চীন ও ভারতের জন্য হাসিনার জয়ের তাৎপর্য কী

ক্রাইমর্বাতা রিপোট:  প্রত্যাশিতভাবেই বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার রোববার জাতীয় নির্বাচনে জিতেছে। তার দল এ নিয়ে মোট ৪ বার ও টানা তৃতীয়বার মসনদে এসেছে। আওয়ামী লীগ এই ১০ বছর ধরে বাংলাদেশ শাসন করেছে। দলটির নেতৃত্বাধীন মহাজোট ৩০০ আসনে ২৮৮টিতেই জয় পেয়েছে। তবে এই জয়ের পাশাপাশি নির্বাচনের দিন সহিংসতা দেখা গেছে। উঠেছে কেন্দ্র-ওয়ারি ভোট কারচুপির অভিযোগ।
প্রধান বিরোধী দল বিএনপি সহ বিরোধী জোট জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নির্বাচনী ফলাফল অস্বীকার করে পুনঃনির্বাচনের দাবি জানিয়েছে।
ঘরোয়াভাবে বাংলাদেশের রাজনীতিতে দুই প্রধান খেলোয়াড় শেখ হাসিনা ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া। খালেদা জিয়া এখন দুর্নীতির অভিযোগে কারাগারে। তাদের মধ্যকার ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব ও তীব্র তিক্ততা বাংলাদেশের রাজনীতির প্রধান বৈশিষ্ট্য।

তবে আন্তর্জাতিকভাবে দেশটিকে দেখা হয় দুই সমানভাবে আধিপত্যশীল দুই শক্তির মাঝে পিষ্ট। এই দুই শক্তিরই রয়েছে নিজস্ব কৌশলগত স্বার্থ।
বাংলাদেশেই এই চার দশকব্যাপী রাজনীতির মূল বৈশিষ্ট্য হলো প্রতিদ্বন্দ্বীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ও কুৎসা রটানো। আওয়ামী লীগের এই নির্বাচনী বিজয় হয়তো চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে। তবে ফলাফলে বড় ধরণের পরিবর্তন হওয়ার সম্ভাবনা কম। এটি নিশ্চিত যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার দল বাংলাদেশকে আরও ৫ বছর পরিচালিত করবে। এই এক দশকে যেই আর্থসামাজিক অগ্রগতি বাংলাদেশ করতে সক্ষম হয়েছে তা আরও দৃঢ় করতে পারবে।
১৬ কোটি জনসংখ্যার দেশ বাংলাদেশ। ১৯৭১ সালে জন্ম হওয়া দেশটি আগে পাকিস্তানের অংশ ছিল। পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক শাসকদের হাতে জাতিগত ও রাজনৈতিক বৈষম্যের শিকার ছিল এখানকার অধিবাসীরা। যেই যুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীন হয় এতে ৩০ লাখ মানুষ মারা গেছে বলে সরকারীভাবে দাবি করা হয়। বাংলাদেশের জন্মের সময় অনেকটা ধাত্রীর ভূমিকায় ছিল ভারত। এর মাধ্যমে মূলত দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক মানচিত্র পরিবর্তিত হয়ে যায়।
দেশ স্বাধীনের পর প্রথম দিনগুলো ছিল রক্তাক্ত। দেশের প্রতিষ্ঠাতা হাসিনার পিতা শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৫ সালের আগস্টে নিহত হন। ১৯৯৬ সালে যখন শেখ হাসিনা প্রথমবারের মতো ক্ষমতায় আসেন, তখন বাংলাদেশের জিডিপি ছিল ৪৬০০ কোটি ডলার। মাথাপিছু আয় ছিল ৪০০ ডলার। সেই জিডিপি এখন ২৬৫০০ কোটি ডলার। দেশের মাথাপিছু আয় এখন ১৬২০ ডলার। আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, হাসিনা চরমপন্থা ও ইসলামি মৌলবাদী শক্তিকে কঠিনভাবে প্রতিহত করেছেন।
তবে হাসিনার বিরুদ্ধে কর্তৃপরায়ণতা ও খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার অভিযোগ রয়েছে। তার ঘরোয়া এজেন্ডা দৃঢ় করা এবং ভারত ও চীনের সঙ্গে সম্পর্কে ভারসাম্য আনাই হাসিনার বর্তমান চ্যালেঞ্জ। ভারত যদিও বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করেছে, দুই দেশের সম্পর্ক বিভিন্ন ক্ষেত্রেই জটিল।
বেইজিং-এর সঙ্গে সম্পর্ক দৃঢ় করলেও হাসিনা নয়া দিল্লির সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছেন। বর্তমানে, চীন হলো বাংলাদেশের বৃহৎ বাণিজ্যিক আংশীদার ও শীর্ষ সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহকারী। ভারতের জন্য এর আবার বিভিন্ন তাৎপর্য রয়েছে। যেমন, বাংলাদেশ শিগগিরই চীন থেকে কেনা সাবমেরিন পরিচালনা শুরু করবে। ফলে বঙ্গোপসাগরের সামরিক চরিত্রে আরও জটিল হয়েছে।
বেইজিং-এর কাছে বাংলাদেশ একটি আকর্ষনীয় কৌশলগত স্থান। প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং-এর বেল্ট অ্যান্ড রোড উদ্যোগের অংশ বাংলাদেশ। চীন এই উদ্যোগের অংশ হিসেবে ঢাকাকে গুরুত্ব দেয়। এছাড়া বাংলাদেশে ২৪০০ কোটি ডলারের বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতিও দিয়েছে দেশটি। তবে হাসিনা চীনের প্রতিশ্রুতি নিয়ে বেশ সতর্ক। বিশেষ করে, মালয়েশিয়া, শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপের ঘটনাপ্রবাহ তাকে সতর্ক করেছে। সেখানে চীন রীতিমত ঋণের-ফাঁদ পেতেছে।
নিঃসন্দেহে ঢাকার জন্য গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্ক হলো নয়াদিল্লির সঙ্গে সম্পর্ক। সম্প্রতি এ বিষয়টি অনেকেই বলছেন যে, ভারতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আঞ্চলিক প্রতিবেশী হলো বাংলাদেশ; পাকিস্তান নয়। ভারতকে এমনভাবে কাজ করতে হবে যাতে ঢাকাকে উভয় সংকটে পড়তে না হয়। ভারতকে এ-ও মনে রাখতে হবে যে, বাংলাদেশ এমন একটি জাতি যেটি ন্যায়সঙ্গত আর্থ-সামাজিক অগ্রগতির নিদর্শন। দেশটির গণতান্ত্রিক বৈশিষ্ঠ্য রয়েছে। এছাড়া দেশটির ডিএনএ মধ্যপন্থী ইসলামঘেষাঁ, যেটি নিজের সংখ্যালঘু গোষ্ঠীকে সুরক্ষিত রাখে।
চীনের জন্য সবচেয়ে দীর্ঘমেয়াদী চাওয়া হবে ঢাকার সঙ্গে সম্পর্ক এমনভাবে পরিচালিত করা যাতে ভারতের উদ্বেগ হ্রাস পায়। এছাড়া চীন-বাংলাদেশ ও ভারতকে যুক্ত করে একটি আঞ্চলিক ‘উইন-উইন’ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। এমনও হতে পারে যে, এটিই হতে পারে বর্তমানে অস্থিতিশীল চীন-পাকিস্তান-ভারত ত্রিমাত্রিক সম্পর্কের জন্য দৃষ্টান্ত।
(কমোডোর সি উদয় ভাস্কর ভারতের নয়াদিল্লি-ভিত্তিক থিঙ্কট্যাংক সোসাইটি ফর পলিসি স্টাডিজের পরিচালক। তার এই নিবন্ধ হংকং-এর সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট থেকে নেওয়া হয়েছে। 

Please follow and like us:

Check Also

ফরিদপুরে বাস-পিকআপ সংঘর্ষে নিহত ১৩

ফরিদপুরের কানাইপুরে বাস ও পিকআপ ভ্যানের সংঘর্ষে ১৩ জন নিহত হয়েছেন। এ ছাড়া আহত হয়েছেন …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।