ভাল নেই সাতক্ষীরা সুন্দরবনাঞ্চলের হাজারও জেলে পরিবার

সামিউল মনির, ক্রাইমবার্তা রিপোটঃ  শ্যামনগর: সুন্দরবনে প্রবেশে বিধি নিষেধ থাকায় সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকায় বসবাসরত জেলেদের জীবনে চরম দু:সময় ভর করেছে। আয় রোজগার না থাকায় বেকার হয়ে পড়া জেলেরা পরিবার পরিজন নিয়ে অর্ধাহার অনাহারে দিন কাটাচ্ছে। মুষ্টিমেয় জেলে চড়াসুদে মহাজন থেকে নেয়া ঋণ আর দাদনের অগ্রীম টাকায় দিন পার করলেও অধিকাংশেরই পরিবারে চলছে হাহাকার।

আইলার পর থেকে এলাকাজুড়ে কর্মসংস্থান সংকটের তীব্রতায় আপদকালীন এ সময়ে তারা বিকল্প কোন কাজও পাচ্ছে না। ফলে দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলীয় জনপদের প্রায় দশ হাজার জেলে পরিবারে দুর্দিন নেমে এসেছে।

সুন্দরবন সংলগ্ন দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলবর্তী গাবুরা, কৈখালী, মুন্সিগঞ্জ ও বুড়িগোয়ালীনির বিভিন্ন এলাকা ঘুরে ও স্থানীয়দের সাথে কথা বলে এমন চিত্রের দেখা মিলেছে। জেলেদের দাবি ইলিশের প্রজনন মৌসুমের কারনে নদ-নদীতে মাছ শিকারে নিষেধাজ্ঞা জারি হলেও সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকার জেলেরা সাদা মাছ ও কাঁকড়া ধরে।

তীব্র লবণাক্ততার কারণে এতদাঞ্চলের নদীসমুহে ইলিশের দেখা মেলে না উল্লেখ করে তারা জানায় নিষেধাজ্ঞা চলাকালীন জেলে পরিবারগুলোর জন্য সরকার ঘোষিত প্রণোদনা সুবিধাও পাচ্ছেনা তারা।

ফলে নদীতে নামায় নিষেধাজ্ঞার বিপরীতে সরকারি প্রণোদনা থেকে বঞ্চিত দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলীয় এলাকার হাজারও জেলে পরিবারের দিন কাটছে চরম দুর্দশা ও দুরাবস্থার মধ্যে।

সুন্দরবন তীরবর্তী মুন্সিগঞ্জের কদমতলা গ্রামের মো. ফজের আলী জানায়, তিন সন্তান আর নির্ভরশীল পিতা মাতা নিয়ে সাত সদস্যের সংসার তার। অক্টোবরের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে নিষেধাজ্ঞার কারনে বনে যেতে না পারায় বাড়িতে চুলা জ¦লছে না তিন দিন ধরে। দোকান থেকে বাকিতে নিয়ে আসা চিড়া আর মুড়ি খেয়ে সন্তান ও বৃদ্ধ মা-বাবাকে নিয়ে কোন রকমে দিন করছে।

অসহায়ত্বের সুরে প্রায় একই কথা জানালেন সুন্দরবনের কোলে গড়ে ওঠা জনপদ গোলাখালী গ্রামের বাবু রাম আর কালিঞ্চির সুমিত মুন্ডাসহ স্থানীয় জেলেরা। ঋণ দেনা করে অনেকে পরিবারের সদস্যদের মুখে দু’বেলা দুমুঠো ‘অন্ন’ যোগান দিতে সমর্থ হলেও অধিকাংশেরই দাবি স্ত্রী সন্তান নিয়ে তারা গত কয়েক দিন ধরে অর্ধাহারে আনাহারে রয়েছেন।

তবে সংলগ্ন এলাকায় ইলিশের দেখা না মেলার পরও ইলিশ শিকার বন্ধে তাদেরও বনে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারির বিরুদ্ধে অভিযোগ স্থানীয় অসংখ্য জেলের।

রাস্তার উপর বসে জাল মেরামতে মনোযোগী দাতিনাখালী গ্রামের শোকর আলী ও আবু সালেহ বলেন, ইলিশের সংরক্ষন ও বংশ বিস্তারের জন্য মাছ শিকার বন্ধ। কিন্তু ইলিশ শিকারের সাথে জড়িতরা সরকারি ঘোষনায় চাল পেলেও তারা সে সুবিধা পাচ্ছে না। অথচ ইলিশের বংশ বিস্তারের কারনে তাদেরকে সুন্দরবন সংলগ্ন নদ-নদীতে প্রবেশের অনুমতি দেয়া হচ্ছে না। এসব জেলের দাবি পরিবার পরিজনের মুখে দু’বেলা দু’মুঠো খাবার তুলে দিতে তারা দাদন ব্যবসায়ীর নিকট থেকে অগ্রীম টাকা নিয়েছেন। পরবর্তীতে বনে যাওয়ার অনুমতি মিললে মালিকের বেঁধে দেয়া মুল্যেই তাদেরকে শিকারকৃত মাছ-কাঁকড়া তুলে দিতে হবে বলেও তারা জানান।

সুন্দরবন সংলগ্ন নদ-নদীতে মাছ শিকারে বিধি নিষেধ থাকায় অসংখ্য জেলে পরিবার পরিজান নিয়ে অর্ধ্বাহারে অনাহারে দিনাতিপাত করলেও অনেকে আবার কাজের সন্ধানে এলাকার বাইরে চলে যাচ্ছে বলে তথ্য মিলেছে। মহাজনের চড়াসুদের ঋণ আর দাদন ব্যবসায়ী থেকে নেয়া অগ্রীম টাকা পরিশোধ করার তাড়নায় ঢাকা সংলগ্ন গাজিপুর এলাকার ইটের ভাটায় কাজ করতে যাচ্ছেন আবু জার ও ফরিদ হোসেন নামের দুই জেলে।

কদমতলা গ্রামের ঐ দুই জেলের দাবি অক্টোবরের শুরু থেকে নদীতে যাওয়ার অনুমতি না মেলায় আয় রোজগার বন্ধ। তাই মহাজনের থেকে সুদে নেয়া টাকায় পরিবারের খোর-পোষ চলছে। সুদের হার বেশী হওয়াতে মাছ-কাঁকড়া ধরে দেনা থেকে মুক্তি মিলবে না ভেবে জাল-দড়া তুলে রেখে উত্তরে যাচ্ছি।

তবে এমন চিত্র শুধু কদমতলা ও দাতিনাখালী এলাকায় না, বরং গোলাখালী, মীরগাং, কৈখালী, কালিঞ্চি ও গাবুরাসহ বিস্তৃত এ উপকূলীয় জনপদের সমগ্র জেলে পল্লীতে অভিন্ন দৃশ্য। আয় রোজগারের খাত বন্ধ থাকায় দিন এনে দিন খাওয়ায় অভ্যস্ত হাজার হাজার জেলে পরিবারে এখন যেন এক নিরব দুর্ভিক্ষ শুরু হয়েছে। মাহজনের চড়া সুদের ঋণ আর দাদন ব্যবসায়ীর অগ্রিম টাকার কঠিন শর্তের বেড়াজালে স্বেচ্ছায় ধরা দিয়েও অধিকাংশ পরিবার অর্ধাহার অনাহারে দিন পার করছে বলেও জানায়।

মুন্সিগঞ্জের আটির উপর এবং কালিবাড়ি এলাকার আশরাফ আলী, রঘুরাম সর্দার ও মনো বাউলিয়াসহ অসংখ্য জেলের দাবি নদীতে নামতে না পারায় দুই সপ্তাহ ধরে আয় রোজগার নেই। কিন্তু প্রতিদিনই পরিবারের সদস্যদের মুখে ভাত পানি তুলে দেয়ার মত অর্থ কড়ি যোগাড় করতে না পরার ব্যর্থতায় তাদের অনেকে এক পেটা আধ পেটা থেকে শুরু করে দিনে একবার পর্যন্ত খেতে বাধ্য হচ্ছে।

এসব জেলের অভিযোগ ইতিপুর্বে মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে জুলাই-আগস্ট প্রায় দুই মাস নদীতে নামতে দেয়া হয়নি। নুতন করে ইলিশের প্রজনন মৌসুমের কারণে আবারও তাদের জাল গড়া তুলে রাখতে বাধ্য করায় কাজের অভাবে তারা নিদারুন অর্থ কষ্টে ভুগছেন। তাদের অভিযোগ জুলাই-আগস্টের বন্ধের সময়ে সরকারি প্রণোদনা পেলেও এবার কোন সাহায্য না মেলায় তাদের দুর্দশা চরমে পৌছেছে।

এবিষয়ে পশ্চিম সুন্দরবনের সাতক্ষীরা রেঞ্জের কোবাদক স্টেশন অফিসার বেলাল হোসেন বলেন, ইলিশের প্রজনন মৌসুমের কারনে আপাতত তিন সপ্তাহের জন্য বনে প্রবেশ করতে দেয়া হচ্ছে না। নভেম্বরের শুরু থেকে জেলেদের পুনরায় সুন্দরবন সংলগ্ন নদ-নদীতে মাছ কাঁকড়া শিকারের অনুমতি দেয়া হতে পারে।

উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা ফারুক হোসাইন জানান, পূর্ব ঘোষণা না দিয়ে আকস্মিকভাবে সুন্দরবন সংলগ্ন নদ-নদীতে যাওয়ার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞার ফলে জেলেরা কষ্ট পাচ্ছে। আগে থেকে ঘোষনা দেয়া হলে জেলেরা পূর্ব প্রস্তুতি নেয়ার সময় পেতো জানিয়ে তিনি বলেন, সরকারিভাবে আপাতত জেলেদের কোন সহায়তা দেয়ার বিষয়ে কোন সিদ্ধান্ত নেই।

Check Also

মালয়েশিয়ার পাম তেলে ইইউ’র নিষেধাজ্ঞা বাংলাদেশের শ্রমবাজারে অশনি সংকেত

বন উজাড়, কার্বন নির্গমনের ঝুঁকি এবং পরিবেশের ভারসাম্য নষ্টগত কারণ দেখিয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ মালয়েশিয়ার …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।