হাইকোর্টে জামিনপ্রার্থীদের ভিড় জামিন মিলেছে সেই ভিক্ষারি তারা মিয়ার

ক্রাইমবার্তা রিপোটঃ   আগাম জামিন পেয়ে শারীরিক প্রতিবন্ধী তারা মিয়ার মুখে হাসির ঝিলিক। মনের কষ্ট চাপা রেখে বলেছেন, আমি খুশি। দাবি জানাই মামলা থেকে অব্যাহতি দেয়ার। সুনামগঞ্জ জেলার জামালগঞ্জের অতি দরিদ্র তারা মিয়ার দুটি হাতই অকেজো। জন্মগতভাবেই ডান হাতটি অস্বাভাবিক চিকন। নাড়াতেই কষ্ট হয়। কিছু ধরতে বা কাজ করতে পারেন না। আর বাম হাতটি তুলনামূলকভাবে লম্বা ও বাঁকা।

এই তারা মিয়াই   আক্রমণ করেছেন পুলিশের উপর- এমন অভিযোগ এনে তার বিরুদ্ধে মামলা করে পুলিশ। গত ২৮ ডিসেম্বর মল্লিকপুর বাজারে পুলিশের ওপর হামলার অভিযোগে এ মামলা হয়। আর এ বাজারেই ভিক্ষা করেন তারা মিয়া। মামলায় আসামী করা হয় তারা মিয়াসহ ৫২ জনকে। ওই মামলায় আগাম জামিন নিতে তারা মিয়া গতকাল এসেছিলেন উচ্চ আদালতে। তিনি ছয় সপ্তাহের আগাম জামিন পান।

শুধু তারা মিয়া নয় তার মতো হাজারো জামিন প্রার্থীকে দেখা যায় হাইকোর্টে। আদালতের সামনে গেলেই দেখা যায় জামিন প্রার্থীরা লাইন ধরে আদালতে ঢুকছেন জামিন হলে তারা বের হচ্ছেন এজলাস থেকে। শুনানি চলাকালে জামিন প্রার্থীকে হাত উঁচিয়ে দেখাতে হয় তার উপস্থিতি। আদালতের কর্মচারীরা জামিন আবেদনের নম্বর ধরে ধরে তাদের ডাকেন।

বুধবারও নেত্রকোনা, সিলেট, যশোর, ময়মনসিংহ, সিরাজগঞ্জ, পাবনা, ফরিদপুর, চাঁদপুর ও চট্টগ্রামসহ সারা দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে আগাম জামিন চাইতে এসে সকাল থেকে হাইকোর্টের এনেক্স (বর্ধিত) ভবন চত্বরে অপেক্ষমাণ ছিলেন জামিন প্রার্থীরা। বাড়ি থেকে নিয়ে আসা জামা কাপড়ের পুঁটলি মাথায় দিয়ে অনেককে ক্লান্ত শরীর নিয়ে শুয়ে থাকতে দেখা গেছে। দুপুরে সবাই মিলে খেয়েছেন একসঙ্গে। এলাকার ধনী ব্যক্তি থেকে শুরু করে প্রান্তিক দিনমজুরও একসঙ্গে খাবার খাচ্ছেন।

শেরপুরের ঝিনাইগাতী উপজেলা থেকে এসেছেন ২৩ জন। আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ক্যাম্প পোড়ানোর অভিযোগে দায়ের করা মামলায় জামিন নিতে আসা মালিজিকান্দা গ্রামের ৬০ বছরের সৈয়দুর রহমান বলেন, আমি কৃষি কাজ করি। ভুয়া মামলায় জামিন নিতে এসেছি। তার মামলায় অভিযোগ স্থানীয় আওয়ামী লীগের ক্যাম্পে আগুন দিয়েছে বিএনপির নেতাকর্মীরা। তিনি এ মামলার আসামি। সৈয়দুর রহমান বলেন, আগুন দেয়ার কোনো ঘটনাই ঘটেনি। স্থানীয় আওয়ামী লীগ দলীয় নেতাকর্মীরা ক্যাম্পের চেয়ার টেবিলে নিজেরাই ভেঙ্গে ঘটনা সাজিয়েছে। মামলার বাদী আবদুল বারিক। মামলার অন্য আসামিরা মুখ খুলতে চাননি। তাদের আশঙ্কা পত্রিকায় লেখালেখি হলে তাদের নামে আরো মামলা হতে পারে।

যশোর-৪ আসনের বিএনপি দলীয় ৯৫ নেতা-কর্মীর ছয় সপ্তাহের আগাম জামিন হয়েছে হাইকোর্টে। বাঘারপাড়া উপজেলা বিএনপি সভাপতি ও কেন্দ্রীয় বিএনপির নির্বাহী সদস্য টিএস আইয়ুবসহ অন্য নেতাকর্মীরা চারটি মামলায় এ জামিন পেয়েছেন। ২২শে ডিসেম্বর থেকে ৬ই জানুয়ারি তাদের বিরুদ্ধে মামলাগুলো করে পুলিশ।
বর্তমানে হাইকোর্টের ৮টি বেঞ্চের আগাম জামিনের এখতিয়ার রয়েছে। এর মধ্যে সবক’টি বেঞ্চ আগাম জামিনের আবেদন শুনছেন না।

গত সোমবার বিচারপতি মুহাম্মদ আবদুল হাফিজ ও বিচারপতি মহিউদ্দিন শামীম সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের দ্বৈত বেঞ্চে ৯২০টি পৃথক পৃথক আগাম জামিনের আবেদন শুনানির জন্য ছিল। এক একটি আবেদনে ১৫ থেকে ২০ জন আসামি জামিন প্রার্থী। দ্রুততার সঙ্গে শুনানির পরও ৫০ থেকে ৬০টি আবেদন একদিনে নিষ্পত্তি হচ্ছে। বাকিগুলোর শুনানি না হলে পরের সপ্তাহ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয় আবেদনকারীদের। আগের দিন রোববার ওই বেঞ্চেই জামিন আবেদন ছিল ১০৭২টি। গতকাল বিচারপতি মো. রইস উদ্দিন ও বিচারপতি মো. জাহাঙ্গীর হোসেন সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের দ্বৈত বেঞ্চে ৩২৩টি জামিন আবেদন শুনানির অপক্ষোয় ছিল। এর মধ্যে ৭১টি আবেদনের জামিন নিষ্পত্তি হয়েছে।

একটি বেঞ্চে চার সপ্তাহের আগাম জামিন দেয়া হলেও কোনোটি ছয় সপ্তাহ পর্যন্ত জামিন দিচ্ছেন। সর্বোচ্চ আট সপ্তাহ পর্যন্ত আগাম জামিন দিচ্ছেন হাইকোর্ট। এ সময়ের পরে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে নিজ জেলার দায়রা আদালতে আত্মসমর্পণ করতে হয়।
তারা মিয়ার জামিন
বুধবার বিচারপতি মো. রইস উদ্দিন ও বিচারপতি মো. জাহাঙ্গীর হোসেন সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের দ্বৈত বেঞ্চ তারা মিয়াকে জামিন দেন। তার সঙ্গে মামলার আরো ১০ আসামি জামিন পেয়েছেন। এর মধ্যে তারা মিয়ার বড় ভাই সামসুমিয়াও রয়েছেন।

বেলা ২টা ২৮ মিনিটে তারা মিয়ার জামিন আবেদনের শুনানি শুরু হলে আইনজীবী ব্যারিস্টার মোহাম্মদ আবিদুল হক ইংরেজি পত্রিকা ডেইলি স্টার-এ প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন জমা দেন। আদালত পত্রিকাটি হাতে নিয়ে বলেন, এর মাধ্যমে কি বোঝাতে চাইছেন। জবাবে আইনজীবী বলেন, জামিন আবেদনকারীকে নিয়ে পত্রিকায় একটি প্রতিবেদন প্রকাশ হয়েছে। আইনজীবী বলেন, শারীরিকভাবে যার একটি হাত সম্পূর্ণ অকেজো তার পক্ষে কি পুলিশের ওপর অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে হামলা করা সম্ভব? এ ধরনের মামলা যে সাজানো ও ষড়যন্ত্রমূলক তার প্রমাণ এ মামলা। এরপর আদালত ছয় সপ্তাহের আগাম জামিনের আদেশ দেন।

আদালত থেকে বের হয়ে তারা মিয়া  বলেন, আমি খুশি। পুলিশের ওপর আক্রমণের অভিযোগের মামলায় জামিন পেয়েছি। আশা করি মামলার অভিযোগপত্র থেকে আমার নাম বাদ দিয়ে আমাকে অব্যাহতি দেয়া হবে। মামলার কারণে বাড়িতে থাকতে পারছিলাম না। এখন স্ত্রী-সন্তানদের কাছে যাব।’
তারা মিয়ার বড় ভাই সামসু মিয়া বলেন, তারা মিয়ার বয়স ৪৫ বছর। তার দুই মেয়ে ও এক ছেলে রয়েছে। জন্মগত ভাবেই তার ভাইয়ের ডান হাত অকেজো। এ হাতটি অস্বাভাবিক চিকন। নাড়াতেই কষ্ট হয়। এমনকি ডান হাতে খেতেও পারেন না। বাম হাত তুলনামূলকভাবে লম্বা এবং বাঁকানো।

গতকাল জামিন শুনানির আগে তারা মিয়া একবার অসুস্থ হয়ে পড়েন। অসুস্থতার কারণে বাড়ি থেকে নিয়ে আসা পুঁটলিতে মাথা রেখে আদালত চত্বরে ঘণ্টাখানেক শুয়ে ছিলেন।
চাপাতি, হকিস্টিক ও লোহার রড় হাতে নিয়ে পুলিশের ওপর হামলা করার অভিযোগে গত ২৮শে ডিসেম্বর সুনামগঞ্জের জামালগঞ্জ থানায় মামলা করেন পুলিশের সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) মো. তারিকুল ইসলাম। আসামি তারা মিয়াসহ ৫২ জন। অজ্ঞাতনামা রয়েছেন আরো ৭০ থেকে ৮০ জন।

মামলায় বলা হয় গত ২৮শে ডিসেম্বর বিকাল ৪টা ৪০ মিনিটে জামালগঞ্জের মল্লিকপুর বাজারে আসামিরা অবৈধভাবে জড়ো হয়ে ‘ধানের শীষের’ পক্ষে মিছিল বের করে। তারা রাস্তা আটকায় এবং পুলিশের ওপর আক্রমণ করে। এতে বাদীসহ ৫ পুলিশ সদস্য আহত হয়।

Check Also

বিদ্যুৎস্পৃষ্টে একই পরিবারের ৫ জনের মৃত্যু

মৌলভীবাজারে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে একই পরিবারের পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছে। জুড়ী উপজেলার পূর্ব জুড়ী ইউনিয়নের পূর্ব গোয়ালবাড়ি …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।