আজ ঐতিহাসিক দেবহাটা মুক্ত দিবস, বীর বাঙালির কাছে পরাস্ত হয়ে দেবহাটা ছাড়ে পাক বাহিনী

দেবহাটা ব্যুরো: আজ ঐতিহাসিক ৬ ডিসেম্বর, দেবহাটা মুক্ত দিবস। মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিগাঁথা এই দিনে দেবহাটা উপজেলা পাক হানাদার মুক্ত হয়েছিলো। বাঙালির হাতে উড়েছিলো বহু প্রতিক্ষীত বিজয়ের পতাকা। পাক হানাদার মুক্ত হয়ে সমগ্র এলাকার মানুষের মুখে আনন্দের হাসি ফুটে উঠেছিলো। এই দিনে দেবহাটার মানুষ খুঁজে পেয়েছিল দীর্ঘদিনের যুদ্ধ বিজয়ের আনন্দ।

দেবহাটা উপজেলা প্রশাসন ও উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের পক্ষ থেকে এই দিনটিকে স্মরণ করে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। আজ সকালে বর্ণাঢ্য বিজয় র‌্যালি পরবর্তী নব-নির্মিত মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স ভবনে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে। এ কর্মসূচিতে সাতক্ষীরা-০৩ আসনের সংসদ সদস্য ও সাবেক সফল স্বাস্থ্যমন্ত্রী অধ্যাপক ডা. আ. ফ. ম রুহুল হক এমপি ও সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক এসএম মোস্তফা কামালসহ উচ্চ পদস্থ প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের উপস্থিত থাকার কথা রয়েছেন বলে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সাজিয়া আফরীন জানিয়েছেন।

১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে সমগ্র দেবহাটা উপজেলা ৯ নং সেক্টরের অর্šÍভুক্ত ছিলো। তৎকালীন সময়ে সাতক্ষীরা কোর্ট চত্ত্বরের ট্রেজারী থেকে ৪ শত রাইফেল্স লুট করে আবদুল গফুর, এম এল এ আয়ুব হোসেন ও ক্যাপ্টেন শাহাজান মাস্টার জীবন বাজি রেখে ৯ নং সেক্টর গঠন করে। এই ৯ নং সেক্টরের আওতায় ৩ টি সাব-সেক্টরও গঠন করা হয়েছিলো। তার মধ্যে প্রথম সাব-সেক্টরটি ছিল শমসের নগরে। যার নেতৃত্বে ছিলেন ক্যাপ্টেন নুরুল হুদা। দ্বিতীয়টি ছিলো হেঙ্গলগঞ্জে ও তৃতীয় সাব- সেক্টরটি ছিল টাকীতে। তৃতীয় সাব-সেক্টরের অর্ন্তভুক্ত ছিলো দেবহাটা। আর এই সাব-সেক্টরের কমান্ডার হিসেবে মুল নেতৃত্বে ছিলেন প্রয়াত ক্যাপ্টেন শাহজাহান মাস্টার।

মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশের সর্বমোট ১১ টি সেক্টরের মধ্যে ৯ নং সেক্টরটি ছিল সর্ববৃহৎ। মেজর জলিল ছিলেন ৯ নং সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার। তবে মুলত ক্যাপ্টেন শাহজাহান মাস্টারের উদ্যোগেই ভারতের টাকীতে গড়ে তোলা হয় ৯ নং সেক্টরের মুল ঘাঁটি। সেজন্য তাকে ৯ নং সেক্টরের প্রতিষ্ঠাতা ও সাব সেক্টর কমান্ডারের খেতাব দেয়া হয়। তারই বলিষ্ঠ নেতৃতে এ অঞ্চলের যুবকেরা মুক্তিযুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়ে। দেশ মাতৃকার টানে এলাকার যুবকদের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের প্রেরণা ও সাহস যুগিয়েছিলেন তিনি। তখন দেবহাটা এলাকার খানজিয়া ক্যাম্প, দেবহাটা ক্যাম্প, টাউনশ্রীপুর ক্যাম্প, সখিপুর ক্যাম্প, পারুলিয়া ক্যাম্প, কুলিয়া বাজার ও পুষ্পকাটি ইটেরভাটাসহ বিভিন্ন এলাকায় পাক সেনারা ঘাঁটি গড়ে তোলে।

দেবহাটা এলাকায় টাউনশ্রীপুর ফুটবল মাঠে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে পাক সেনাদের প্রচন্ড যুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের খবর পাক সেনাদের কাছে পৌছে দেয় এক রাজাকার। ফলে পাক সেনারা মুক্তিযোদ্ধাদেরকে চারিদিক থেকে ঘিরে ফেলে। বিষয়টি ক্যাপ্টেন শাহজাহান মাস্টার বুঝতে পেরে অসীম সাহসের সাথে যুদ্ধ করেন। প্রায় ২ ঘন্টাব্যাপী যুদ্ধে দু’পক্ষের ব্যাপক গোলাগুলি শেষে পাক সেনারা মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পরাস্ত হয়। এই যুদ্ধে বহু পাক সেনা নিহত হয়। এছাড়া ভাতশালা সহ বিভিন্ন যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন মরহুম ক্যাপ্টেন শাহজাহান মাস্টার।

ভাতশালা যুদ্ধের শেষের দিকে হঠাৎ একটি বুলেট এসে মুক্তিযোদ্ধা গোলজারের মাথায় লাগে। সেখানেই তিনি নিহত হন। এক পর্যায়ে টাউনশ্রীপুরের সেনা ঘাটির পতন হয়। তখন মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি জেনারেল এম. এ জি ওসমানী, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহম্মেদ ও সেক্টর কমান্ডার এম. এ জলিল সকলে মিলে ক্যাপ্টেন শাহজাহান মাস্টারকে নিয়ে বিজয় উল্লাস করেন। তবে পাক সেনারা এখান থেকে যাওয়ার সময় শাহজাহান মাস্টারের বাড়ি জ্বালিয়ে দেয়।

অক্টোবর মাসে খান সেনারা খাঁনজিয়া ক্যাম্প ছেড়ে পলায়ন করে। তারা যাওয়ার সময় ঐ এলাকায় বেশ কিছু সংখ্যক এ.পি মাইন পুতে রেখে গিয়েছিলো। যে মাইনগুলো অপসারণ করতে যেয়ে মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল ওহাব শহীদ হন। পরে পারুলিয়া, সখিপুর ও কুলিয়াসহ বিভিন্ন এলাকায় সংঘটিত সম্মুখ যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর কাছে পরাস্ত হয়ে পাক সেনারা দেবহাটা ছেড়ে চলে যায়। তবে চলে যাওয়ার সময় বহু মানুষের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেয়াসহ পারুলিয়া ব্রীজটি ধ্বংস করে দেয় হানাদার বাহিনী। এভাবেই অদম্য, সাহসী আর অকুতোভয় বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অক্লান্ত প্রচেষ্টায় দেবহাটা উপজেলা পাক হানাদার মুক্ত হয় এবং সর্বত্র উড়তে শুরু করে বিজয়ের পতাকা।

Check Also

মালয়েশিয়ার পাম তেলে ইইউ’র নিষেধাজ্ঞা বাংলাদেশের শ্রমবাজারে অশনি সংকেত

বন উজাড়, কার্বন নির্গমনের ঝুঁকি এবং পরিবেশের ভারসাম্য নষ্টগত কারণ দেখিয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ মালয়েশিয়ার …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।