আবরার হত্যার লোমহর্ষক বর্ণনা পানিও দেয়নি খুনিরা, বলে ও নাটক করছে; কালেমা পড়তে পড়তে বিদয়া নেয় সে

ক্রাইমবার্তা রিপোটঃ  রাত আটটায় শেরে বাংলা হলের ২০১১ নম্বর কক্ষে ডেকে নেয়া হয় আবরার ফাহাদকে। এরপর থেকে শুরু নির্যাতন। প্রথমে জিজ্ঞাসাবাদের নামে চলে মানসিক নির্যাতন। পরে শুরু  হয় পেটানো। সেখানে থাকা ছাত্রলীগ নেতারা পেটানোর ফাঁকে ফাঁকে মদ পান করে। কয়েক ঘণ্টা পেটানোর পর রাত দুইটার দিকে আবরার নেতিয়ে পড়েন। কয়েক বার বমি করে। মুখ দিয়ে ফেনা বের হতে থাকে।

তাকে টেনে হিচড়ে বাইরে নিয়ে যাওয়া হয়। ফেলে দেয়া হয় সিঁড়ির সামনে। মুমূর্ষু অবস্থায় খুনীদের উদ্দেশ্যে মৃদু কণ্ঠে কথা বলেন আবরার। বলেন, আমার অবস্থা খুবই খারাপ। মনে হচ্ছে আমি মরে যাচ্ছি। আমাকে মাফ করে দেন। আমাকে একটু পানি খেতে দেন। কিন্তু খুনীরা আবরারের অন্তিম এ আবদারটুকুও পূরণ করেনি। উল্টো তারা হাসাহাসি করে বলে, ও নাটক করছে। পরে তারা আবরারকে ফেলে টিভি রুমে খেলা দেখতে চলে যায়। সিঁড়ির সামনে ফেলে যাওয়ার পর বেশ কয়েকজন আবরারকে জীবিত অবস্থায় দেখেছেন। আরাফাত নামে এক শিক্ষার্থী বলেন, আমি খাবার নিতে নিচে নেমে দেখি আবরারের নিথর দেহ পড়ে আছে। শের-ই বাংলা হলেই থাকেন আরাফাত। তিনি বলেন, আমি বলি ভাই কি হইছে? আবরার বলে, ভাই বাঁচা বাঁচা।

আমি হাত-পা মালিশ করা শুরু করি। শরীর এতোটাই ফুলে ছিলো যে রগ খুঁজে পাচ্ছিলাম না। আমি চিল্লাইতাছি ভাই কেউ একটু ডাক্তাররে খবর দে। কেউ যে চোখের সামনে মরতে পারে কল্পনাই করি নাই। তিনি বলেন, যখন হাত মালিশ করতে ছিলাম তখন দেখি হাতের মধ্যে রক্তের ছোপ। পুরো বডি ঠান্ডা। মনে হচ্ছিল তোশকের মধ্যে একটা বরফের টুকরা পড়ে আছে। আবরারের তোশক ছিলো প্রস্রাবে ভেজা। তোশকে বমি। মুখে ফেনা। হাত পা মালিশ করার পরও কিছু না হওয়ায় বুক মালিশ শুরু করি। চাপ দেই কিছু হচ্ছে না। ভিতর থেকে হো হো একটা শব্দ আসে।

কাঁদতে কাঁদতে আরাফাত বলেন, মাপ করে দিস ভাই আবরার। আমি তোরে বাঁচাইতে পারি নাই। শেষ সময়ে আবরার বলেছিলো, আল্লাহ আমার সকল গুণা মাপ করে দিও। ঠিক মারা যাওয়ার আগ মুহুর্তে সে কালেমা পড়ে। মারা যাওয়ার আগে আবরার তার বন্ধুকে ফোন দিয়েছিলেন, এমনটাই টকশোতে বলেন ছাত্রলীগের এক নেতা। সেই কথার প্রেক্ষিতে ওই শিক্ষার্থী বলেন, যে মানুষটা এই রকম নির্মম অবস্থায় পড়ে আছে। যে কথা বলতে পারছিলো না ঠিক মতো সে কি করে ফোন করবে? আর আবরারের ফোনতো তারা আগেই নিয়ে গিয়েছিলো।
আন্দোলনরত আরেকজন বলেন, আবরার যখন অসুস্থ হয়ে পড়েছিলো। তখন থানায় ফোন করে তারা। ও যদি মারা না যেত ওকে শিবির বলে চালিয়ে দেয়া হতো। আমরা জানতাম আমাদের বন্ধু, আমাদের ভাই শিবির করতো। কিন্তু মারা যাওয়ার কারণে পুলিশের হাতে শিবির বলে ধরিয়ে দিতে পারে নাই।

মহিউদ্দিনও থাকতেন সেই হলে। তিনি আড়াইটার দিকে পড়া শেষে খেতে বের হন। তখন তিনি দেখেন আবরার সিঁড়ির মেঝেতে কাতরাচ্ছে। তিনি বলেন, আমি আমার রুমমেটকে বলি ওর মনে হয় মৃগি হয়েছে ওকে হাসপাতালে নিতে হবে। বুয়েট ছাত্রলীগের ক্রীড়া সম্পাদক জিয়ন তখন বলে, ও নাটক করতেছে। ওকে ফেলে রাখ। তোরা যা। ওরে এখনো ২ ঘণ্টা পিটানো যাবে। আমি ৩দিন ঘুমাইতে পারিনি। আমারে মাপ করে দিস ভাই।
এই ২০১১ নম্বর রুমের টর্চারের কথা বলেন, আরেক শিক্ষার্থী। তিনি বলেন, গত ২ তারিখ আমাকে ও আমার রুমমেটকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিলো সেই রুমে। আমরা ৩০০৭ নম্বর রুমে থাকি। এর ২ দিন আগে স্যার যখন আসে তার আগে বলে তোরা স্যারকে কিছু বলিস না। তোদের আর ডাকা হবে না। ঘটনার দিন আমরা রুমে ছিলাম। আমার বন্ধু ডাকলেও দরজা খুলে দেয়নি। এইছিলো আমাদের অপরাধ। ১৭ ব্যাচের লীগের ভাইয়েরা আমাকে ও আমার বন্ধুকে নিয়ে যায়। সিয়ামকে যেভাবে মারা হয় আমি দেখে সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলি। সংজ্ঞা ফেরার পর তারা বলে, এই রুম থেকে জীবিত ফিরতে পারবি কীনা সেটা ভাব। তিনি আরো বলেন, আমি এই বুয়েটে অনেক স্বপ্ন নিয়ে পড়তে এসেছি। এখন আমার আর এই বুয়েটে পড়তে ইচ্ছা করে না।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র কল্যাণ পরিচালক অধ্যাপক মিজানুর রহমানও সেই রাতের বর্ণনা দিয়ে বলেন, প্রাধ্যক্ষ্য ও সহকারী প্রাধ্যক্ষ রোববার রাত ২টা ৪৫ মিনিটের দিকে আমার বাসায় যান। খুব বিমর্ষ অবস্থায় বলেন, আমার হলে খুন হয়েছে। তাদের সঙ্গেই আমি হলে আসি। সিসিটিভি ফুটেজ সাদা পাঞ্জাবী পড়া ব্যাগ থাকা লোকটিকে দেখা গেছে, তিনি ছিলেন ডাক্তার। তিনি পরীক্ষা করে বলেন, সেতো অনেক আগেই মারা গেছে। এরপর সেখানে থাকা ছাত্রলীগের নেতারা চাপ দিতে থাকে লাশ নিয়ে যাবার জন্য। কিন্তু ডাক্তার বলেন, আমি লাশ নিয়ে যেতে পারবো না। এটা পুলিশ কেস। তখন তিনি বলেন, সেখানে থাকাদের আমি চিনিনা। শুধু রাসেলকে চিনি। এরপর আমি ভিসিকে ফোন দিয়ে ঘটনা বলি। ভিসি আমাকে বলেন, পুলিশকে ফোন দিতে। পুলিশ যা করবার করবে। চকবাজার থানায় ফোন দেবার পর পুলিশের সঙ্গে একজন ডাক্তার আসেন। তিনি সেখানেই সুরতহাল রিপোর্ট করেন।
এই শিক্ষক আরো বলেন, সুরতহালের সময় হল প্রাধ্যক্ষ, সহকারী প্রাধ্যক্ষ, ডাক্তার ও আমি ছিলাম। এরপর পুলিশ লাশ ঢামেক মর্গে নিয়ে যায়। তিনি বলেন, পুলিশ হলে আগেও এসেছিলো এটা তিনি জানতেন না। পরে ভোর বেলা কিছু শির্ক্ষার্থীদের কাছে জানতে পারি হলে পুলিশ এসেছিলো শিবির ধরতে।

Please follow and like us:

Check Also

বাংলাদেশি জাহাজ ছিনতাইয়ের সঙ্গে জড়িত ৮ জলদস্যু গ্রেফতার

বাংলাদেশি জাহাজ এমভি আব্দুল্লাহ অপহরণে যুক্ত ৮ জলদস্যুকে আটক করেছে সোমালিয়ার পুলিশ। রোববার জাহাজটিকে মুক্তি …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।