জামায়াত শিবিরের প্রসঙ্গ টেনে বিদেশী মিডিয়ায় ফাহাদ হত্যাকাণ্ড ভারতের সঙ্গে পানি-চুক্তির সমালোচনা করায় বুয়েটছাত্র হত্যা, বিক্ষোভ

ক্রাইমবার্তা রিপোটঃ      ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের পানি-চুক্তির সমালোচনা করার দায়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা পিটিয়ে হত্যা করেছে আবরার ফাহাদকে (২১)। তিনি অভিজাত বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ছাত্র। তার হত্যার প্রতিবাদে সোমবার ব্যাপক বিক্ষোভ হয়েছে। বড় বড় সড়কে অবরোধ করা হয়েছে। ঢাকায় ও রাজশাহীতে এই হত্যার প্রতিবাদে বিক্ষোভ করেছেন কয়েকটি বিশ্বদ্যিালয়ের হাজার হাজার শিক্ষার্থী। এতে যোগ দেন কিছু শিক্ষকও। বিক্ষোভ থেকে ন্যায়বিচারের দাবি জানিয়ে স্লোগান দেয়া হয়। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের নিহত কৃতী শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ড নিয়ে এসব কথা লিখেছে বিদেশী বিভিন্ন মিডিয়া।
বার্তা সংস্থা এএফপিকে উদ্ধৃত করে ভয়েস অব আমেরিকা লিখেছে, ঢাকায় পুলিশের উপ কমিশনার মুনতাসিরুল ইসলাম বলেছেন, ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। এ জন্য ক্ষমতাসীন দলের কয়েকজন নেতাকর্মীকে হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।

ফাহাদের মৃতদেহ পাওয়া যায় প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ডরমেটরিতে। সেখানকার অন্য আবাসিক ছাত্রদের উদ্ধৃত করে মিডিয়া বলেছে, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের সদস্যরা ফাহাদকে জিজ্ঞাসাবাদ করে। পরে তাকে প্রহার করে। বাংলাদেশ ছাত্রলীগের ভাইস প্রেসিডেন্ট আশিকুল ইসলাম বিটু এনটিভি’কে বলেছেন, একটি ইসলামপন্থি দলের যুব শাখার সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিযোগে ফাহাদকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছিল।

তবে এ ঘটনার কয়েক ঘন্টা আগে ফাহাদ তার ফেসবুক একাউন্টে একটি পোস্ট দেন। তা তাড়াতাড়ি ভাইরাল হয়ে যায়। ওই পোস্টে তিনি ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের একটি চুক্তির সমালোচনা করেছিলেন। ওই চুক্তিতে দুই দেশের সীমান্ত এলাকার ফেনি নদী থেকে ভারতকে পানি নিতে অনুমোদন দেয়া হয়েছে। গত বছর সরকার বিরোধী একটি ছাত্র আন্দোলনকে নির্মূল করে দিতে ছাত্রলীগের সদস্যরা হত্যাকাণ্ড, সহিংসতা ও চাঁদাবাজি করেছেন বলে অভিযোগ আছে। এ অভিযোগে দুর্নাম কুড়িয়েছে তারা। গত বছর প্রচন্ড জোরে চলমান একটি বাসের নিচে পড়ে দু’শিক্ষার্থী নিহত হওয়ার পর নিরাপদ সড়কের দাবিতে ওই ছাত্র আন্দোলন দানা বেঁধে ওঠে। এ ছাড়া জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় প্রধানের কাছে অর্থ দাবি করার অভিযোগে গত মাসে বহিষ্কার করা হয়েছে ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে।

ওদিকে অনলাইন আল জাজিরা লিখেছে, ফাহাদ হত্যার প্রতিবাদে সোমবার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজার হাজার শিক্ষার্থী রাজধানী ঢাকা ও বিভাগীয় শহর রাজশাহীতে বিক্ষোভ করেছেন। শনিবার ঢাকা ও নয়া দিল্লি বেশ কয়েকটি চুক্তি স্বাক্ষর করে। এর মধ্যে বাংলাদেশের ফেনি নদী থেকে ভারতকে ১.৮২ কিউসেক (প্রতি ঘন্টায় ১,৮৫,৫৩২ লিটার) পানি নিতে অনুমোদন দিয়ে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এর সমালোচনা করে আবরার একটি পোস্ট দিয়েছিলেন। এ জন্য তাকে পিটিয়ে হত্যা করেছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা।

এতে আরো বলা হয়, কয়েক দশক ধরে নদীর পানি বন্টন নিয়ে চুক্তি করতে এক রকম সংগ্রাম করছে ঢাকা ও নয়া দিল্লি। গঙ্গার পানি বন্টন নিয়ে একটি বিতর্কিত চুক্তিকে বাংলাদেশে দীর্ঘদিন দেখা হয় এমন একটি চুক্তি হিসেবে, যা থেকে সুবিধা পায় ভারত। আবরারের এক সহপাঠী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, ফেসবুকের পোস্টের কারণে আবরারকে হত্যা করা হয়েছে। এ এক উন্মাদনা। ছাত্রলীগের দুর্বৃত্তরা তাকে হত্যা করেছে। আমরা এর বিচার চাই।

ফাহাদের পিতা ৫৭ বছর বয়সী বরকত উল্লাহ। তিনি সন্তান হারানোর বেদনায় মুষড়ে পড়ছেন। তবুও বলছেন, আমরা ছেলে নিরপরাধ। সে তার জোরালো মতামত ব্যক্ত করেছে এবং এর জন্যই তাকে হত্যা করা হয়েছে। ফাহাদের কাজিন আবু তালহা রাসেল (৩১) বলেন, পরিষ্কার প্রমাণ রয়েছে যে, কারা ফাহাদকে হত্যা করেছে। শেরে বাংলা হলের আবাসিক ছাত্ররা এবং তার বেশ কয়েকজন সহপাঠী আল জাজিরার কাছে ফাহাদ হত্যাকাণ্ডের জন্য ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের দায়ী করে তাদের দিকে আঙ্গুল তুলেছেন। আল জাজিরা আরো লিখেছে, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসকরা ময়না তদন্ত রিপোর্টে বলেছেন, শরীরের ভিতরে রক্তক্ষরণ ও অতিরিক্ত ব্যথায় মারা গেছেন ফাহাদ। তাকে ভয়াবহ প্রহার করা হয়েছে থেঁতলানো কোনো কিছু দিয়ে। সেটা হতে পারে ক্রিকেট স্ট্যাম্প অথবা বাঁশের লাঠি।

এ হত্যার প্রতিবাদে বিক্ষোভ হয়েছে রাজশাহীতে। সেখানে বড় বড় সড়কগুলো অবরোধ করেন শিক্ষার্থীরা। এতে শিক্ষকরাও যোগ দেন বলে মনে করা হয়। এ ঘটনায় বেশ বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কয়েকজন ছাত্রকে আটক করা হয়েছে। তাদের অনেকেই ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে যুক্ত এবং এই হত্যার সঙ্গে জড়িত। এর আগে ঢাকা মেট্রোপলিটল পুলিশের অতিরিক্ত ডেপুটি কমিশনার আবদুল বাতেন সাংবাদিকদের বলেছেন, নিরাপত্তা ক্যামেরার ফুটেজের ওপর ভিত্তি করে চিহ্নিত করার পর তারা ওইসব শিক্ষার্থীকে নিরাপত্তা হেফাজতে নিয়েছেন। তবে কি কারণে হত্যাকাণ্ড হয়েছে তার মোটিভ এখনও জানায় নি পুলিশ। ওদিকে এই হত্যা নিয়ে জনগণের মধ্যে দেখা দিয়েছে ক্ষোভ।

আল জাজিরা আরো লিখেছে, ছাত্রশিবিরের সঙ্গে যুক্ত থাকার বিষয়ে ফাহাদকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। ছাত্রশিবির হলো বাংলাদেশের বৃহত্তম ইসলামপন্থি দল জামায়াতে ইসলামীর ছাত্র সংগঠন। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপির সঙ্গে জামায়াতে ইসলামীর রয়েছে সম্পর্ক। বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের সহকারী সম্পাদক আশিকুল ইসলাম বিটু স্বীকার করেছেন, ফাহাদ ছাত্রশিবিরের কর্মী এমন সন্দেহে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা তাকে তার কক্ষ থেকে তুলে নিয়ে যান। ওদিকে বুয়েটের আবাসিক চিকিৎসক ডা. মাশুক এলাহি সাংবাদিকদের বলেছেন, ঘটনার রাত ৩টার দিকে শেরে বাংলা হলের শিক্ষার্থীরা তাকে ডেকে নেয়। তার ভাষায়, আমি হলে গেলাম। দেখলাম সিঁড়ির কাছে পড়ে আছে একটি মানুষের দেহ। ততক্ষণে সে মারা গেছে। তার সারা শরীরে আঘাতের চিহ্ন ছিল।

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, আইন তার নিজস্ব গতিতে চলবে। তদন্ত চলছে। তদন্তে যাদের দায়ী পাওয়া যাবে তাদের বিরুদ্ধেই আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে। অন্যদিকে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি এই হত্যার নিন্দা জানিয়েছে। তারা বলেছে, ক্ষমতাসীন দলের সদস্যদের হাত রক্তে রঞ্জিত। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এক বিবৃতিতে বলেছেন, আমার কাছে মনে হচ্ছে, আমরা এক মৃত্যু উপত্যকায় বসবাস করছি।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একই সঙ্গে আওয়ামী লীগের সভানেত্রীও। তিনি সাম্প্রতিক মাসগুলোতে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, সহিংসতা ও চাঁদাবাজির অভিযোগে কঠোরতা অবলম্বন করেছেন। গত মাসে চাঁদাবাজির অভিযোগে তিনি ছাত্রলীগের সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন এবং সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানিকে বরখাস্ত করেছেন তাদের পদ থেকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের প্রফেসর ড. আসিফ নজরুল বলেছেন, ছাত্রশিবিরে যুক্ত থাকার অভিযোগে অথবা সরকার বিরোধী পোস্ট ফেসবুকে দেয়ার কারণে একজন সহপাঠী ছাত্রকে জিজ্ঞাসাবাদের অধিকার ছাত্রলীগকে কে দিয়েছে? তিনি আল জাজিরাকে বলেন, ছাত্রলীগ সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। তাদের প্রশ্নবিদ্ধ কর্মকাণ্ড বন্ধ করতে হবে।

ওদিকে প্রায় একই রকম কথা লিখেছে ভারতের অনলাইন ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস। এতেও বলা হয়, বুয়েট শিক্ষার্থী ফাহাদ হত্যার ব্যাপক প্রতিবাদ করেছেন বাংলাদেশের কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। এতে যোগ দিয়েছেন শিক্ষকরা পর্যন্ত।

 

Please follow and like us:

Check Also

দেশীয় খেলাকে সমান সুযোগ দিন: প্রধানমন্ত্রী

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অন্যান্য খেলার পাশাপাশি দেশীয় খেলাকেও সুযোগ দেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট কতৃর্পক্ষের প্রতি আহবান …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।