং পরিবেশের ভারসাম্য নষ্টগত কারণ দেখিয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ মালয়েশিয়ার …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।