করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হওয়া এক প্রবাসিরকে ফুলের মালা পড়িয়ে দিচ্ছে, কেউ তাদের সাথে সেলফি- তুলছে

কবীর চৌধুরী তন্ময়
করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হয়ে এক লোক হাসপাতাল থেকে পালিয়েছে শুনে চারজন যুবক তাকে খোঁজতে বেরিয়ে পড়ল। নানা জায়গায় খোঁজাখোঁজির পর অবশেষে তাকে তার শশুর বাড়িতে পেল। স্বেচ্ছায় আসতে না চাওয়ায় একটা সময় রীতিমত জোর করে ওই প্রবাসীকে চারজন বন্ধু মিলে তাদের কাঁধে করে তুলে এনে আবারও হাসপাতালে ভর্তি করাল। আর এ খবর আর কাঁধে তোলার ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হওয়ায় অত্র এলাকা ও আশেপাশের এলাকা থেকে প্রায় চার-পাঁচ’শ মানুষ এসেছে ওই চারজন বন্ধুকে দেখতে লাগল। শুধু তাই নয়, কেউ ফুলের মালা পড়িয়ে দিচ্ছে, কেউ তাদের কাঁধে তুলে নাচানাচি করছে আবার পালা করে একে একে সবাই ওই চার যুবকের সাথে সেলফি-ছবি তুলে তাদের মাথায় হাত বুলিয়ে, শরীর ও হাতে ধরে বীরত্বের জন্য বাহবা দিয়েছে।
পাঠক! এখানে মূলত অসচেতন, অসতর্ক থাকায় অতি আবেগ-উল্লাসের কারণে একজন করোনাভাইরাস রোগী থেকে ওই এলাকা এবং তার আশেপাশের প্রায় চার-পাঁচ’শ মানুষও কভিট-১৯ এ সংক্রমিত হয়েছে। ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়েছে দেশ থেকে দেশান্তর।
এখানে গল্পটি উল্লেখ করেছি আমাদের দেশীয় প্রেক্ষাপট বোঝানোর জন্য। এই যেমন বিদেশ ফেরত প্রবাসী ভাই-বন্ধু, আত্মীয়-স্বজন বাড়িতে এলেই আমরা আবেগ ভালোবাসা নিয়ে এভাবেই হুমড়ি খেয়ে পড়ি। এ বাসায় আমন্ত্রণ শেষ হতে না হতেই অন্য বাসায় আমন্ত্রণ। দেখতে আসা, দেখতে যাওয়ার সাথে ঘরোয়াভাবে ধর্মীয় অনুষ্ঠানের আয়োজনগুলো-আমাদের বেশ পুরোনো। বলা যায় অভ্যেসে পরিনত হয়েছে।
আর তাই করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাসহ বাংলাদেশ সরকার বার বার নানা ধরনের নির্দেশনা দেওয়ার পরেও আমরা যেন থোরাই কেয়ার করেছি। হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকার কথা বলার পরেও আমরা সরকারের নিদের্শনাকে এড়িয়ে যাওয়া মানে আপনি আপনাকে কভিট-১৯ এর ঝুঁকি সৃষ্টি করছেন। বিদেশ সরকারের সিস্টেম মেনে বিদেশের মাটিতে কর্মজীবন যথাযথভাবে পালন করলেও বাংলাদেশে এসে আমরা অনেকে একটু বেশি বাংলাদেশি হয়ে যাই। সবাইকে বোঝাতে চাই, বাংলাদেশিরা আইন মানে না, সরকারের নিদের্শনা মানে না কিন্তু সুযোগ পেলে এই সরকার ও বাংলাদেশের সিস্টেমকে এই তারাই একহাত নিতেও ভুল করে না।
সাম্প্রতিক করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বিশ্বব্যাপী যেভাবে ছড়িয়ে পড়েছে, পড়ছে; তাতে বিশ্বসম্প্রদায় স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে নেই-এটিই বাস্তবতা। ইতোমধ্যেই আকাশপথের যোগাযোগ প্রায় বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। বেশ কয়েকটি উন্নত দেশে আজ জরুরি অবস্থা, আছে কয়েকটি দেশ সম্পূর্ণ লকডাউন অবস্থায়। সৌদি আরবে দুইটি বাদে বাকি সব মসজিদে নামাজ পড়া বন্ধ করেছে। অন্যান্য দেশের ন্যায় বাংলাদেশের পরিস্থিতিও খুব দ্রুত বদলাচ্ছে। গত ৮ মার্চ দেশে প্রথমারের মতো করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ৩ জনকে শনাক্তের পর থেকে প্রতিদিনই বাড়ছে রোগীর সংখ্যা। বুধবার (২৭ মার্চ) পর্যন্ত এই ভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা ৪৮ জনে দাঁড়িয়েছে। সুস্থ হয়েছেন ১১ জন আর মারা গেছেন ৫ জন। আক্রান্তদের কয়েকজন বিদেশ ফেরত আর বাকিরা তাদের সংস্পর্শে আক্রান্ত হয়েছেন।
ইতোমধ্যেই সরকার ১০ হাজার টেস্টিং কিটস ও ১০ হাজার প্রটেকটিভ ইকুইপমেন্ট রেডি রেখেছে। অন্যদিকে নতুন করে ১০টি দেশের ফ্লাইট চলাচল বন্ধের সিদ্ধান্ত নেওয়ার পাশাপাশি জরুরি যোগাযোগের জন্য ইউকে, থাইল্যান্ড, হংকং ও চীনের ফ্লাইট চালু রেখেছে। যাতে কারও জরুরি বা বিশেষ প্রয়োজন হলে সেই রুটগুলো ব্যবহার করতে পারে। প্রয়োজনে কভিড-১৯ মোকাবেলায় চীন থেকে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকও আনার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে।
ভয়ের কোনও কারণ নেই, নভেল করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ও সন্দেহভাজন রোগীদের চিকিৎসার জন্য শেখ হাসিনা বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট ও শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার হাসপাতালের পাশাপাশি ঢাকার অন্যান্য হাসপাতালগুলোতে সাড়ে ছয়শসহ সারা দেশে মোট ৫ হাজার ২৯৩টি আইসোলেশন বেড প্রস্তুত রেখেছে সরকার। করোনা আক্রান্ত রোগীদের জন্য আরও ৪০০ আইসিইউ ইউনিট স্থাপন করা হবে। ইতোমধ্যেই চিকিৎসকদের জন্য পার্সোনাল প্রোটেকশন ইকুইপমেন্ট (পিপিই), মাস্ক কয়েক লাখ এসেছে।
পাঠক, সুখবর হচ্ছে- চীন করোনা ভাইরাসকে জয় করেছে। শুধু চীন নয়, বাংলাদেশ সরকার যথেষ্ট প্রস্তুত থাকার কারণে ইতোমধ্যেই করোনায় সংক্রমিত দুইজনই পুরোপুরি সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে গেছেন। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম বলেছে, চীনের যে হুবেই প্রদেশে নভেল করোনাভাইরাস কভিট-১৯ ছড়িয়েছিল, সংক্রমিতদের চিকিৎসা দেওয়ার জন্য জরুরি ভিত্তিতে যে ১৬টি অস্থায়ী হাসপাতাল তৈরি করেছে- ১১টির কার্যক্রম পুরোপুরি বন্ধ করেছে। কারণ, করোনা ভাইরাসে সংক্রমিত হয়েছে নতুন করে কারো তথ্য আর পাওয়া যায়নি।
আর করোনাভাইরাসকে জয় করা বা রোগটি থেকে সেরে ওঠা মার্কিন নারী এলিজাবেথ স্নেইডার তার অভিজ্ঞতা তুলে ধরে এনডিটিভিকে বলেছেন, ‘করোনা নিয়ে আতঙ্কিত হওয়া যাবে না। যদি আপনার সন্দেহ হয়, তাহলে অবশ্যই পরীক্ষা করান। যদি উপসর্গগুলো জীবন সংহারি না হয়, তাহলে ঘরেই থাকুন। ওষুধ খান, প্রচুর পরিমানে পানি পান করুন, বিশ্রাম নিন এবং যেসব অনুষ্ঠান দেখতে চান, আপনি তা বাসায় দেখুন।’
পাঠক! আপনিও হয়তো আমার মত খুব ছোটকাল থেকেই শুনেছেন, বনের বাঘে খায় না কিন্তু মনের বাঘই খায়। একটু চিন্তা করলেই দেখবেন, আমি-আপনি যখনই কোনও কিছু নিয়ে ভয়-উৎকন্ঠা আর হতাশার মাঝে থাকি, তখন আমাদের সুন্দর চিন্তা ভাবনাগুলো লোপ পায়। অত্যন্ত সহজ কাজটিও নিজেরাই কঠিন করে তুলি। সুস্থ ও সময় উপযোগী পরিকল্পনা-সিদ্ধান্ত থেকে আমরা দূরে সরে যাই। আর বিপদ থেকে উত্তরণের দিকবিদিক ছুটে চলার চেষ্টা করি। কিন্তু অজানা, অচেনা পথের শেষ কোথায়-এটা নিশ্চয়ই বলা কঠিন। তাই আগে জানতে হবে, বুঝতে হবে এবং পরিকল্পনা করে ব্যবস্থা গ্রহণ করলে শুধু করোনা ভাইরাসই নয়, যেকোনো সংকট মোকাবেলা করা সহজ, মসৃন হয় উত্তরণের পথ-পদ্ধতিও।
করোনাভাইরাস নিয়ে গুজব না ছড়িয়ে বরং কিভাবে সবার সচেতনতার মাধ্যমে কভিট-১৯ জয় করা সম্ভব-এটি আপনারও দায়িত্ব। আমাদের মনে রাখা দরকার, বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা চাইলে যেকোনো ঝুঁকি নিয়ে তিঁনি মুজিববর্ষের পূর্বনির্ধারিত সমাবেশটি করতে পারতেন। কিন্তু সেটা না করে যেখানে দেশ ও দেশের জনগণের নিরাপত্তা এবং জনস্বাস্থ্যকেই তিঁনি বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন-সেখানে এক শ্রেণির বিতর্কিতগোষ্ঠী মুজিববর্ষকে ঘিরে করোনা ভাইরাসের উপর ভর করে নানাবিধ গুজব ছড়াতে উঠেপড়ে লেগেছে-এটি সত্যিই লজ্জাজনক এবং অনভিজ্ঞতার বহিঃপ্রকাশ।
করোনাকে ভয় করবেন না কারণ, করোনা ভাইরাস থেকে নিজেকে এবং অন্যদের রক্ষা করার জন্য আপনিই যথেষ্ট। শুধু আপনাকে সভ্যতার আদলে থাকতে হবে। গতানুগতিক পুরোনো অভ্যেস পরিবর্তন করতে হবে। আপনি সাবধান-সতর্ক থাকলে আপনার সাথে-সাথে আপনার পরিবার, বন্ধু-বান্ধব সবাই সুস্থ থাকবে। যেমন- আমরা সচরাচর হাঁচি, কাশি দেওয়ার সময় পাশের লোকের কথা মোটেও চিন্তা করি না। আমাদের এই প্রবনতা দূর করতে হবে। আমার-আপনার হাঁচি, কাশি থেকে যে জলীয় পদার্থ নির্গত হয়, এটি কি সব ধরনের ভাইরাসমুক্ত? এখানে একটু অন্যভাবে চিন্তা করে দেখুন হাঁচি, কাশি থেকে আপনার শরীরে জলীয় পদার্থ পড়লে কেমন দেখায়? আবার আপনার শরীরে না পড়ুক, পাশে থাকা অন্য কোনও বস্তু-চেয়ার, টেবিল, বাড়ির সিড়ি বা অন্যের হাত এখানে স্পর্শ হবে-এমন বস্তুর উপর পড়াও নিশ্চয় সভ্যতার অংশ হতে পারে না। তাই এই জায়গায় আমাদের একটু সাবধান সতর্ক হতে হবে। হাঁচি, কাশি দেওয়ার সময় অবশ্যই হাত দিয়ে মুখ ঢেকে টিস্যু ব্যবহার করতে হবে। আর সেই টিসু যেখানে-সেখানে না ফেলে বরং ময়লা ফেলার জায়গায় ফেলুন। ভালো করে হাত ধুয়ে ফেলুন। সাবান ও পানি কাছে না থাকলে হ্যান্ড স্যানিটাইজার বা হাত জীবাণুমুক্ত করার জেল ব্যবহার করুন। অথবা হাত পরিস্কার হওয়ার আগ পর্যন্ত আপনি আপনার নাক, কান, মুখ ও চোখে স্পর্শ করা থেকে বিরত থাকুন। আর ইতোমধ্যেই করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত লোকজনের ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শ এড়িয়ে চলুন।
গুজব নয়, সঠিক তথ্য-উপাত্ত আর আপনার সচেতনতাই আপনার ও আপনার পরিবারের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে। সরকার দেশের প্রতিটি মানুষের পাশে অতন্দ্র প্রহরীর মত আছে। বৈশ্বিক মহামারীতে রূপ নেওয়া নভেল করোনাভাইরাসে বাংলাদেশের মানুষের স্বাস্থ্য নিরাপত্তার বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে বঙ্গবন্ধু কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শনিবার (২১ মার্চ) বিকালে বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের সাথে বৈঠক করে স্বাধীনতা দিবসে জাতীয় স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা নিবেদন এবং বঙ্গভবনে সংবর্ধনা অনুষ্ঠানও বাতিল করেছেন। অন্যদিকে স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্কালে বুধবার (২৫ মার্চ) জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে বর্তমান পরিস্থিতিকেও যুদ্ধের সঙ্গে তুলনা করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘করোনাভাইরাস মোকাবেলাও একটা যুদ্ধ। এ যুদ্ধে আপনার দায়িত্ব ঘরে থাকা। আমরা সকলের প্রচেষ্টায় এ যুদ্ধে জয়ী হব।’
চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের আশ্বস্ত করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘তাদের সুরক্ষার জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ সরঞ্জাম সরবরাহ করা হয়েছে এবং যথেষ্ট পরিমাণ সরঞ্জাম মজুদ আছে। ব্যক্তিগত সুরক্ষা সামগ্রীরও পর্যাপ্ত মজুদ রয়েছে। এ ব্যাপারে বিভ্রান্ত হবেন না। স্বাস্থ্যকর্মীদের সুরক্ষার বিষয়ে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। গতকাল পর্যন্ত ১৩ হাজার পরীক্ষা কিট মজুদ ছিল। আরও ৩০ হাজার কিট শিগগিরই দেশে পৌঁছবে।’
পাঠক! একটি কথা মনে রাখবেন, প্রতিটা দুর্যোগ বা বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে একটি জাতির সার্বিক অবস্থা বোঝা যায়। অর্থনৈতিক দৃঢ়তা, রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, কারিগরি ও কৌশলগত দক্ষতা, পুঁজিপতিদের সামাজিক দায়বোধ, জনগণের সুশিক্ষা, সততা, উদারতা, মানবিকবোধ, আধুনিক ধর্মীয় মুল্যবাধ ও নৈতিক শিক্ষার পাশাপাশি নাগরিকের দায়িত্ববোধ কেমন বা কতটুকু-এটিও প্রতীয়মান হয়। তাই করোনাকে ভয় নয়, জয় করুন এবং আপনার অভ্যাসে সভ্যতা আনুন। সকলের সচেতনতা আর আন্তরিক প্রচেষ্টায় আমরাও করোনাকে পরাজিত করবো।
লেখক : সভাপতি, বাংলাদেশ অনলাইন অ্যাক্টিভিষ্ট ফোরাম (বোয়াফ)
info@kabirchowdhurytanmoy.com
প্রয়োজনে : ০১৭১১০৭৫১৮৭

Please follow and like us:

Check Also

পৃথিবীর যেসব দেশে তাপমাত্রা ৫০ ডিগ্রিরও উপরে

জলবায়ু পরিবর্তনের চরম ভয়াবহতার সাক্ষী হতে যাচ্ছে সারাবিশ্ব। প্রতিদিনই একটু একটু করে বৈরি হচ্ছে আবহাওয়া, …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।