শ্রমিকদের আন্দোলনের পর চলছে শ্রমিক ছাটায়: রয়েছে গ্রেফতার আতঙ্ক

শ্রমিকদের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে মজুরিকাঠামো সমন্বয়
• আন্দোলনরত শ্রমিকেরা চাকরি নিয়ে টানাটানিতে
• ছাঁটাই ও মামলার প্রতিবাদে শ্রমিকেরা মাঠে নামবেন

ক্রাইমর্বাতা ডেস্করিপোট: শ্রমিকদের এক সপ্তাহের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে মজুরিকাঠামো সমন্বয় করা হয়েছে। অনেক শ্রমিক এখন কাজেও ফিরেছেন। কিন্তু আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত সাভার-আশুলিয়া এলাকার শ্রমিকেরা চাকরি নিয়ে টানাটানিতে পড়েছেন। তাঁরা গ্রেপ্তার-আতঙ্কে রয়েছেন।

এর মধ্যেই বিভিন্ন কারখানা কর্তৃপক্ষ চুরি, ভাঙচুর, মারধর, কারখানার ক্ষতি করা ও হুমকি দেওয়ার অভিযোগে প্রায় আড়াই হাজার শ্রমিককে আসামি করে মামলা করেছে। পুলিশ ২০ জন শ্রমিককে গ্রেপ্তার করেছে। সব মিলিয়ে শ্রমিকদের মধ্যে শঙ্কা, অস্বস্তি ও আতঙ্ক বিরাজ করছে।

শ্রমিক সংগঠনগুলোর নেতারা বলছেন, মামলায় নাম উল্লেখ করা হয়—এমন শ্রমিকদের প্রায় সবাই চাকরিচ্যুত হয়েছেন। আসামিদের মধ্যে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক নারী শ্রমিক রয়েছেন। ছাঁটাই ও মামলার প্রতিবাদে তাঁরা কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামবেন বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ গার্মেন্টস শ্রমিক সংহতির সভাপ্রধান তাসলিমা আক্তার।

জানতে চাইলে তৈরি পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি মো. সিদ্দিকুর রহমান গত রাতে বলেন, ‘গত মঙ্গলবার সচিবালয়ে সরকার, মালিক ও শ্রমিকদের ত্রিপক্ষীয় বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছে, কোনো নিরীহ শ্রমিককে হয়রানি করা যাবে না। শুধু সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতেই বিশৃঙ্খলায় জড়িত ব্যক্তিদের আইনের আওতায় নেওয়া যাবে। সেই নির্দেশনা মেনেই কয়েকটি কারখানা মামলা করেছে। কোনো নিরীহ শ্রমিককে হয়রানি করা হচ্ছে না। শ্রমিক ছাঁটাইয়ের বিষয়ে কোনো শ্রমিক কিংবা শ্রমিকনেতা আমাদের কাছে অভিযোগ করেনি। বিষয়টি আমার জানা নেই।’

ইতিমধ্যে আশুলিয়া থানায় আটটি এবং সাভার থানায় দুটি মামলা হয়েছে। আশুলিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রিজাউল হক গতকাল বৃহস্পতিবার  বলেন, শ্রমিক অসন্তোষের ঘটনায় তাঁর থানায় দায়ের হওয়া আটটি মামলায় ১২ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আরও কয়েকটি মামলা প্রক্রিয়াধীন, রাতে এগুলো হতে পারে। আর সাভার থানার পুলিশ জানিয়েছে, এই থানার দুটি মামলায় তারা আটজনকে গ্রেপ্তার করেছে।

গতকাল জামগড়া এলাকায় কথা হয় খুশি বেগমসহ কয়েকজন নারী শ্রমিকের সঙ্গে। তাঁদের পরিচিত কয়েকজন পুরুষ সহকর্মী মামলার আসামি হয়েছেন। তাঁরা কারখানায় আসছেন না। তাঁরা মামলার বিষয়ে তদবির করার জন্য এখন বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন।

বাংলাদেশ গার্মেন্টস অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল শ্রমিক ফেডারেশনের সাভার-আশুলিয়া অঞ্চলের আঞ্চলিক কমিটির সভাপতি মো. ইব্রাহিম  বলেন, চাকরিচ্যুত হয়ে তাঁদের কাছে বিপুল শ্রমিক আসছেন। এফএনএফ অ্যাপারেলস, আল গাউসিয়া গার্মেন্টস, নিট এশিয়া, ডনলিয়ন ১ ও ২, হলিউড গার্মেন্টস, এফজিএস ডেনিম, কেআরএফ গার্মেন্টস থেকে চাকরিচ্যুত শ্রমিকেরা যোগাযোগ করছেন। তাঁরা মামলারও ভয় পাচ্ছেন। আরেকটা ভয় হচ্ছে, চাকরিচ্যুত শ্রমিকদের নাম ‘অনলাইনে’ দিয়ে দেওয়া। অর্থাৎ তাঁদের নামগুলো পোশাকমালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর একটা বিশেষ সার্ভারে কালো তালিকাভুক্ত হয়ে থাকে। এরপর ওই সব শ্রমিককে আর কোনো কারখানাই কাজে নেবে না।

বিপ্লবী গার্মেন্টস ও টেক্সটাইল শ্রমিক ফোরামের আহ্বায়ক শহীদুল ইসলাম বলেন, সাভারের উলাইল এলাকার কয়েকটি কারখানায় তাঁদের বেশ কিছু সদস্য মামলার আসামি হয়েছেন, চাকরিও হারিয়েছেন। ওই সব শ্রমিকের জন্য সংগঠনের নেতারা এখন আদালতে দৌড়াচ্ছেন। তিনি আরও বলেন, চাকরিচ্যুত শ্রমিকেরা অন্য কারখানায় কাজ খোঁজা শুরু করেছেন। তবে অতীতে দেখা গেছে, এভাবে চাকরিচ্যুত শ্রমিকদের একটা অংশকে পেশা বদলাতে হয়েছে।

মামলায় এলাকাছাড়া
স্থানীয় বাড়ির মালিক ও শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মামলার পর গ্রেপ্তারের ভয়ে অনেক শ্রমিক এলাকা ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছেন।

আশুলিয়া থানা সূত্রে জানা গেছে, ৮ জানুয়ারি চারাবাগ নিটিং অ্যান্ড ডাইং নামের একটি কারখানার নিরাপত্তা কর্মকর্তা আবদুস সালাম ৫৫ জনের নাম উল্লেখ করে ৩৫৫ জন শ্রমিকের বিরুদ্ধে কারখানায় ভাঙচুরসহ পাঁচ লাখ টাকার তৈরি পোশাক চুরির অভিযোগে মামলা করেন।

আশুলিয়ার বাড়ইপাড়া এলাকার মাহমদ ফ্যাশনসের ২৯ জন শ্রমিকের নাম উল্লেখ করে ৫৪ জনের বিরুদ্ধে ৯ জানুয়ারি মামলা হয়। মামলায় শ্রমিকদের বিরুদ্ধে কর্মকর্তাদের মারধর, তৈরি পোশাক চুরিসহ হুমকি দেওয়ার অভিযোগ আনা হয়। একই দিন কাঠগড়া এলাকার অরবিট অ্যাপারেলসের ৫০ জন অজ্ঞাতনামা শ্রমিকের বিরুদ্ধে একই ধরনের অভিযোগে মামলা হয়।

১০ জানুয়ারি কাঠগড়া এলাকার এ আর জিন্স প্রোডিউসার নামের একটি পোশাক কারখানার ৬১ জন শ্রমিকের নাম উল্লেখ করে ৩১১ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়। মামলায় শ্রমিকদের বিরুদ্ধে কর্মকর্তাদের মারধর, ভাঙচুর ও ল্যাপটপ চুরির অভিযোগ আনা হয়। একই দিন নরসিংহপুরের নিট এশিয়া নামের একটি পোশাক কারখানার ৫০ জন শ্রমিকের বিরুদ্ধে কর্মকর্তাদের মারধর ও ভাঙচুরের অভিযোগে মামলা হয়।

সাভার থানায় ১৩ জানুয়ারি ২৫ জনের নাম উল্লেখ করে ও অজ্ঞাতনামা আরও ১৬৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা করে জে কে গ্রুপ। মামলায় মারধর, চুরি ও ক্ষতি করার অভিযোগ আনা হয়েছে।
এর আগে ৮ জানুয়ারি শিল্প পুলিশ অজ্ঞাতনামা দেড় হাজার শ্রমিকের বিরুদ্ধে সাভার থানায় মামলা করেছে।

ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার শাহ মিজান শাফিউর রহমান বলেন, যাঁরা অপরাধ করেছেন, তাঁদের বিরুদ্ধেই মামলা হচ্ছে। কোনো নিরীহ শ্রমিক যাতে হয়রানির শিকার না হন, সেদিকে খেয়াল রাখা হচ্ছে।

গতকাল কাঠগড়া এলাকার এ আর জিন্স প্রোডিউসারের সামনে গিয়ে দেখা যায়, কারখানার সামনে সাময়িক বরখাস্ত হওয়া ১৭২ জন শ্রমিকের তালিকা টাঙানো। এখানকার কয়েকজন শ্রমিক বলেন, সাভার ও আশুলিয়ার অন্য সব কারখানার শ্রমিকদের মতো মজুরিকাঠামোর পরিবর্তনের দাবিতে তাঁরাও কাজ না করে কারখানা থেকে বের হয়েছিলেন। তাঁরা কারখানা ভাঙচুর, সড়ক অবরোধ বা কাউকে মারধর করেননি। এরপরও তাঁদের গণহারে বরখাস্ত করা হয়েছে। সাময়িক বরখাস্ত হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে অর্ধেকের নামেই মামলা হয়েছে। পুলিশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তারও করেছে।

জানতে চাইলে সম্মিলিত গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি নাজমা আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, ‘নিরীহ শ্রমিকেরা যেন ছাঁটাই এবং হয়রানির শিকার না হন, বিষয়টি গত মঙ্গলবারের বৈঠকে আমরা বারবার বলেছি। নিরীহ শ্রমিকদের ছাঁটাই ও গ্রেপ্তার করা হলে সাধারণ শ্রমিকদের মধ্যে কষ্ট থেকে যাবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘মামলা, ছাঁটাই ও পুলিশের ভয় দেখিয়ে শ্রমিকদের হয়তো সাময়িকভাবে দমানো যায়। তবে ভবিষ্যতের জন্য এসব ভালো না। তা ছাড়া এককভাবে শ্রমিকদের দোষ দিয়ে লাভ হবে না। সরকারের কাছে অনুরোধ, মালিকদের কোথায় গাফিলতি আছে, সেটিও খুঁজে বের করা দরকার। কারণ পোশাকশিল্প বড় হলেও খাতটির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা পরিপক্ব হয়ে ওঠেননি।প্রথম আলো

Please follow and like us:

Check Also

ইসরায়েলের অনুরোধে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের জরুরি বৈঠক

প্রতিশোধ নিতে ইসরাইলে নজিরবিহীন হামলা চালিয়েছে ইরান। শনিবার দিবাগত রাতে ভয়াবহ হামলা চালায় ইরান। ফলে …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।