নকল দুধে সয়লাভ সাতক্ষীরার দুগ্ধ পল্লী: খাঁটি দুগ্ধ উৎপাদনকারী খামারিদের পথে বসার উপক্রম

আবু সাইদ বিশ্বাস:সাতক্ষীরা: নকল দুধে সয়লাভ সাতক্ষীরার দুগ্ধ পল্লী। ডিটারজেন্ট পাউডার, সোডা, সয়াবিন তেল, লবণ, চিনি, স্যালাইন, নিম্নমানের গুঁড়া দুধসহ মারাত্মক সব কেমিক্যাল মিশিয়ে একটি চক্র ভেজাল দুধ তৈরি করছে। তারপর সেই দুধ দেশের বিভিন্ন নামিদামি ব্র্যান্ডের কোম্পানির মাধ্যমে প্যাকেটজাত হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে সারা দেশে। উৎপাদনের তুলনায় লাভ সাত থেকে আটগুণ থাকায় চক্রটি প্রতিদিন কয়েকটন নকল দুধ উৎপাদন করছে। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে খাঁটি দুগ্ধ উৎপাদনকারী খামারিদের এই সিন্ডিকেটের কারণে এখন পথে বসার উপক্রম হয়েছে।
এলাকার খামারিরা জানান, বিষাক্ত এ নকল দুধের ক্রিম থেকে তৈরি হচ্ছে খাঁটি গাওয়া ঘি। এসব দুধের ছানা থেকে তৈরি হচ্ছে রসনাবিলাস বাহারি সব মিষ্টান্ন।
দীর্ঘদিন ধরে কৌশলে ভয়ংকর এই অপকর্ম করে যাচ্ছে সাতক্ষীরার তালা উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলের একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট। এর মাধ্যমে তারা হাতিয়ে নিচ্ছে লক্ষ লক্ষ টাকা।
দীর্ঘ সময়ে সাতক্ষীরার দুগ্ধ শিল্পের সুনাম রয়েছে সারাদেশে । জেলাতে ছোট বড় প্রায় ১০ হাজার দুগ্ধ সমবায়ী ও খামারি গড়ে উঠেছে। স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে বিপুল পরিমাণে দুধ বিভিন্ন জেলাতে সরবরাহ করা হচ্ছে। এতে খামারিরা বিপুল টাকা উপার্জন করছে। অনেকে শুধু গো খামার করে স্বনির্ভর হয়ে উঠছেন।
জেলা পশু সম্পদ কর্মকর্তার অফিস সূত্রে জানা যায়, জেলায় বর্তমানে ১ হাজার ৫৫টি দুগ্ধ খামার রয়েছে। তবে বে-সরকারী হিসাবে ভাবে এর সংখ্যা আরো বেশি। এসব খামারে উন্নত জাতের গাভী রয়েছে প্রায় সাত থেকে আট হাজার। এসব খামার থেকে বছরে ৪০ থেকে ৫০ হাজার মেট্রিক টন দুধ উৎপাদন হয়ে থাকে। প্রতি মাসে এলাকার চাহিদা মিটিয়ে এক লাখ লিটারের বেশি দুধ মিল্কভিটা, প্রাণ, ব্র্যাক, আড়ংসহ বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ছাড়াও সরসরি খুলনা ও যশোরের ব্যবসায়ীদের সরবরাহ করা হয়।
তালার আটারই,জিয়ালা নলতার কয়েকজন খামারির সাথে কথা হয়। তারা জানান,অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, গা শিউরে ওঠার মতো ভয়ংকর এমন কর্মকান্ড হচ্ছে এ জেলাতে।
তারা জানান, দেশের গবাদিপশুসমৃদ্ধ সাতক্ষীরা জেলার তালা, কালিগঞ্জ ও সাতক্ষীরা সদর সহ জেলার বিভিন্ন এলাকাতে ভয়ংকর নকল দুধের রমরমা ব্যবসা চলছে।
এই ভেজাল দুধ প্রক্রিয়াজাতকে কেন্দ্রকরে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, কারখানা। এসব কারখানায় চলছে নকল দুধের নানা কারবার।
এই ভেজাল দুধে নানা প্রক্রিয়ায় প্রক্রিয়াজাত করে তৈরি করা হচ্ছে ঘি, ছানা,প্যাকেটজাত দুধ। দেশের বাজারে দুগ্ধজাত পণ্যের ব্যাপক চাহিদা থাকায় এটি এখন শিল্পে পরিণত হয়েছে।
গবাদিপশু পালন ও তা থেকে দুগ্ধ উৎপাদন করে বিক্রি করে অনেক খামারি এবং বেকার যুবক-যুবতী স্বাবলম্বী হলেও হঠাৎ করে ভেজাল দুধ উৎপাদনকারী একটি সিন্ডিকেটের কারণে মুখ থুবড়ে পড়তে চলেছে এই শিল্প।
দুধ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত একাধিক ফড়িয়া ব্যবসায়ী এবং খামারিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গোপনে তৈরি হচ্ছে ভেজাল দুধ। ফড়িয়া দুধ ব্যবসায়ী এবং কিছু দুধ থেকে ঘি ক্রিম, ছানা, দই-মিষ্টি উৎপাদনকারী কারখানার মালিক এসব অপকর্ম করছে।
তথ্যের সূত্র ধরে সরেজমিন যান এই প্রতিবেদক। তালার জিয়ালা নলতার ঘোষ পাড়ায়। এই গ্রামটি গবাদিপশুসমৃদ্ধ। পশু পালন এবং তা থেকে দুগ্ধ উৎপাদন করে গ্রামের সিংহভাগ মানুষ জীবিকা নির্বাহ করে আসছে।
এই খামারিদের কাছ থেকে দুগ্ধ সংগ্রহের জন্য কাজ করছে প্রায় ১৫-১৬ জন ফড়িয়া ব্যবসায়ী। এই ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে ভেজাল দুধ তৈরির অভিযোগ পাওয়া যায়।
সেই তথ্যের সূত্র ধরে জিয়ালা নলতা গ্রমে ভেজাল দুধ তৈরির প্রক্রিয়ার দেখা মেলে। তাদের পরিচয় প্রকাশ করা হবে না নিশ্চিত করে এক ফড়িয়ার বাড়িতে কাকডাকা ভোরে হাজির হয় প্রতিবেদক। তিনি দেখালেন, ভেজাল দুধ তৈরির পুরো প্রক্রিয়া।
এই ফড়িয়া ব্যবসায়ী এমন ভেজাল দুধ তৈরিতে যা ব্যবহার করলেন তা দেখে চক্ষু ছানাবড়া। তিনি প্রথম একটি বিলিন্ডার মেশিনে হাফ কেজি খাঁটি দুধ নিলেন। তার সঙ্গে পরিমাণ মতো ডিটারজেন্ট পাউডার, সোডা, হাফ কেজি সয়াবিন তেল, চিনি, স্যালাইন, লবণ, গুঁড়া দুধসহ বিভিন্ন মাত্রায় কেমিক্যাল মিশিয়ে ১৫ মিনিট বিলিন্ডার মেশিনে বিলিন্ডার করলেন।
বিলিন্ডার মেশিনে দুধের সঙ্গে সব কেমিক্যাল পদার্থগুলো ভালোভাবে মেশানো হয়। এভাবে আরও তিন দফায় তিনি এই কাজ করলেন। এরপর সব দুধ একটি পাতিলে ঢেলে তার সঙ্গে এক মণ সাদা পানি মিশিয়ে তৈরি করলেন ভেজাল দুধ। এভাবে এক মণ দুধ তৈরি করতে খরচ হচ্ছে প্রায় ২০০-২৫০ টাকা। আর তা বিক্রি করা হচ্ছে ১ হাজার ৬০০ টাকা।
যা তার উৎপাদন খরচের চেয়ে প্রায় সাত গুণ বেশি লাভ। তিন মণ ভালো দুধের সঙ্গে ১ মণ ভেজাল দুধ মিশিয়ে পুরোটাই ভালো দুধ দেখিয়ে সে সরবরাহ করছে নামিদামি বিভিন্ন দুধ ক্রয়কারী কোম্পানি, ঘি ক্রিম এবং ছানা তৈরি কারখানার কাছে। এভাবে তিনি প্রতিদিন প্রায় দুই মণ ভেজাল দুধ তৈরি করে ছয় মণ খাঁটি দুধের সঙ্গে বিক্রি করেন।
এদিকে এই ফড়িয়া ব্যবসায়ী আরেকজন ভেজাল দুধ তৈরিকারক ফড়িয়া ব্যবসায়ীর বাড়িতে নিয়ে গেলেন। সেই বাড়িতে যেতেই বাইরে থেকে বিলিন্ডার মেশিনের শব্দ পাওয়া গেল। অপরিচিত লোক দেখে তিনি ভয়ে ভড়কে গেলেন। সঙ্গে থাকা ফড়িয়ার কথায় আশ্বস্ত হয়ে তার ঘরে ঢুকে দেখা গেল তিনি দুটি বিলিন্ডার মেশিনের মাধ্যমে একই প্রক্রিয়ায় দুধ তৈরি করছেন।
এই দুই ব্যবসায়ী জানালেন, তাদের মতো এ গ্রেেমর অনেক ফড়িয়া ব্যবসায়ীই একই কর্ম করে।
তাদের কাছ থেকে জানা গেলো, তারা গবাদিপশু পালকদের কাছ থেকে ৪০ টাকা দরে প্রতি লিটার দুধ কিনে আবার দুধের মিল কারখানায় একই দামে বিক্রি করেন। গ্রামপর্যায় থেকে ৪০ টাকা দামে দুধ কিনে মিল কারখানায় একই দামে দুধ বিক্রি এবং তাতে ভেজাল দেয়ার কথা নাকি তারাও জানে।
তারা আরও জানালেন, তাদের গ্রামের ব্যবসায়ীরা এই দুধ মিল্ক ভিটা, প্রাণ ডেইরি, ব্র্যাকের আড়ং ডেইরি, আকিজ ডেইরিসহ দুধের ক্রিম এবং ছানা তৈরির কারখানায় বিক্রি করেন।

এই ব্যবসায়ীরা বলেন, দুগ্ধ সংগ্রহ কেন্দ্রের কর্তাব্যক্তিদের ম্যানেজ করে ভেজাল দুধের লাভের একটা অংশ হাতে ধরিয়ে দিলেই তারা অন্য খামারিদের ভালো দুধের সঙ্গে এই দুধ মিশিয়ে দেয়। দুধের ঘনত্ব (ননির ফ্যাট) মেপে টাকা দেয়ায় অন্য খামারি এবং ব্যবসায়ীরা এই ভেজাল দুধের কারণে দুধের দাম কম পায়। কিন্তু ভেজালকারী এবং ক্রয় কেন্দ্রের কর্তাব্যক্তিরা এই ভেজাল দুধ ভালো দুধের সঙ্গে মিশিয়ে প্রতি মাসে হাতিয়ে নিচ্ছে লক্ষ লক্ষ টাকা।
অন্যদিকে এই জালিয়াতির কারণে ভালো দুধ দেয়া খামারি এবং ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। এতে উচ্চমূল্যে গো-খাদ্য কিনে গবাদিপশুকে খাইয়ে দুধ উৎপাদন করে লাভবান হওয়ার পরিবর্তে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছেন খামারিরা।
দুধে ভেজাল দিয়ে তা নানা পন্থায় বিক্রি করে শূন্য থেকে রাতারাতি লাখ লাখ টাকার মালিক বনে গেছেন ফড়িয়া দুগ্ধ সংগ্রাহকরা। এই দুধ ক্রয়-বিক্রয়কে কেন্দ্র করে স্থানীয় পর্যায়ে একাধিক ফড়িয়া গ্রুপ গড়ে উঠেছে। আর তাদের আড়াল থেকে নিয়ন্ত্রণ করছে একাধিক ক্ষমতাসীন ব্যক্তি। সংঘবদ্ধ চক্রটি প্রচন্ড শক্তিশালী। তারা টাকা পয়সা দিয়ে ফড়িয়া ব্যবসায়ীদের এই অবৈধ কর্মকান্ডে সহায়তা করছে। একাধিক ভেজাল দুধ তৈরি কারবারি এবং ঘি ছানা তৈরিকারী এ প্রতিবেদকের কাছে তাদের পরিচয় গোপন করে ভয়ংকর সব তথ্য দেন।
বিশেষজ্ঞরা জানান, কেমিক্যাল মেশানো এই দুধ ও তার তৈরি মিষ্টান্ন খেয়ে সাধারণ মানুষ মারাত্মক সব রোগে ভুগছেন। তারা সাধারণ মানুষকে রক্ষা করতে দ্রুত এই ভেজাল দুধের কারবার বন্ধের কথা জানান।
ভেজাল দুধ নেয়ার বিষয়ে মিল্ক ভিটার এক কর্মকর্তা জানান, মিল্ক ভিটায় কোনো ভেজাল ও নিম্নমানের দুধ নেয়া হয় না। তাছাড়া এখানে কেউ সিন্ডিকেট করে নিম্নমানের দুধ দেয়ার সুযোগ নেই। বিভিন্ন পরীক্ষার মাধ্যমে এখানে দুধ নেয়া হয়।
তালা আটারই গ্রামের দুগ্ধ খামারি আল আমিন জানান,নকল দুধের কারণে তারা শেষ হয়ে যাচ্ছে। খামার বন্ধ করার উপক্রম তাদের। দুখের প্রকৃত দাম না পেয়ে তারা হতাশ। নকল দুধের সরবরাহ বন্ধের দাবী তার।
ভয়ংকর এই ভেজাল দুধ ব্যবসা প্রসঙ্গে তালা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সাজিয়া আফরিনের
দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি জানান, আমরা অভিযোগটা শুনেছি। এখনো কোন প্রমাণ পাইনি। প্রমাণ পেলে চক্রের বিরুদ্ধে মাঠে নামা হবে। এদের সবাইকে আইনের আওতায় আনা হবে।
সাতক্ষীরা জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা সমরেশ চন্দ্র্র দাশ জানান, সকাল দুধ উৎপাদন ও সরবরাহের সাথে কেউ জড়িত থাকলে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। এছাড়া যে কোন সময়ে দুগ্ধ পল্লি গুলোতে ভ্রাম্যমান টিম যেতে পারে।

Please follow and like us:

Check Also

ঈদে স্ত্রীর জন্য মাংস কিনতে না পারায় দিনমজুর স্বামীর আত্মহত্যা

জামালপুরের বকশীগঞ্জে স্ত্রীর জন্য মাংস কিনতে না পেরে চিঠি লিখে আত্মহত্যা করেছেন হাসান আলী (২৬) …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।