স্কুলছাত্র হত্যাকাণ্ডের রহস্য উন্মোচনে পিবিআই প্রধানের হৃদয়স্পর্শী স্ট্যাটাস

ক্রাইমবার্তা রিপোটঃ গত বছরের ১৮ সেপ্টেম্বরে বড়লেখার মোহাম্মদপুর গ্রামের আরব আলীর টিলার ঢালে মাথা ও ডান হাত বিচ্ছিন্ন অবস্থায় পাওয়ায় আব্দুল্লাহ হাসান নামের এক কিশোরের মরদেহ।

সে সিলেটের ‘মনির আহমেদ একাডেমিতে’ ৯ম শ্রেণিতে পড়ত। এমন কোমলমতি শিক্ষার্থীকে কে বা কারা এভাবে নৃশংসভাবে খুন করেছে আর এর পেছনের কি কারণ থাকতে পারে তার কোনো কুলকিনারা করতে পারছিলেন না তদন্তকারীরা।

এ হত্যাকাণ্ডের ৬ মাস পার হয়ে গেলেও তদন্তের কোনো অগ্রগতি হচ্ছিল না। রহস্যের ধূম্রজালেই ঘুরপাক খাচ্ছিল পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) সদস্যরা।

অবশেষে সেই হত্যাকাণ্ডের রহস্য ভেদ করতে পেরেছে পিবিআই। এ বিষয়ে মঙ্গলবার (২৮ আগস্ট) পিবিআই প্রধান পুলিশের ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদার সোশ্যাল মিডিয়ায় একটি স্ট্যাটাস দিয়েছেন।

নিজের ফেসবুক পেজে তিনি লিখেছেন, প্রতিদিন আমরা কত ছোট ছোট ভুল করি। ঘাতক কি সর্বদা আমাদের আশেপাশেই ঘোরে!

সামান্য একটি কারণে আব্দুল্লাহ হাসানকে তারই গাড়িচালক এরশাদ খুন করেছে বলে জানান তিনি।

পাঠকের উদ্দেশে পিবিআইপ্রধানের সেই স্ট্যাটাসটি দেয়া হলো, ‘সিলেটের ‘মনির আহমেদ একাডেমির’ ৯ম শ্রেনীর ছাত্র আব্দুল্লা হাসান। বাড়ি বড়লেখার মোহাম্মদপুর গ্রামে। বাবা সৌদি প্রবাসী। বয়সের তুলনায় একটু গম্ভীর। ধনাঢ্য বাবার সন্তান হলেও হিসেব করে খরচ করে। স্কুলের ছুটিতে এসে গ্রামের বন্ধুদের সাথে খেলা-ধুলায় সময় কাটায়।

সেদিন সন্ধ্যায়ও সে মার কাছ থেকে কর্ক কেনার টাকা নিয়ে ৩০০ গজ দূরের বাজারে যায় ব্যাডমিন্টন খেলতে। হাসান আর ঘরে ফেরেনি। বন্ধুরা বলে, মাঠে কিছুক্ষণ থেকে ঘুম আসার কথা বলে সে বাসায় চলে যায়। এরপর আর কেউই হাসানকে দেখেনি।

হাসান খেলতে যায় ১৮ই সেপ্টেম্বর। চারদিন পর গ্রামেরই আরব আলীর টিলার ঢালে মাথা ও ডান হাত বিচ্ছিন্ন তার মৃতদেহ পাওয়া যায়। জনপ্রিয় এ মেধাবী ছেলেটির মুখ গ্রামবাসীকে স্থম্বিত করে দেয়। হাসানের বাবাও সৌদিআরব থেকে ফিরে আসেন। গ্রামবাসী ও হাসানের বন্ধুরা বিন্দুমাত্র ধারণাও দিতে পারে না হাসান টিলায় কেন গেলো? প্রযুক্তিতে ভর করা তদন্ত আর টিলার ঢাল অবধি পৌঁছায় না। সন্দেহের খোলা মাঠে পিবিআই ঘুরপাক খায় এদিক থেকে ওদিকে।

৬মাস চলে যায়। শোকের মাতম স্বাভাবিক হয় না। স্বাক্ষ্য প্রমাণ ক্রমান্বয়ে নাগালের বাইরে চলে যায়। পিবিআই হাসানদের ড্রাইভারকে ডাকে। সে ঢাকা হতে তড়িঘড়ি করে চলে আসে-যদি খুনের রহস্য উদঘাটনে সাহায্য করতে পারে। ড্রাইভার এরশাদ ৩ মাস আগে চাকুরী ছেড়েছে। যাবার আগপর্যন্ত সে তার সাধ্যমত হাসানকে খুঁজেছে। আগেও সে চাকরি ছাড়ার কথা বলেছে এবং হাসান নিখোঁজ হওয়ার ১৫ দিন আগে সে তার স্ত্রী ও শিশু সন্তানকে অসুস্থ্য মায়ের কাছে পাঠিয়েছে সেবা করার জন্য।

তার মা মাতুয়াইলে থাকে। এরশাদের বাড়ি ভোলার শশীভূষনের চরমাইয়া গ্রামে। চাকরির সূত্রেই বিয়ে করেছিলো হাসানদের বাড়ির কাছে। পরিবার নিয়ে থাকতে হাসানদের তিনতলা ভবনের ২টি কক্ষে, বিনা ভাড়ায়। তদন্ত টিম হতাশ হয়। ড্রাইভারও কোনো নতুন তথ্য দিতে পারে না। সে আবার মা ও স্ত্রীর কাছে ফিরে যায়।

হঠাৎ একদিন পিবিআইয়ের তদন্ত কর্মকর্তার খটকা লাগলো। ড্রাইভার গত ৩ মাসের মধ্যে তার দৈনন্দিন অভ্যাস ও বেশভূষা কেন ত্যাগ করল? খোঁজ নিয়ে জানা গেল ৩ মাস আগেও সে এত ধর্মকর্ম করত না।

অবশেষে মো. এরশাদ আদালতে স্বীকার করে, হাসানকে সেই হত্যা করেছে। হত্যার ৪মাস আগে সে হাসানকে নিয়ে সিলেটের স্কুলে যাচ্ছিলে। চন্দনপুর বাজারে গাড়ি ঘুরানোর সময় হাসানের পায়ে একটু লেগে যায়, হাসান ব্যথা পায়। সে তার ড্রাইভার চাচাকে স্থানীয় ভাষায় নোয়াখাইল্যা ও ব্যাংগলি বলে গালি দেয়।

ছোট ছেলের করা এ অপমান এরশাদ সহজভাবে নেয়নি। সে রেগে যায় এবং বলে- ইচ্ছে করেই গাড়ির চাকা সে হাসানের পায়ে লাগিয়েছে। স্বল্পভাষী ছেলেটি আর নিজেকে নিয়ন্ত্রন করতে পারে নি। আহত অবস্থায়ই সে এরশাদকে কয়েকটি চড় মারে। চড় মারার বিষয়টি হাসান কাউকে বলে নি। কিন্তু এরশাদও হজম করতে পারে নি।

পরিকল্পনা অনুযায়ী এরশাদ চাকরি ছাড়ার কথা বলে। সে অনুযায়ী সে তার পরিবারকে মায়ের কাছে পাঠায়। ৫ বছর আগের কেনা খাসিয়া-দাটি সে গোপনে ধার দিতে থাকে। প্রতিদিন সন্ধ্যায় দা-টি কোমরে গুজে তার ওপর শীতের জ্যাকেট পরে স্বাভাবিক কাজ করেন। সেদিন সন্ধ্যায় হাসানকে বাড়ি ফিরতে দেখে টিলায় নিয়ে যায় গল্প করতে করতে।

টিলায় উঠেই এরশাদ চন্দনপুরের ঘটনাটা উঠায়। হাসান বলে, ‘চাচা এগুলো মনে রাখতে হয় না-কি! ছোট মানুষ ভুল করে ফেলেছি, আপনি কথাটা আর ওঠাননি বলে মাফ চাওয়াও হয় নি।’

হাসান এর কথা শেষ হয় না, এর আগেই এরশাদ তার ধারাল খাসিয়া ‘দা’ দিয়ে হাসানের হাতে ও পরে মাথায় কোপ মারে। এরপর অন্ধকারে আন্দাজে ভর করে আরও ৪-৫টি কোপ মারে। হাসান পাহাড়ের ঢাল দিয়ে জাপানি লতার সঙ্গে মিলে প্রায় ৩০ ফুট নিচে পড়ে যায়। কিছুক্ষণ শো শো শব্দ হয় তারপর সব নিস্তেজ।

হাসান মোবাইল ব্যবহার করত না কিন্তু এরশাদ চাচাকে একটি মোবাইল উপহার দিয়েছিল। এরশাদ সে মোবাইলের আলোতে তার জ্যাকেট, প্যান্ট ও জুতায় রক্ত না লাগার বিষয়ে নিশ্চিত হয়ে হাসানদের বাড়ি এসে ঘুমিয়ে পড়ে।

হাসানের জন্য কষ্ট হয়। সে মাকে বলে মাঠে খেলতে গিয়েছিল। খেলাধুলার পোষাক পরেই সে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করল ছোট্ট একটি ভুলের খেসারত হিসাবে। প্রতিদিন আমরা কত ছোট ছোট ভুল করি- ঘাতক কি সর্বদা আমাদের আশেপাশেই ঘোরে!

সূত্রঃ বড়লেখা থানার মামলা নং- ১৬, তাং-২৮/০১/২০১৮ , ধারা-৩০২/২০১/৩৪ পেনাল কোড।’

Check Also

উন্নত সমৃদ্ধ স্মার্ট সোনার বাংলা গড়ে তুলব: পরিদর্শন বইয়ে প্রধানমন্ত্রী

মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবসে ঢাকার সাভারের জাতীয় স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে মহান মুক্তিযুদ্ধের বীর …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।