বৈরিতা নেই শ্রীলঙ্কার মুসলমান ও খ্রিস্টানদের মধ্যে

এএফপি : কলম্বো শহর এখন স্তব্ধ। গত রোববারের বিপর্যয়ের পরে যাঁদের পক্ষে বাড়িতে থাকা সম্ভব, তাঁরা ঝুঁকি এড়াতে বাড়িতেই রয়েছেন। যানবাহন চলছে। স্কুল বন্ধ, অফিস খোলা। তবে অতীতের বিস্ফোরণের অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায়, খুব তাড়াতাড়িই স্বাভাবিক হবে সবকিছু।

তিনটে গির্জায় বিস্ফোরণের সঙ্গে শ্রীলঙ্কার অভ্যন্তরীণ সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার যোগসূত্র খুঁজছেন কেউ কেউ। কিন্তু এমন কোনো যোগসূত্র আদৌ নেই। শ্রীলঙ্কা সরকার বলে দিয়েছে, এই হামলার নেপথ্যে রয়েছে ‘ন্যাশনাল তৌহিদ জামাত’ নামে একটা কথিত মুসলিম মৌলবাদী সংগঠন। এর সঙ্গে শ্রীলঙ্কার খ্রিস্টান ও শ্রীলঙ্কার মুসলিমদের পারস্পরিক সম্পর্কের বিষয়টা জড়িত, এমন ভাবার সত্যিই কোনো কারণ নেই। শ্রীলঙ্কায় খ্রিস্টান এবং মুসলিমরা কখনো পরস্পরের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়াননি, তাঁদের মধ্যে সম্পর্কটা শত্রুতারও নয়।

খ্রিস্টানদের সঙ্গে মনোমালিন্য রয়েছে শুধু বৌদ্ধদের। লোভ দেখিয়ে ধর্ম পরিবর্তনের অভিযোগ ওঠায় অতীতে কোনো কোনো গির্জা আক্রান্ত হয়েছে। হামলাটা যদি বৌদ্ধ মৌলবাদীরা চালাত, তাহলে বলা যেত, তার সঙ্গে স্থানীয় সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার বিষয়টার কোনো যোগ আছে। কিন্তু হামলা চালিয়েছে মুসলিমরা। এ দেশে যাদের সঙ্গে খ্রিস্টানদের বিরোধই নেই।

এই হামলার ইন্ধন বা প্রভাব এসেছে বাইরে থেকে। ‘ন্যাশনাল তৌহিদ জামাত’-কে ইসলামিক স্টেট বা আইএসেরই একটি শাখা সংগঠন বলে মনে করা হয়। সিঙ্গাপুরের ‘এস রাজারতœম সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ’-এর নিরাপত্তা চর্চা (সিকিউরিটি স্টাডিজ) বিভাগের অধ্যাপক রোহন গুণরতেœর মতে, কলম্বোর ধারাবাহিক বিস্ফোরণটা আসলে আইএসের কাজ। নিজেদের ‘শ্রীলঙ্কা শাখা’র সঙ্গে হাত মিলিয়েই এই কা- ঘটিয়েছে তারা।

সন্ত্রাস ও রাজনৈতিক হিংসা নিয়ে গবেষণার ক্ষেত্রে শ্রীলঙ্কার অন্যতম সেরা বিশেষজ্ঞ গুণরতেœ ফোনে এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘পশ্চিমী দেশ আর খ্রিস্টানদের গির্জাগুলো আইএসের নিশানা। ইরাক আর সিরিয়ার ঘাঁটি থেকে আইএসকে উত্খাত করেছে পশ্চিমা দেশগুলোর একটা জোট। আইএস মনে করে, পশ্চিমা দুনিয়াকে আদর্শগতভাবে এক সুতোয় বেঁধে রেখেছে খ্রিস্টধর্ম। শ্রীলঙ্কাসহ সারা বিশ্বেই স্থানীয় শাখাগুলোকে ব্যবহার করে মুসলিমদের মৌলবাদের পথে চালিত করছে আই এস।’

খ্রিস্টান-পশ্চিম আর ইসলামি মৌলবাদ এই দুইয়ের একটা সংঘাত চলছে দুনিয়া জুড়ে। শ্রীলঙ্কার গির্জায় হামলা, নিউজিল্যান্ডে মসজিদে হানা সবই এই সংঘাতের ফসল বলে মনে হয়। মনে হয়, ক্রাইস্টচার্চের এক খ্রিস্টান বন্দুকবাজের হত্যাকা-ের বদলাই হয়তো কলম্বোর গির্জায় হামলা।

কলম্বোর তিনটে পাঁচতারা হোটেলে হামলার ব্যাপারটাও নজর করার মতো। শাংগ্রিলা, সিনামন গ্র্যান্ড, কিংসবেরি সবই পশ্চিমা নাগরিকদের পছন্দের হোটেল। জঙ্গিরা জানত, বিশ্ববিখ্যাত এই হোটেলগুলোয় হামলা চালালে প্রচার যেমন পাওয়া যাবে, তেমনই ত্রাস সৃষ্টি করা যাবে পশ্চিমা নাগরিকদের মধ্যে।

এদিকে উগ্রপন্থী ধর্মীয় নেতা জাহরান হাশেমের বিরুদ্ধে কর্তৃপক্ষের কাছে বহু বছর ধরে অভিযোগ করে আসছিলেন শ্রীলংকার মুসলমানরা। তারা দেশটির গোয়েন্দা সংস্থাকেও এ ব্যাপারে বারবার সতর্ক করেছিলেন। এবার সেই হাশেমেই শ্রীলংকার ইতিহাসের সবচেয়ে প্রাণঘাতী হামলায় মূল ভূমিকা রেখেছেন।

মঙ্গলবার প্রকাশ করা এক ভিডিওতে হামলার দায় নিয়েছে মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেট (আইএস)। এতে হাশেমের সেই পরিচিত উগ্রমুখটি দেখা গেছে। হামলায় এখন পর্যন্ত ৩৫৯ জন নিহত হয়েছেন।

ফুটেজে আইএস নেতা আবুবকর আল বাগদাদির আনুগত্য প্রকাশ করে আটজনকে শপথ নিতে দেখা গেছে। যাদের মধ্যে কেবল হাশেমের গোলাকার মুখটিই খোলা ছিল। বাকিরা মুখ ঢেকে আনুগত্যের শপথ নেন।

মাথা কালো কাপড়ে ঢাকা রাইফেল বহনকারী হাশেম অন্যদের শপথবাক্য পাঠ করান। বাকিরাও তার মতো কালো পোশাক পরলেও তাদের মুখম-ল ছিল সম্পূর্ণ ঢাকা।

শ্রীলংকার সরকার ইতিমধ্যে হামলার জন্য পরোক্ষভাবে হাশেমকে দায়ী করেছে। স্বল্প পরিচিত ইসলামপন্থী সংগঠন জাতীয় তাওহিদ জামায়াতকে হামলার জন্য প্রাথমিকভাবে সন্দেহ করেছে।

অবশেষে হাশেমকে শনাক্ত করা হয়েছে। যদিও তার নাম ভুলভাবে হাশমি বলে উচ্চারণ করা হয়েছে। তবে হামলার আগে ভার্চুয়াল জগতে তিনি তেমন কোনো পরিচিত মুখ ছিলেন না। এমনকি শ্রীলংকার ভেতরেও তার পরিচিত ছিল সামান্য।

ইউটিউব ও ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তার কয়েক হাজার ফলোয়ার রয়েছে। এতে তিনি উত্তেজনাপূর্ণ ওয়াজ-নসিহত আপ করেন।

একটি ওয়াজে দেখা গেছে, অমুসলিমদের বিরুদ্ধে ভর্ৎসনাপূর্ণ ওয়াজ করছেন তিনি। তার পেছনে একটি ফটোশপে তৈরি করা আগুনের পতাকা।

শ্রীলংকার মুসলিম কাউন্সিলের ভাইস প্রেসিডেন্ট হিলমি আহামেদ বলেন, তিন বছর আগেই হাশেম সম্পর্কে স্থানীয় কর্তৃপক্ষকে সতর্ক করেছিলেন তিনি।

হাশেম কোরআন ক্লাসের অজুহাতে তরুণদের উগ্রপন্থার দীক্ষা দিচ্ছিলেন জানিয়ে হিলমি বলেন, কিন্তু তিনি এতবড় হামলা চালাতে সক্ষম হবেন বলে কেউ ভাবেননি। মোহাম্মদ জাহরান ও মৌলভী হাশেম নামে পরিচিত ছিলেন ৪০ বছর বয়সী ওই ধর্মীয় নেতা।

Please follow and like us:

Check Also

ফরিদপুরে বাস-পিকআপ সংঘর্ষে নিহত ১৩

ফরিদপুরের কানাইপুরে বাস ও পিকআপ ভ্যানের সংঘর্ষে ১৩ জন নিহত হয়েছেন। এ ছাড়া আহত হয়েছেন …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।