শাহাদাতে বালাকোট ও আলেম সমাজ-ইংরেজ ও বিশ্বাসঘাতকদের ষড়যন্ত্রে দারুল ইসলাম ভারত

জুলফিকার আহমদ কিসমতি :
নবগঠিত ইসলামী রাষ্ট্রকে কেন্দ্র করে সাইয়েদ আহমদ পরবর্তী পর্যায়ে ইংরেজ কবলিত সাবেক ‘দারুল ইসলাম ভারত’ পুনরুদ্ধারের জন্যে আরও অধিক শক্তি সঞ্চয় করতে প্রস্তুতি গ্রহণ করছেন, কিন্তু অপর দিকেও যুদ্ধে পরাজিত রণজিৎ সিংহ প্রতিশোধ গ্রহণে তৈরী হচ্ছিলেন। এই উদ্দেশ্যে রণজিৎ শঠতার আশ্রয় নিলেন। অর্থের লোভ দেখিয়ে সীমান্তের পাঠান ও উপজাতীয়দেরকে সাইয়েদ আহমদের দলছাড়া করার জন্যে উঠে পড়ে লাগলেন। সাইয়েদ আহমদ ছিলেন কুসংস্কার-বিরোধী। ফলে এ সব পাঠান ও উপজাতীয় লোকদের কেউ কেউ অর্থ লোভে বা কুসংস্কার বশতঃ অকপটে এ আন্দোলনকে গ্রহণ করতে পারেনি। অপর দিকে ইংরেজরাও এই উদীয়মান শক্তি সম্পর্কে ছিলো শঙ্কিত। তারা ঐ সময় ভারতের ঐ অঞ্চল নিয়ে তত মাথা না ঘামালেও শিখদের দ্বারা মুজাহিদদের নিশ্চিহ্ন করতে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল। মোজাহিদ বাহিনী এবার দ্বিমুখী ষড়যন্ত্রের সম্মুখীন হয়ে পড়লো। উপজাতীয় অনেক পাঠান সরদার শিখদের অর্থলোভ সম্বরণ করতে না পেরে সাইয়েদ আহমদের দল ত্যাগ করলো। অপর দিকে উপজাতীয়দের অনেকে সাইয়েদ আহমদের কুসংস্কার বিরোধী কাজে তাঁর প্রতি অহেতুক অশান্ত হয়ে পড়ে। তারা যেসব বেদআত কাজে লিপ্ত ছিল, মোজাহিদ নেতা সে সবের বিরুদ্ধাচরণ করতেন। কিন্তু তাতেও সংগ্রামী সাইয়েধ আমদ হতোদ্দম না হয়ে ন্যায় ও সত্যের কাজকে সমুন্নত রাখতে দৃঢ় সংকল্প নিয়ে কাজ করতে থাকলেন। যুগপৎভাবে বেদআত শির্কের বিরুদ্ধে স্পষ্ট বক্তব্য দিয়ে যেতে লাগলেন। অনেকের মতে কৌশল গত কারণেই সাইয়েদ সাহেবের ঐ সময় এ থেকে বিরত থাকা সঙ্গত ছিল। কিন্তু তিনি অন্যায়ের সাথে আপোষ না করে নিজের কাজ করেই যান। অতঃপর বিশ্বাস ঘাতকরাসহ প্রতিপক্ষ বাহিনী শক্তিশালী হয়ে উঠে। তাতেও তিনি ভীত না হয়ে জেহাদে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। বালাকোট নামক স্থানে শিখদের সঙ্গে তাঁর প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়। এ যুদ্ধে খুবি খাঁ নামক এক পাঠানের বিশ্বাসঘাতকতায় সাইয়েদ আহমদ বেরলভী ও মওলানা শাহ ইসমাইল দেহলভী শাহাদাত বরণ করেন। -(১৮৩১ খৃঃ)

বালাকোটের মুক্তিযোদ্ধারা দমে যাননি
মওলানা বেলায়েত আলী ও মওলানা এনায়েত আলীর আন্দোলন

বালাকোট যুদ্ধে মোজাহিদ বাহিনীর নেতৃবৃন্দের শাহাদাত বরণের পর তাঁদের অনেকেই সীমান্তের ইয়াগিস্তানের সিত্তানায় (আস্তানা-শিবির) সাইয়েধ সাহেবের বিশ্বস্ত খলীফাদের নেতৃত্বে সমবেত হন। উল্লেখ্য যে, সাইয়েদ সাহেব তাঁর শাহাদাতের পূর্বে নিজেই বালাকোটের রণাঙ্গণ থেকে তাঁর বিশিষ্ট খলীফা মওলানা বেলায়েত আলী আজীমাবাদীকে ভারতের অভ্যন্তরে আন্দোলনের উপকরণ সংগ্রমের কাজে নিয়োজিত থাকতে পাঠিয়েছিলেন। বালাকোটের মর্মান্তিক খবর প্রাপ্তির সময় মওলানা বেলায়েত আলী ছিলেন হায়দ্রাবাদে। এ ছাড়া ঐ সময় সাইয়েদ সাহেবের অপর যে একজন বিশিষ্ট খলীফা ছিলেন, তিনি হলেন মওলানা মুহাম্মদ আলী। তিনি বালাকোট ঘটনার সময় মোজাহেদ রিক্রুটিংয়ের কাজে নিয়োজিত ছিলেন মাদ্রাজে। আজাদী সংগ্রামের মহা নায়কের শাহাদাতের খবরে সাময়িখ ভাবে তাঁরা ব্যথায় ভারাক্রান্ত হলেও হতোদ্দম হননি।

এ ঘটনার পর মওলানা বেলায়েত আলী তাবলীগ ও জেহাদের নতুন কর্মসূচী গ্রহণ করলেন। তাঁর ছোট ভাই মওলানা এনায়েত আলীকে বাংলা দেশে পাঠান। মওলানা জয়নুল আবেদীন ও মওলানা মুহাম্মদ আলী হায়দ্রাবাদে কাজ করে যান। এ ভাবে অন্যান্য সহচর ও বন্ধু-বান্ধবদেরকে তিনি ভারতের বিভিন্ন এলাকায় প্রেরণ করেন। মওলানা বেলায়েত আলী পাটনায় দু’বছর অবস্থানের পর অন্যান্য মুসলিম রাষ্ট্রের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষাকল্পে মক্কা শরীফ গমন করেন। সেখানে হজ্জ সমাধা করে ইয়ামত, নজদ, আসীয়, মাসকাত, হাজরামাউত প্রভৃতি রাজ্য সফর করে প্রায় দু’বছর পর কলকাতায় ফিরে আসেন এবং বাংলাদেশ সফর করে ছোট ভাই মওলানা এনায়েত আলীকে সাথে করে পাটনা চলে যান। বিদেশ সফর প্রত্যাগত মওলানা বেলায়েত আলী দ্বিতীয় বার জেহাদের প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। তিনি মওলানা এনায়েত আলীকে বাংলার পরিবর্তে ইয়াগিস্তানের সিত্তানায় প্রেরণ করেন। মওলানা এনায়েত শিখ প্রধান গোলাব সিংহের সংঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হন। এ যুদ্ধ তিন বছর কাল স্থায়ী থাকে। এ দিকে মওলানা বেলায়েত আলী তাঁর কনিষ্ঠ ভ্রাতা মওলানা ফরহাত হোসাইনকে পাটনাস্থ কেন্দ্রে নিজের স্থলাভিষিক্ত করে তিনি মওলানা ফাইয়াজ আলী, মওলানা ইয়াহইয়া আলী, মওলানা আকবর প্রমুখকে নিয়ে বালাকোটে যুদ্ধরত মওলানা এনায়েত আলীর সঙ্গে মিলিত হন। মওলানা বেলায়েত আলী সেখানে গিয়ে পৌঁছুলে তাঁকেই আমীর নিযুক্ত করে ইংরেজ দোসরদের বিরুদ্ধে জেহাদ চলতে থাকে। তাঁর নেতৃত্বাধীনও দীর্ঘ দেড় বছর বালাকোট কেন্দ্রিক জেহাদ চলে এবং বহু এলাকা বিজিত হয়।

ইংরেজ সরকারের হস্তক্ষেপ

এ অবস্থা দেখে ইংরেজ সরকার প্রমাণ গুনল যে, শিখদের পরাজিত করেই মোজাহিদগণ তাদের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হবে। তাই শিখদের সাথে পূর্বে সম্পাদিত এক সামরিক চুক্তির ছুতা ধরে ইংরেজরা মওলানা বেলায়েত আলীকে এক নোটিশের মাধ্যমে জানিয়ে দিল যে, শিখ প্রধান গোলাব সিংহের সঙ্গে যুদ্ধ করাকে ইংরেজ সরকার তাদের সঙ্গেই যুদ্ধ বলে বিবেচনা করে। এর কয়েক দিন পরেই ইংরেজ সরকার মোজাহিদদের বিরুদ্ধে সশস্ত্রবাহিনী প্রেরণ করে এবং তাদের সঙ্গে সংঘর্ষ অনিবার্য হয়ে উঠে। ইংরেজগণ মোজাহিদ বাহিনীর বড় পৃষ্ঠপোষক সীমান্তের সাইয়েদ জামেন শাহ ও অন্যান্য স্থানীয় বিশিষ্ট প্রভাবশালী ব্যক্তিকে অর্থলোভ দেখিয়ে ও নানান কৌশলে হাত করে তাদের ঐক্যে ফাটল ধরায়। এতে নানা চক্রান্তের শিকার হয়ে মুজাহিদরা দুর্বল হয়ে পড়ে এবং আর্থিক উপকরণ সরবরাহ ও জটিল হয়ে দাঁড়ায়। মুজাহিদদের শক্তি ও অনুকূল পরিবেশ নষ্ট হয়। পরিশেষে এক পর্যায়ে মোজাহিদদের গ্রেফতার করা হয় এবং মুজাহিদ নেতা মওলানা এনায়েত আলী পুনরায় বাংলাদেশে তাবলীগ ও সাংগঠনিক কাজে চলে আসেন। সাময়িকভাবে একশো মুজাহিদ সোয়াতে আত্মগোপন করে থেকে যান।

পুনরায় জেহাদ

দু’বছর পর ছাড়া পেয়ে মওলানা বেলায়েত আলী পুনরায় বহু কষ্ট ও ত্যাগ স্বীকার করে ভ্রাতা মওলানা এনায়েত আলী ও অন্যান্য অনুগামী মোজাহিদদের নিয়ে আবার ইয়াগিস্তানের সিত্তানায় গিয়ে পৌঁছেন। সাইয়েদ আকবর শাহ ও অন্যান্য মোজাহিদ তাদের বিপুল সম্বর্ধনা জ্ঞাপন করেন। ভারতের বিভিন্ন স্থান থেকেও মোজাহিদগণ এখানে আসতে শুরু করেন। মওলানা এনায়েত আলীর সেনাপতিত্বে ইংরেজ তাবেদার আম্বের শাসনকর্তার সঙ্গে পুনঃরায় জিহাদ শুরু হয়। ঐ সময়ই (১২৬৯ হিঃ) মওলানা বেলায়েত আলীর ইন্তেকাল হয় এবং তাঁর স্থানে মওলানা এনায়েত আলী আমীর নিযুক্ত হন। কিন্তু তীব্র প্রতিকূলতা সৃষ্টি হওয়ায় সীমান্ত এলাকায় মুজাহিদদের জেহাদী তৎপরতা শেষের দিকে বন্ধ হয়ে গেলেও মুজাহিদ সংগঠনটি বহাল থেকে যায়।

১৮৫৭ সালের বিপ্লবের সময় বৃটিশ ভারতের বাইরে সীমান্তের ইয়াগিস্তানে মোজাহিদদের নেতৃত্বে ছিল মওলানা এনায়েত আলীর হাতে এবং ভারতের অভ্যন্তরে এ বিপ্লবের মূল নেতৃত্ব দেন ভারতস্থ মোজাহিদ নেতা মওলানা ইয়াহইয়া আলী। মওলানা ইয়াহইয়া আলী ঐ সময় পাটনাস্থ মোজাহেদ কেন্দ্র থেকে ভারতীয় সেনাবাহিনীর মধ্যে জেহাদের আগুন ছড়িয়ে দিচ্ছিলেন। তাঁর পরোক্ষ নেতৃত্বেই গোটা ভারতের অভ্যন্তরে মোজাহিদদের আন্দোলনে ৫৭-র বিপ্লব প্রচণ্ডরূপ ধারণ করে।

১৮৫৮ খৃঃ মওলানা এনায়েত আলীর ইন্তেকালের পর সীমান্তে জেহাদরত মোজাহিদদের নেতৃত্ব দেন যথাক্রমে মওলানা আবদুল্লাহ, মওলানা আবদুল করীম (১৯১৫ খৃঃ ফেব্রুয়ারী) ও মওলানা নেয়ামতুল্লাহ। উল্লেখ্য যে, মওলানা আবদুল করীম পর্যন্তই মওলানা এনায়েত আলী ও বেলায়েত আলীর প্রত্যক্ষ ট্রেনিং প্রাপ্ত মোজাহিদদের যুগ ছিল। মওলানা নেয়ামতুল্লাহ ১৯১৫ খৃঃ ফেব্রুয়ারী মাসে আন্দোলনের আমীর বা নেতা নিযুক্ত হন। অনেকের মতে তিনিই ছিলেন মোজাহিদ আন্দোলনের শেষ আমীর। ভারত বিভাগ পর্যন্ত মোজাহিদদের এ আন্দোলন টিকে ছিল। তবে উপমহাদেশ স্বাধীন হবার পর এ আন্দোলনের একদিকের আবশ্যকতা বাকি না থাকলেও আন্দোলনের মূল লক্ষ্য এদেশ ইসলামী হুকুমাত কায়েমের আবশ্যকতা ফুরায়নি বলে তারা দলের মধ্য হতে পরেও একের পর একজনকে আমীর নিযুক্ত করে ইসলামী কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সংকল্পগত পূর্ব ঐতিহ্য বজায় রাখেন। শোনা যায়, এরপর মওলানা রহমতুল্লাহ পর্যায়ক্রমে আমীর নিযুক্ত হন।

বলা বাহুল্য,সীমান্তকে কেন্দ্র করে পরিচালিত আলেমদের এই ইংরেজ বিরোধী আন্দোলন দমনের জন্য বৃটিশ ভারতের শাসকদেরকে বাজেটের এক বিরাট অংশ ব্যয় করতে হতো। মওলানা ইয়াহইয়া আলীর নেতৃত্বাধীনে ভারতের অভ্যন্তরে আন্দোলনের ব্যাপকতা প্রচণ্ডতা কি ছিল, তা বিস্তারিত জাতার জন্য এ আন্দোলনের ঘোর বিরোধী স্যার উইলিয়াম হান্টারের “দি ইন্ডিয়ান মুসলমান” গ্রন্থটি দ্রষ্টব্য। মুসলিম বিদ্বেষী হওয়া সত্ত্বেও হান্টার সাহেবের পক্ষে এসব বাস্তব ঘটনাকে উপেক্ষা করা সম্ভব হয়নি।

১৮৫৭ সালের বিপ্লবের পটভূমি

বালাকোটের সাময়িক ব্যর্থতা নেতৃবৃন্দের শাহাদাত ও পরবর্তী পর্যায়ে মোজাহিদ বাহিনীর উপর ইংরেজদের অকথ্য নির্যাতন সত্ত্বেও এই সংগ্রামী বাহিনীর কর্মীরা নিশ্চুপ বসে থাকেননি। তাঁরা বিভিন্নভাবে উপমহাদেশের মুসলমানদের মধ্যে ইসলামের শিক্ষা-আদর্শ প্রচার ও ইংরেজ বিরোধী ত্রাস সৃষ্টি করে গেছেন। শাহ আবদুল আজীজ কর্তৃক প্রচারিত সেই ‘দারুল হরবের ফতওয়া’ এবং পরবর্তী পর্যায়ে তারই ফলশ্রুতি হিসাবে তাঁর অনুসারীগণ কর্তৃক স্বল্পকালস্থায়ী ‘ইসলামী রাষ্ট্র গঠন’ ও ‘বালাকোটের লড়াই’ এবং উক্ত লড়াইয়ের পর কর্মীদের বিভিন্ন তৎপরতার মাধ্যমে ইংরেজ-বিরোধী ভাব জাগ্রত করা –এই সব কিছুই ঐতিহাসিক ১৮৫৭ সালের বিপ্লবের পটভূমি রচনা করেছে –যার সূচনা করেছিলেন শূকরের চর্বিমিশ্রিত বন্দুকের টোটা ব্যবহার ইত্যাদিকে উলক্ষ্য করে বেরাকটুরের মুসলিম সৈনিকগণ। এ বিপ্লবকে ইংরেজরা সিপাহী বিদ্রোহী বলে আখ্যায়িত করলেও মূলতঃ সেটাই ছিলো হিমালয়ান উপমহাদেশে প্রথম বলিষ্ঠ আজাদী আন্দোলন এবং অবিভক্ত ভারত থেকৈ ইংরেজদের বিতাড়িত করার লক্ষ্যে তাদের প্রতি এক প্রচণ্ড আঘাত।

কিন্তু ভাগ্যের নিমর্ম পরিহাস, এক শ্রেণীর লোকের বিশ্বাসঘাতকতা, আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রের অভাব, অনৈক্য ইত্যাদি কারণে মুসলমানদের এ বিপ্লব ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। এ বিপ্লবের নায়ক ছিলেন একমাত্র মুসলিম আলেম সমাজই, যা কোনো কোনো হিন্দু নেতা ও ইংরেজ লেখক হান্টারও তথ্যাবলী সহকারে লিখে গেছেন।

বিপ্লবে জড়িত শত শত আলেমের মধ্যে বিশিষ্ট কয়েকজন নেতা

মওলানা এনায়েত আলী, মওলানা আহমদুল্লাহ, মওলানা ইয়াহইয়া আলী, মওলানা জাফর থানেশ্বরী, মওলানা সাখাওয়াত আলী, সাইয়েদ আহমদ তাহের, শাহ মাযহার আলী, চট্টগ্রামের সুফী নূর মুহাম্মদ, মোমেনশাহীর শেখ গোলাম আলী, কাজী মুহাম্মদ ইউসুফ, সাইয়েদ মুহাম্মদ ইয়াকুব, শেখ হামদানী, মওলভী ওয়াজুদ্দীন, মওলানা নেজামুদ্দীন দেহলভী, সাইয়েধ নাসের আলী, মিয়া ইহসান উল্লাহ, শেখ মুয়াজ্জেম, হাকীম মুগীসুদ্দীন, মুনাওয়ার খান, সাইয়েদ মুরতজা হোসাইন, মওলানা মুহাম্মদ আলী দেহলভী, মওলানা ফসীত গাজীপুরী, সাইয়েদ আবদুল বাকী, মওলানা আবদুল হাই, মওলানা মুফতি এনায়েত আহমদ, শাহ আহমদ সাঈদ, ঢাকার মওঃ আজীমুদ্দীন, কুমিল্লার মওলানা আশেকুল্লাহ ও বরিশালের মওঃ আমীনুদ্দীন।

মওলানা ইয়াহইয়া আলী, মওলানা জাফর থানেশ্বরী ও মওলানা খায়রাবাদী বিপ্লবের ষড়যন্ত্র মোকদ্দমায় ফাঁসির দণ্ড প্রাপ্ত হন। এ দণ্ডাদেশ শুনে তাঁরা ‘সাক্ষাত জান্নাতে পৌঁছার সুযোগ লাভে’ আনন্দ প্রকাশ করায় ইংরেজ সরকার তাদেরকে সুযোগ থেকে ‘বঞ্চিত’ করার উদ্দেশ্যে আন্দামানে নির্বাসিত করেন।

আলেমদের বিপ্লব উত্তর ভূমিকা

১৮৫৭ সালের বিপ্লব ব্যর্থ হবার পর গোটা উপমহাদেশের মুসলিম জীবনে সবচাইতে ঘোর দুর্দিন নেমে আসে। হিন্দুরা ইতিপূর্বেই বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা প্রাপ্তি ও মুসলিম বিদ্বেষ হেতু ইংরেজদের চাটুকারিতায় লেগে গিয়েছিল। ইংরেজদের আশঙ্কা ছিলো একমাত্র সেই মুসলমানদের পক্ষ থেকেই –যাদের হাত থেকে তারা ক্ষমতা কেড়ে নিয়েছিলো। বিশেষ করে ১৮৫৭ সালের বিপ্লব তাদেরকে মুসলমানদের ব্যাপারে অধিক সতর্ক করে দেয়। তাই মুসলমানদের রাজনৈতিক জীবনের ন্যায় তাদের শিক্ষা, সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনও সংকীর্ণ ও দুর্বিসহ হয়ে ওঠে –যাবতীয় অধিকার থেকে তাদের করা হয় বঞ্চিত। ইংরেজগণ বিপ্লবের জন্যে একমাত্র মুসলমানদেরকেই দায়ী করে তাদেরই ওপর জুলুম-নির্যাতনের চরম স্টিম রোলার চালাতে থাকে। বিপ্লবের নায়ক আলেমগণ ও সাধারণ মুসলমান এজন্যেই ইংরেজদের রোষাণলে পড়ে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলেন, কেউ মাল্টা বা আন্দামান দ্বীপে নির্বাসিত হন, কেউ দীর্ঘকাল যাবত কারা-অন্তরালে আঁধার কক্ষে তিলে তিলে ক্ষয় হন। (১৮৬৩-৬৭ খৃঃ)। বস্তুত এ রোষানল প্রশমিত করার জন্যেই স্যার সাইয়েদ বিদ্রোহের অন্য রকম ব্যাখ্যা দানের চেষ্টা করেন।

এবার আন্দোলন দু’ধারায় চলতে থাকে
স্থানে স্থানে ইসলামী শিক্ষাকেন্দ্র ও গুপ্ত জেহাদী প্রতিষ্ঠান

প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও বালাকোট আন্দোলনে মোজাহিদগণ সংগ্রামের পথ ছেড়ে দেননি। একদিকে তাঁরা সীমান্তে ইয়াগিস্তানে যুদ্ধ অব্যাহত রাখেন, অপর দিকে শাহ ওয়ালিউল্লাহর সুযোগ্য বংশধর ও সাইয়েদ সাহেবের মন্ত্রশিষ্য মওলানা শাহ ইসহাক সাহেবের নেতৃত্বে পূর্ব থেকে ভারতের অভ্যন্তরে ইংরেজদের চক্ষু এড়িয়ে শিক্ষা-সংস্কৃতির চর্চা ও জেহাদের অনুকূলে কাজ চলতে থাকে। তাঁরা সতর্কতার সহিত সে কাজ চালিয়ে যেতেন। মুক্তিযোদ্ধারা স্থানে স্থানে মাদ্রাসা কায়েম ও ধর্মীয় সভাসমিতির মাধ্যমে ইসলামী শিক্ষা-সংস্কৃতি ও মূল্যবোধ টিকিয়ে রাখার কাজ করতেন। এ সঙ্গে খুব সন্তর্পণে জিহাদী প্রচারণা ও ইসলামী জাগরণকে উপমহাদেশে টিকিয়ে রাখার জন্য তাঁরা আপ্রাণ চেষ্টা চালান।

দারুল উলুম দেওবন্দ সহ অগণিত প্রতিষ্ঠাত কায়েম হলো

বস্তুতঃ সে প্রচেষ্টা ও পরিকল্পনার অংশ হিসাবেই আমরা বিশ্ব বিখ্যাত উচ্চ দ্বীনি শিক্ষা কেন্দ্র দারুল উলুম দেওবন্দ বিশ্ব-বিদ্যালয়ের মত প্রতিষ্ঠানসমূহ দেখতে পাই। এগুলোকে কেন্দ্র করে পরবর্তী পর্যায়ে আরও অসংখ্য শিক্ষা ও গুপ্ত জেহাদী প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে এবং উপমহাদেশে ভবিষ্যতের জন্যে ইসলামী পুনর্জাগরণের পথ উন্মুক্ত হয়। উত্তরকালে ‘অসহযোগ আন্দোলন’ ও ‘খেলাফত আন্দোলন’কে উপলক্ষ্য করে মুসলমানদের মধ্যে আযাদী আন্দোলনের যে সাড়া জাগে এবং ১৯৪৭ সালে ইসলামের নামে পাক্সিতান নামক যে রাষ্ট্রটি অর্জিত হয়, এই প্রত্যেকটি কাজেই ঐ সব প্রতিষ্ঠানের অপরিসীম অবদান রয়েছে।

বালাকোট ও পাকিস্তান আন্দোলনের বিচ্ছিন্ন ছিল না

বালাকোট কেন্দ্রিক সংগ্রাম আর ৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলন বিচ্ছিন্ন কোন আন্দোলন ছিল না। বরং শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভীর প্রেরণায় তাঁর সুযোগ্য পুত্র শাহ আবদুল আজীজ দেহলভী, সাইয়েদ আহমদ শহীদ, মওলানা ইসমাইল শহীদ দেহলভী ও মওলানা আবদুল হাই প্রমুখ ইসলাশী আন্দোলনের বীর সিপাহীগণ যেই আপোষহীন সংগ্রাম করেছিলেন, এটা ছিলো সেই আন্দোলনেরই পরিশিষ্ট। এ সব নিবেদিতপ্রাণ ব্যক্তিত্বকে যে সুমহান লক্ষ্য আদর্শ বাস্তবায়নের জন্য অমূল্য জীবন আহুতি দিতে হয়েছিল, উপমহাদেশের মুসলমানগণ কায়েদে আজম মুহাম্মদ আল জিন্নাহ, মওলানা মোহাম্মদ আকরাম খাঁ ও মওলানা শাব্বির আহমদ উসমানীর পাকিস্তান আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহবানের মধ্যে তারই প্রতিধ্বনি শুনতে পেয়েছিল। কায়েদে আজম দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে একাধিকবার ঘোষণা করেছেন যে, “পাকিস্তানের আদর্শ হবে একমাত্র ইসলাম। চৌদ্দশো বছর পূর্বেই আল কুরআন আমাদের শাসনতন্ত্র তৈরী হয়ে আছে”।

দারুল উলুম দেওবন্দ ও আজাদী আন্দোলন

পূর্বেকার আলোচনা থেকে একথা সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাকল্পে শিখ ও ইংরেজ শক্তির বিরুদ্ধে পরিচালিত শহীদানে বালাকোটের আন্দোলনেরই একটি অংশ হিসাবে পাকিস্তান আন্দোলন পরিচালিত হয়। সাথে সাথে একথাও স্পষ্ট হয়ে উঠে যে, মাঝখানে এ আন্দোলন দু’টি স্থানকে কেন্দ্র ককের তার লক্ষ্যে এগিয়ে যায়। একটি ইয়াগিস্তান অপরটি দারুল উলুম দেওবন্দ। অবশ্য দারুল উলুম দেওবন্দের বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থা ও এর অনুসারী পাক-ভারতে কাওমী মাদ্রাসা নামে যে সব অসংখ্য প্রতিষ্ঠান রয়েছে বিশেষ করে বাংলাদেশের দ্বীতি প্রতিষ্ঠান সমূহের শিক্ষা-নীতিতে বালাকোটের সেই আদর্শিক চেতনা ও সে অনুযায়ী সমাজে নেতৃত্ব গড়ে তোলার উপযোগী শিক্ষা কার্যক্রম কি পরিমাণ উপযোগী তা পর্যালোচনার বিষয়। তবে ৪৭-এর আজাদী হাসিলের পর বিগত দিনগুলোতে এই প্রেরণা যে রকম থাকার দরকার ছিল, সে রকম না থাকলেও একথা নিশ্চিতরূপে বলা চলে যে, এখন আবার সেই সংগ্রামী ভাবধারা ঘুমন্ত দ্বীতি মাদ্রাসাগুলোতে জাগ্রত হয়ে উঠেছে। মাঝখানে তা কিছুকাল স্তিমিত থাকায় বাতিল শক্তিসমূহ সে সুযোগ আমাদের সমাজ জীবনের সর্বস্তরে যথেষ্ট শিকড় বিস্তার করে ফেলেছে –সেটা দীর্ঘ আলোচনার বিষয়। কিছুটা অপ্রিয় হলেও প্রসঙ্গটি এ জন্যে টানা হলো যে, বালাকোটের সেই প্রেরণাই যদি সামগ্রিকভাবে এদেশের দ্বীনি প্রতিষ্ঠানসমূহে এতদিন কার্যকর থাকতো আর এ সবের শিক্ষানীতি বাতিলের বিরুদ্ধে বুদ্ধিবৃত্তিক মোকাবেলায় যোগ্য আলেম নেতৃত্ব তৈরীতে সহায়ক হত, তাহলে আজ সমাজচিত্র ভিন্নতর হতো। বরং সব শিক্ষাকেন্দ্র থেকে যে অসংখ্য ওলামা প্রতি বছর বের হয়ে আসেন, তারা এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় উপকরণ থেকে বঞ্চিত। তাদের অনুপস্থিতেই ভোগবাদী ইংরেজ জীবনধারার অনুসারীদের নেতৃত্বের পরিণতি হিসাবে আমাদের সমাজ আজ উল্টো দিকে চলে যাচ্ছে।

যা হোক, দারুল উলুম দেওবন্দ প্রতিষ্ঠার মূল প্রেরণা ও একে কেন্দ্র করে কিভাবে আন্দোলন ধাপে ধাপে অগ্রসর হলো এবং এর সঙ্গে পরে অন্যান্য শক্তি যোগ করে কিভাবে আজাদী সংগ্রামকে শেষ মঞ্জিল পর্যন্ত নিয়ে পৌঁছালো –এ পর্যায়ে আমরা সেই সম্পর্কে কিছুটা বিস্তারিতভাবে আলোচনার প্রয়াস পাবো।

আন্দোলনের কয়েকটি পর্যায়

ইসলামী রেনেসাঁর মূল উদগাতা মহামনীষী ইমাম শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলবী শোষণ-হীন খাঁটি ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য যে ইসলামী আন্দোলনের চিন্তা করেছিলেন, সে আন্দোলনকে কয়েকটি পর্যায়ে ভাগ করা যেতে পারে।

প্রথম পর্যায়ঃ শাহ ওয়ালিউল্লাহর তিরোধানের পর তাঁর সুযোগ্য পুত্র শাহ আবদুল আজিজ দেহলভী থেকে নিয়ে বালাকোট প্রান্তরে সাইয়েদ আহমদ শহীদ ও মওলানা ইসমাইল শহীদের শাহাদাৎ পর্যন্ত (সন ১৮৩১ খৃঃ)। দ্বিতীয় পর্যায়ঃ বালাকোট থেকে নিয়ে ১৮৫৭ সাল পর্যন্ত। তৃতীয় পর্যায়ঃ ১৮৫৭ সাল থেকে ১৮৬৬/৬৭-তে প্রতিষ্ঠিত দারুল উলুম দেওবন্দ কেন্দ্রীক আন্দোলন পর্যন্ত। চতুর্থ পর্যায়ঃ দেওবন্দ থেকে নিয়ে ইংরেজ বিতাড়তের মধ্য দিয়ে আজাদী হাসিল পর্যন্ত। পঞ্চম পর্যায়ঃ হচ্ছে আজাদী হাসিল থেকে বর্তমানের বাংলা-পাক-ভারতে পরিচালিত ইসলামী আন্দোলন। বস্তুতঃ এদেশকে একটি শোষণমুক্ত ইসলামী কল্যাণ রাষ্ট্রে পরিণত করার আন্দোলন শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভীর ইসলামী আন্দোলনেরই লক্ষ্যাভিসারী এক দুর্বিনিত আন্দোলন যা সর্বপ্রথম বালাকোটকে কেন্দ্র করে শুরু হয়েছিল।

উল্লেখ্য যে, বালাকোটে ইসলামী আন্দোলনের সংগ্রামী নেতাদের শাহাদাতের পর শাহ ওয়ালিউল্লাহর সুযোগ্য বংশধর মওলানা শাহ ইসহাক সাহেবের নেতৃত্বে উপমহাদেশে ইসলামী আন্দোলন পরিচালিত হয়। ১৮৫৭ সালের বিপ্লবের পূর্বেই মওলানা শাহ ইসহাক আন্দোলনকে জোরদার করার লক্ষ্যে তাঁর ভ্রাতা মওলানা এয়াকুবকে নিয়ে অন্যান্য মুসলিম রাষ্ট্র সফর করেন। বিশেষ করে তিনি তুরস্কের সঙ্গে যোগাযোগের উদ্দেশ্যে পবিত্র মক্কায় চলে যান। আর এমনিভাবে আন্দোলনের কেন্দ্রস্থল এবার মক্কায় স্থানান্তরিত হয়। -(শাহ ওয়ালীউল্লাহ কী সিয়াসী যিন্দেগী)।

ঐ সময় মক্কা-মদীনা তুর্কী খেলাফতের অধীন ছিল বলে তিনি ভারতীয় মুসলমানদেরকে ইংরেজ কবল থেকে রক্ষা করার জন্য তুরস্ক পররাষ্ট্র দফতরের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করেন। এ দিকে দিল্লীতে ইসলামী আন্দোলনের সাক্ষান নেতৃত্ব দানের উদ্দেশ্যে মওলানা শাহ ইসহাক দিল্লী কলেজের প্রধান শিক্ষক মওলানা মামলুকুল আলীর সভাপতিত্বে মওলানা কুতুবউদ্দীন দেহলভী, মওলানা মুজাফফর হোসাইন কাসুলকী ও মওলানা আবদুল গণী মোজাদ্দেদীর সমন্বয়ে একটি কর্মপরিষধ গঠন করে যান। এই কমিটি মক্কায় অবস্থানরত মওলানা ইসহাকের ইঙ্গিত ও নির্দেশনায় ইসলামী আন্দোলনের কাজ পরিচালনা করতে থাকে। ওয়ালিউল্লাহ আন্দোরনের এই কর্মপরিষদ শাহ ওয়ালীউল্লাহর চিন্তাধারা ও বালাকোটের প্রেরণা নিয়ে দুর্বার গতিতে কাজ করে যায়। বস্তুতঃ শাহ ইসহাক দেহলভীর চিন্তা এবং এই পরিষদের নেতৃবৃন্দের পরিকল্পনা মাফিকই পরবর্তী পর্যায়ে ওয়ালীউল্লাহ চিন্তাধারা প্রচারের বাস্তব কর্মক্ষেত্র হিসাবে ১৮৬৬ খৃষ্টাব্দে দারুল উলুম দেওবন্দ প্রতিষ্ঠিত হয়।

মওলানা ইসহাব দেহলভীল নির্দেশেই পরবর্তী পর্যায়ে মওলানা মামলুকুল আলীর পরিবর্তে হাজী এমদাদুল্লাহ মোহাজেরে মক্কী (রহঃ) উক্ত কর্মপরিষদের প্রধান নেতা নিয়োজিত হন। এ পরিষদের কাজ ছিল শিক্ষামূলক ও মুসলমানদের মাঝে জেহাদী চেতনা সৃষ্টি। হাজী এমদাদুল্লাহ সাহেব প্রধান নেতা হলেও বিশিষ্ট বুযর্গ মওলানা আবদুল গণী মুজাদ্দেদী এ পরিষদের পৃষ্ঠপোষকতায় থাকেন।

রণাঙ্গনে তিন বুযর্গ

শেষ পর্যন্ত আলেমদের ইংরেজ বিরোধী আন্দোলনই বালাকোটে ফেরত অন্যতম মুজাহিদ নেতা মওলানা ইয়াহইয়অ আলীর পরোক্ষ নেতৃত্বে ১৮৫৭ সালে গণঅভ্যত্থানের রূপ নেয়। হাদী এমদাদুল্লাহ তাঁর সহকর্মীদের মধ্যে আন্দোলনের কাজ বন্টন করে দেন এবং নিজেও স্বশরীরে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। তিনি ১৮৫৭ সালের আজাদী বিপ্লবের সময় থানাভবন ফ্রন্টে ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা করেন। -(হায়াতে মাদানী)

থানাভবন ফ্রন্টে তাঁর সঙ্গে যেসব মর্দে মুসলমান ও সংগ্রামী আলেম জেহাদের ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন, তাঁদের সংখ্যা ছিল হাজার হাজার। তন্মধ্যে হাজী এমদাদুল্লাহর সহকর্মী শিষ্য হযরত মওলানা কাসেম নানুতবী, হযরত মওলানা রশীদ আহমদ গংগোহী প্রমুখ আলেমের থানাভবনে এসে সমবেত হয়। এখানে তারা জেহাদে একের পর এক স্থান দখল করে সম্মুখে অগ্রসর হতে থাকেন। তাঁরা থানাভবন ও এর পার্শ্ববর্তী এলাকাসমূহ থেকে ইংরেজসৈনিকদের বিতাড়িত করে মুক্ত অঞ্চল কায়েম করেন। তারপর জিলা ছাহারান পুরের অভ্যন্তরে ইংরেজদের প্রধান ঘাঁটি অধিকার করতে সমর্থ হন। কিন্তু বালাকোটের ন্যায় এবারও এই ইসলামী আন্দোলন বিশ্বাসঘাতকদের ষড়যন্ত্রের শিকারে পরিণত হয়ে তাদের পরাজয়ের গ্লানি বহন করতে হয়। এখানকার জেহাদে হাজী এমদাদুল্লাহ ছিলে ‘আমীরে মোজাহেদীন’ বা মুজাহিদদের প্রদান উপদেষ্টা। হযরত মওলানা কাসেম নানতুবী ছিলেন প্রধান সেনাপতি এবং হযরত মওলানা রশিদ আহমদ গংগোহী প্রধান বিচারক। তাঁরা যে দক্ষতা ও রণ-কৌশলসহকারে এই জেহাদ পরিচালনা করেছিলেন, সেই সংগ্রামী স্মৃতি আমাদের জন্য চিরদিন প্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে।

ফাঁসিকাষ্ঠে ২৮ হাজার মুসলমান ও সাত শহ আলেমের শাহাদাত বরণ

জেহাদে মুসলমানরা পরাজিত হলো। উপমহাদেশের মুসলমান পূর্বাপেক্ষা অধিকতর শক্তভাবে বাঁধা পড়লো ইংরেজদের দাসত্বের জিঞ্জিরে। থানাভবনের এলাকাকে ধ্বংসযজ্ঞে পরিণত করা হলো্। বিচারের কোনরূপ অপেক্ষা না করে ভারতের অন্যান্য এলাকার মতো এখানেও প্রকাশ্য রাস্তায় নির্মমভাবে মুসলমানদের ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলানো হলো। উচ্চপদস্থ ইংরেজ অফিসারদের রিপোর্ট অনুযায়ী দেখা যায়, এই সেক্টরে ২৭/২৮ হাজার মুসলমানকে বিনা বিচারে ফাঁসি দেয়া হয়েছে এবং প্রায় সাতশো বিশিষ্ট আলেমকে ফাঁসিকাষ্ঠে শাহাদাত বরণ করতে হয়েছে। এছাড়া বহু ওলামা ও বুযর্গানে দ্বীন আন্দামান প্রভৃতি দ্বীপে নির্বাসিত হয়েছেন। তাঁরা দেশবাসী ও আত্মীয় পরিজন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নিদারুন দুঃখ-কষ্টের মধ্য দিয়ে তিলে তিলে নিঃশেষ হয়েছেন। মওলানা ফজলে হক খায়রাবাদী, মওলানা মুফতী এনায়েত আলী এবং শাহ আহমদ সাঈদ ১৮৫৭ সালের ‘বিপ্লব ষড়যন্ত্র মামলায়’ দণ্ডিত হন। প্রথম দু’জন মুজাহিদকে উক্ত ষড়যন্ত্র মামলায় দোষী সাব্যস্থ করে ১৮৬৩ খৃষ্টাব্দে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করে আন্দমানে প্রেরণ করা হয়। সেখানে তাঁরা জীবনের শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। -(হায়াতে মাদানী)

বলা বাহুল্য, শুধু থানাভবন এলাকায় যেই বিপুল সংখ্যক মুসলমান ও আলেম শহীদ হয়েছেন, সে হিসাবে গোটা ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে কি পরিমাণ মুসলমান ও আলেম ওলামাকে শহীদ করা হয়েছে, তা সহজেই অনুমেয়। (এক পরিসংখ্যান মোতাবেক আজাদী হাসিল পর্যন্ত ২০ লক্ষ্য মুসলমান এই মুক্তি সংগ্রামে দুশমনদের হাতে শাহাদাত বরণ করেন)।

এ জেহাদে থানাভবন ফ্রন্টে মওলানা কাসেম নানতুবীর মস্তকে গুলির আঘাত লেগেছিল কিন্তু তা মারাত্মক ছিল না বলে কোনপ্রকার তিনি রক্ষা পেয়ে যান। মওলানা রশীদ আহমদ গংগোহী এই মুক্তি সংগ্রামের সাথে জড়িত থাকার অপরাধে ছয় মাস কারাগারে অন্তরীণাবদ্ধ ছিলেন। হযরত মওলানা কাসেম নানতুবী এবং হাজী এমদাদুল্লাহর বিরুদ্ধেও গ্রেফতার পরওয়ানা জারি হয়েছিল। মওলানা নানতুবী বন্ধুবান্ধবদের পরামর্শে এবং ইসলামী আন্দোলনের স্বার্থে প্রথম তিন দিন আত্মগোপন করে থাকলেও পরে তিনি দিব্বি রাস্তা-ঘাটে ঘোরাফেরা করতে থাকেন। কেউ তাঁকে সতর্ক করতে গেলে তিনি উক্তি করতেন যে, প্রিয় নবী ‘হিরা’ গুহার মধ্যে কাফেরদের নিকট থেকে মাত্র তিনদিন আত্মগোপন করে ছিলেন, কাজেই আমি তার বেশী করতে রাজি নই। তাতে যে কোন পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে হোকনা কেন আমি হাসিমুখে তা বরণ করে নেবো। আল্লাহর মর্জি, তিনদিন পরেই তাঁর উপর থেকে গ্রেফতারী ওয়ারেন্ট তুলে নেয়া হয়।

১৮৫৭ সালের ইংরেজ বিরোধী গনজেহাদের মূলে ছিল ইসলাশী চেতনা। আর তার অন্যতম নায়ক ছিলেন উক্ত তিন বুজর্গ। কিন্তু আল্লাহর অসীম মেহেরবানীতের এবং উপমহাদেশে ইসলামী শিক্ষা ও আদর্শকে উজ্জীবিত রাখার স্বার্থে কিভাবে তাঁরা বেঁচে গেলেন, তা সত্যই এক বিস্ময়কর ঘটনা।

লেখক: জুলফিকার আহমদ কিসমতি

Check Also

আশাশুনিতে যথাযোগ্য মর্যাদায় মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস পালিত

এস, এম মোস্তাফিজুর রহমান ॥ আশাশুনিতে মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস’২৪ যথাযোগ্য মর্যাদায় পালিত হয়েছে। …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।