ঘুর্ণিঝড় ‘ফনী’র প্রভাবে সাতক্ষীরায় আতঙ্ক: নদীতে পানি বৃদ্ধি: হাজার হাজার মানুষ আশ্রয় কেন্দ্রে

ক্রাইমর্বাতা রির্পোট  : সাতক্ষীরা:     দক্ষিণ বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট প্রবল ঘূর্ণিঝড় ‘ফণী’র প্রভাবে সাতক্ষীরায় আতংক বিরাজ করছে।কয়েক হাজার মানুষ ঘর বাড়ি ছেড়ে সাইক্লোন সেন্টারে আশ্রয় নিয়েছে। আজ সন্থার দিকে প্রবল ঘূর্ণিঝড় ‘ফণী’ সাতক্ষীরার উপর দিয়ে বয়ে যেতে পারে।

সুন্দরবন সংলগ্ন নদীগুলোতে স্বাভাবিকের তুলনায় ১-২ ফুট পানি বৃদ্ধি পেয়েছে।
বৃহস্পতিবার দুপুর থেকে সুন্দরবন সংলগ্ন চুনা, খোলপেটুয়া, মাংলঞ্চ ও যমুনা নদীতে অন্যন্য দিনের তুলনায় বৃদ্ধি পেয়েছে এবং সকাল থেকে উপকূলীয় এলাকার আকাশ মেঘলা ও বাসাতের গতি বৃদ্ধি পাওয়ায় মানুষের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলো মাইকিং করে জনগণকে সতর্ক করা হচ্ছে বলে স্থানীয় প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে।
এদিকে ঘূর্ণিঝড় ফণির সম্ভাব্য প্রভাব মোকাবেলায় সাতক্ষীরা জেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির জরুরী সভায় জেলার ১৩৭টি ঘূর্ণিঝড় আশ্রয় কেন্দ্র ৮৪টি মেডিকেল টিম প্রস্তুত রাখতে বলা হয়েছে।
বৃহস্পতিবার দুপুরে সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসনের সম্মেলন কক্ষে জেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি ও জেলা প্রশাসক এসএম মোস্তফা কামালের সভাপতিত্বে এক জরুরী সভা অনুষ্ঠিত হয়।
সভায় বলা হয়, জেলার ১৩৭টি ঘূর্ণিঝড় আশ্রয় কেন্দ্র প্রস্তুত রাখতে বলা হয়েছে। এছাড়া প্রত্যেক ইউনিয়নে মেডিকেল টিম ও স্বেচ্ছাসেবক টিম প্রস্তুত, ঝুঁকিপূর্ণ বেড়িবাঁধ সংস্কার, শুকনা খাবার মজুদ রাখা, ওষুধের পর্যাপ্ততা নিশ্চিতকরণসহ দুর্যোগ মোকাবেলায় সম্ভাব্য সকল প্রস্তুতি নিশ্চিত করার কথা জানানো হয়।
সভায় বলা হয়, ইতোমধ্যে জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তার অফিসে নিয়ন্ত্রণ কক্ষ খোলা হয়েছে। নিয়ন্তণ কক্ষের ফোন নম্বর ০৪৭১৬৩২৮১।
সভায় জানানো হয়, জেলায় দুর্যোগ মোকাবেলায় ৩২শ প্যাকেট শুকনা খাবার, ১১৬ টন চাল, ১ লক্ষ ৯২হাজার টাকা, ১১৭ বান টিন, গৃণ নির্মাণে ৩ লক্ষ ৫১ হাজার টাকা ও ৪০ পিস শাড়ি মজুদ আছে।
সভায় ১৫-২০ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসের আশংকা করে বলা হয়, ৮, ৯ ও ১০ নম্বর সর্তক সংকেত আসলে উপকূলীয় মানুষকে আশ্রয় কেন্দ্রে নিতে হবে। যতদূর সম্ভব দ্রুততার সাথে মাঠের ফসল ঘরে তুলতে হবে। সংকেত প্রচারে ইমামদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে হবে। এছাড়ার ঘূর্ণিঝড় ফণী মোকাবেলায় সাতক্ষীরাজেলা সদরসহ ৭টি উপজেলায় একটি করে কন্টোল রুম খোলা হয়েছে।

এছাড়াও ৮৪টি মেডিক্যাল টিম প্রস্তুত রাখা হয়েছে। সব সরকাবি কর্মকতা-কর্মচারিদের ছুটি বাতিল করা হয়েছে। সাতক্ষীরার শ্যামনগর ও আশাশুনি উপজেলায় রেড ক্রিসেন্ট, ফায়ার সার্ভিস ও বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার ৩ হাজার ৬৫৫ জন স্বেচ্ছাসেবককে প্রস্তুুত রাখা হয়েছে।
জেলার শ্যামনগর, আশাশুনি ও কালিগঞ্জের সাইক্লোন সেল্টারগুলো প্রস্তুুত রাখার পাশাপাশি সেগুলোর চাবি দায়িত্বশীল লোকদের কাছে রাখতে হবে। যাতে সময় মতো আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয় এবং মানুষ সঠিকভাবে সেখানে উঠতে পারে। এছাড়া প্রত্যেক মসজিদের মাইকে সতর্কতা বার্তা প্রচারের জন্য ইমাম ও সংশ্লিষ্ট জনপ্রতিনিধিদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
এদিকে বৃহস্পতিবার বিকালে সাতক্ষীরা-৪ আসনের এমপি জগলুল হায়দার পায়ে হেটে উপকূলীয় ঝুঁকিপূর্ণ বেড়িবাধ এলাকা মুন্সিগঞ্জ, পদ্মপুকুর, গাবুরা, রমজাননগর ইউনিয়নের মানুষকে বিশেষ করে শিশু ও বৃদ্ধদের আশ্রয় কেন্দ্রে যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।
সাতক্ষীরা আবহাওয়া অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জুলফিকার আলী জানান, ঘূর্ণিঝড় ‘ফণী’র কারণে সাতক্ষীরায় ৪ নম্বর স্থানীয় হুঁশিয়ারি সংকেত নামিয়ে ৭ নম্বর স্থানীয় হুঁশিয়ারি সংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে।
দ্বীপ ইউনিয়ন গাবুরা এলাকার আবুল হোসেন বলেন, ২০০৯ সালের ২৫ মে সাতক্ষীরা সুন্দরবন উপকূলে আঘাত হানে। এই আইলার ক্ষত এখন কাটিয়ে উঠতে পারেন এই এলাকার মানুষ। রাস্তাঘাটের বেহলা দশা, বেঁড়িবাধ ঝুঁকির মধ্যে আকাশে মেঘ দেখলে আমাদের ঘুম হামার হয়ে যায়। আবার শুনতে পাচ্ছি ঘুর্ণিঝড় ‘ফেনী’ আসছে। নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে মাইকিং করা হয়েছে। আশ্রয় কেন্দ্রে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি।
বুড়িগোলিনী স্টেশন কর্মকর্তা কবীর উদ্দিন বলেন, বনপ্রহীদের ব্যবহৃত অস্ত্র-গুলি নিয়ে নিরাপদে থাকতে বলা হয়েছে। বনের ভেতরে অবস্থান করা নৌযানগুলোকে লোকালয়ে আনার জন্য বনপ্রহরীদের নিদের্শ দেওয়া হয়েছে।


সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ড-১ নির্বাহী প্রকৌশলী আবুল খায়ের বলেন, সুন্দরবন সংলগ্ন নদীগুলোতে স্বাভাবিক জোয়ার ভাটার তুলনায় পানি দুই ফুট বৃদ্ধি পেয়েছে। আমাদের ১১ কিলোমিটার বাঁধ ঝুকিপূর্ণ রয়েছে। সেগুলো মেরামতের জন্য জিও প্রস্তুত রাখা হয়েছে।
শ্যানগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকার্তা (ভারপ্রাপ্ত) সুজন সরকার বলেন, ঘূর্ণিঝড় ‘ফণী’ মোকাবিলায় আমাদের যথেষ্ট প্রস্তুুতি আছে। আমাদের ১৪৩টি সিপিপি টিমের ২ হাজার ১০০স্বেচ্ছাসেবক কাজ করছে। ‘নবযাত্রা’ প্রকল্পের আওতায় আরও ১হজার ১০০জন কর্মী কাজ করছেন। ইতোমধ্যে উপকূলীয় এলাকার মাইকিং করা হয়েছে। এছাড়া দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটি ও রেডক্রিসেন্ট সোসাইটির সদস্যদের প্রস্তুত থাকা এবং আশ্রয় কেন্দ্র ও সাইক্লোন সেন্টারগুলো প্রস্তুুত রাখা হয়েছে। ইউপি চেয়ারম্যানদের সর্তক থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ত্রাণ বিতরণ উদ্ধার কালে সমস্যা না হয় সেই বিষয় মাথায় রেখে ইউপি মেম্বারের তত্ত্বাবধানে প্রতিটি ওয়ার্ডে ১০ সদস্যরে একটি টিম করা হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, শ্যামনগর উপজেলার ১২টি ইউনিয়নে ১২টি মেডিকেল টিম ও উপজেলায় একটি একটি মেডিকেল টিম গঠন করা হয়েছে। জরুরী প্রয়োজনে নিয়ন্ত্রণ কক্ষ খোলা হয়েছে। উপজেলার সকল সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের ছুটি বাতিল করা হয়েছে। ১৫৫টি দ্বিতল সাইক্লোন সেন্টার প্রস্তুত রাখা হয়েছে। ঝুঁকিপূণ এলাকাগুলোতে মাইকিং করা হয়েছে। সবাইকে প্রস্তুত থাকতে বলা হয়েছে আমরা নির্দেশনা দেওয়া মাত্র তারা যেন সাইক্লোস সেল্টারে আসে। যারা আসবে না তাদের জোর করে সাইক্লোন শেল্টারে আনা হবে।


জেলা প্রশাসক এস এম মোস্তফা কামাল বলেন, ঘূর্ণিঝড় উপকূল অতিক্রম না করা পর্যন্ত সকল সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের ছুটি বাতিল ঘোষণা করা হয়েছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির দুটি জরুরী সভা করা হয়েছে। ঘূর্ণিঝড়ে সাধারণ উপকূলীয় এলাকার মানুষের জান মালের ক্ষতি কমাতে করণীয় বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয় এবং সাথে সাথে উপকূলীয় অঞ্চলে মানুষ গুলোকে নিরাপদে থাকার জন্য অনুরোধ করেছেন। এছাড়ার সুন্দরবন ও সাগরে মাছ ধরার ট্রলার ও নৌকাগুলোকে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত চলাচল বন্ধ রাখতে বলা হয়েছে। জেলা নিয়ন্ত্রণ কক্ষ খোলা হয়েছে। ফোন নাম্বার ০৪৭১-৬৩২৮১।
প্রসঙ্গত: ২০০৯ সালের ২৫ মে এই দিনে ১৫ ফুট উচ্চতা বেগের সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস ও ঘুর্নিঝড়ের প্রভাবে সৃষ্ট সর্বনাশা ‘আইলা’ আঘাত হানে দক্ষিণ-পশ্চিম সুন্দরবন উপকুলীয় উপকুলীয় সাতক্ষীরার শ্যামনগর ও আশাশুনি উপজেলায়। প্রলয়ংকারী ঘূর্নিঝড় আইলার আঘাতে তছনছ হয়ে যায় দক্ষিণ-উপকুলীয় সাতক্ষীরার আশাশুনি, শ্যামনগরের গাবুরা, পদ্মপুকুর ও আশাশুনি উপজেলার প্রতাপনগর ইউনিয়নের লক্ষাধিক মানুষের হাহাকার কমেনি। এর পর থেকে পানি উন্নয়ন বোর্ডের বেড়িবাঁধগুলিও ঝুকির মধ্যে। পদ্মপুকুর ইউনিয়নের কামালকাটি নামক স্থানে বেড়ীবাঁধ ভেঙ্গে জনবসতি গ্রাস করছে।
এছাড়া বুড়িগোয়ালিনী, হরিনগরসহ প্রায় একশ’ কি. মি. বেড়ীবাঁধ হুমকির মুখে। স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে কামালকাটি এলাকায় বেড়ীবাঁধ সংস্কারের কাজ হলে অন্যান্য বাঁধ গুলি কিছুদিন পর বেঙে যায়। আইলার পর থেকে খাবার পানির তীব্র সংকট ভূগছেন উপকূলীয় এলাকার মানুষ। গাবুরা ইউনিয়নের ১৫ টি গ্রামের মধ্যে ১৩টি গ্রামের মানুষদের খাবার পানির একমাত্র উৎস ‘পুকুর’। অনেকে মহিলাই ২/৩ কিঃমিঃ পাঁয়ে হেটে এক কলস পানি আনেন। নোংরা আবর্জনায় পরিপুর্ন হওয়ায়,এসব পানি পান করে রোগাক্রান্ত হচ্ছেন অনেকেই। কিছুটা স্বচ্ছল লোকেরা বিশ টাকা দরে পানির ড্রাম পাশের উপজেলা কয়রা থেকে কিনে আনছেন।

Check Also

মালয়েশিয়ার পাম তেলে ইইউ’র নিষেধাজ্ঞা বাংলাদেশের শ্রমবাজারে অশনি সংকেত

বন উজাড়, কার্বন নির্গমনের ঝুঁকি এবং পরিবেশের ভারসাম্য নষ্টগত কারণ দেখিয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ মালয়েশিয়ার …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।