সমুদ্রের পানিতে তলিয়ে আছে সাতক্ষীরার উপকূলীয় অঞ্চল: টেকশই বেড়িবাঁধের অভাবে পানির উপরে ভাসছে হাজারো মানুষ

সমুদ্রের পানিতে তলিয়ে আছে সাতক্ষীরার উপকূলীয় অঞ্চল
টেকশই বেড়িবাঁধের অভাবে পানির উপরে ভাসছে হাজারো মানুষ

মাওলানা আজিজুর রহমান: কালিগঞ্জে আমার বসবাস। কিন্তু ঘূর্ণিঝড়‘আম্পানের’ ক্ষতিগ্রস্থদের সহযোগীতা ও সহামর্মিতা জানাতে সাতক্ষীরা জেলার আশাশুনির গিয়েছিলাম ২৫ মে ঈদের দিন। সেই থেকে কয়েক দফায় আমি সেখানে গিয়ে ছিলাম । ঘূর্ণিঝড় আম্পানে সেখানে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির খবর স্বচক্ষে দেখার সুযোগ হলো। বর্ণনাহীন দৃশ্য ও কল্পনাহীন ক্ষয় ক্ষতি নিজ চোখে না দেখলে বিশ্বাই হতো না। জীবনে যে মানুষ গুলো ঘর থেকে বের হয়নি তারা আজ রাস্তার দুধারে। কেঁদে কেঁদে যেন ওদের চোখ রক্তজবা হয়ে গেছে। বাধনির্মানে আশ্বাসের পর আশ্বাস। কিন্তু এখনো মেলেনি কোন বিশ্বাস। অনিশ্চয়তার ফলে সেখানকার লক্ষাধীক মানুষ ক্ষতিগ্রস্থ ।

২৫ মে আমাশুনি উপজেলার প্রতাপনগরে আম্পানের তান্ডব যেন আমার দুনয়ন কাদিয়ে তোলে। নিজেকে স্বান্তনা দেয়ার ভাষাও যেন হারিয়ে ফেলি। এরপও সাহস নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাই। যে দিকে তাকাই শুধু পানি আর পানি। পানির মধ্যে আবছা আবছা দেখা যাচ্ছে আমাদের প্রিয়জনদের সেই আসাবস্থল।
একটা দোকানের সামনে থেকে নৌকা ভাড়া করে প্রতাপনগর,কুড়িকাহনিয়া,সুভদ্রাকাটি ,চাকলাসহ কয়েকটা গ্রাম ঘুরে দেখলাম। সেখানে যত দূর চোখ যায়, শুধু পানি আর পানি। আমাদের নৌকা যে পথ দিয়ে যাচ্ছিল, সেটা কোনো নদী-খালেরমত মানুষের উঠান, রাস্তাঘাট, সবজিবাগান, ধানখেত কিংবা চিংড়ির ঘেরের উপর দিয়ে যাচ্ছিল। সব এখন পানির নিচে। কোথাও একটা পরিবারও দেখা গেল না, যাদের ঘরে পানি ওঠেনি। প্রায় প্রতিটা ঘরের অর্ধেক পানির নিচে। কোনো কোনো ঘরের চালা অব্দি পানি। যে ঘরটি মাটি দিয়ে তৈরি, সেটি ভেঙে পানির সঙ্গে মিশে গেছে। দুমড়েমুচড়ে পড়ে আছে বাকি ঘরগুলো! টয়লেট পানিতে ভাসছে। টিউবওয়েল, পানি বিশুদ্ধ করার যন্ত্র, খাওয়ার পানির পাত্রসহ যা ঘরে ছিল, সব পানির নিচে তলিয়ে গেছে। থই থই পানির মধ্যেও চারদিকে খাওয়ার পানির তীব্র সংকট। মনে হল পানিবাহিত রোগ ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে। মুষ্টিমেয় কিছু পরিবার গরু-ছাগল ও অন্যান্য গবাদিপশু সরিয়ে নিতে পেরেছিল। বাকি অনেকের প্রাণী মরে ভেসে আছে।

সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসনের হিসাবে , আম্ফানে সাতক্ষীরা জেলায় দুইজন নিহত ও ১৬ জন আহত হয়েছে। ঝড়ে ২২ হাজার ৫১৫টি ঘরবাড়ি সম্পূর্ণ ও ৬০ হাজার ৯১৬টি ঘরবাড়ি আংশিক ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। প্রবল এই ঝড়ে সাতক্ষীরা উপকূলের নদ-নদীর অন্তত শতাধীক পয়েন্টে ভেঙে গ্রামের পর গ্রাম প্লবিত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে ৫৭ কিলোমিটার বেড়িবাধ ও এলজিইডির ৮১ কিলোমিটার রাস্তা। ঝড়ে সাতক্ষীরায় ৬৫ কোটি ১৮ লক্ষ টাকা ৪০ হাজার টাকার আমসহ ১৩৭ কোটি ৬১ লাখ ৩০ হাজার টাকার কৃষি সম্পদ ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। এর মধ্যে ৬২ কোটি ১৬ লাখ টাকার সবজি, ১০ কোটি ২২ লাখ ৪০ হাজার টাকার পান ও সাড়ে ৪ লাখ টাকার তিল ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্থ কৃষকের সংখ্যা ১ লাখ ৫ হাজার ৮৭০। ঝড়ে ৯১টি খামার ও ৬৪০টি গবাদি পশুসহ ১৭ লাখ ৭১ হাজার ৫৩০ টাকার গবাদি পশু এবং ৮৬টি হাস মুরগির খামারসহ ৭৭ লাখ টাকা ৬৭ হাজার ৮৬ টাকার হাসমুরগির ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ভেসে গেছে সাড়ে ১২ হাজার মৎস্য (চিংড়িসহ) ঘের। যার ক্ষতির পরিমান ১৭৬ কোটি ৩ লাখ টাকা টাকা।

ঘুর্নিঝড় আম্পানে আশাশুনি উপজেলার প্রতাপনগর ও শ্রীউলা ইউনিয়ন সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়। এই দুই ইউনিয়নের পানি উন্নয়ন বোর্ডের খোলপেটুয়া ও কপোতাক্ষ নদের বেড়িবাঁধের ১৯টি স্থান ভেঙে ৬০ হাজারের বেশি মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। ভেসে গেছে ২০ হাজার চিংড়িঘের ও পুকুর। নদীর জোয়ার ভাটার তালে চলছে তাদের জীবন। প্রতাপনগর ইউনিয়ন পরিষদের তথ্য মতে ইউনিয়নের লোকসংখ্যা ৩৫ হাজার ৭৫৫ জন। ইউনিয়নটি পানি উন্নয়ন বোর্ডের ৪০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ দিয়ে ঘেরা। আম্পানের আঘাতে কুড়িকাউনিয়া, চাকলা ,হরিশখালি কোলূসহ ১৩টি স্থান ভেঙে নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। এসব স্থান দিয়ে নদীর লোনা পানি ঢুকে ইউনিয়নের চাকলা, রুইয়ের বিল, সুভদ্রকাটি, শ্রীপুর, কুড়িকাউনিয়া, প্রতাপনগর, মাদারবাড়ি, কল্যাণপুর, সনাতনকাটি, হিজলেকোলা, হরিশখালিসহ ১৭টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে।

চাকলা গ্রামের ৮০ বছরের বৃদ্ধ আকবর আলী আমাকে জানিয়েছে, আমাদের বাড়ি ঘর সব পানির তলে। সারাদিন বাধ মেরামত করি রাতে আবার তা ভেঙ্গে যায়। প্রতি দিন কি এভাবে বাধ মেরামত করা যায়? বাড়িতেও আমাগো খাবার নেই। কাজ নেই। কি করবো,চলতেও পারিনা। কানে শুনতেও পারি না। একবেলা করে খেয়ে পরে আছি। কি করবো
এসময় আমার সাথে ছিলেন,নূরুল আফসার,আবু ইসলাম,আব্দুল গফুর,এড.শহিদুল ইসলাম,মাওলানা আনারুল, শাহিনসহ অনেকে। তারও এসব প্রত্যক্ষ করেন।
উন্নয়ন সংস্থা ও এনজিওর সহায়তায় অনেক পরিবার ছাগল, ভেড়া, হাঁস-মুরগি লালন-পালনের সুযোগ পেয়েছিল। কেউ ছোটখাটো ব্যবসা, কেউবা সবজিখেত, মুদিদোকান ইত্যাদি শুরু করেছিলেন। আর কিছুদিন পর তাঁরা অতিদরিদ্র থেকে উঠে আসতে পারতেন। আমার মনে হচ্ছে কারোরই মূলধন অবশিষ্ট নেই। আবার কয়েক দশকের জন্য এই মানুষগুলো দারিদ্র্যের মধ্যে ঢুকে গেলেন!

ঘূর্ণিঝড় আম্পানে বেড়িবাঁধের বেশির ভাগ অংশ ভেঙে পানি ঢুকে তলিয়ে গেছে পুরো এলাকা। সেখানে এখন জোয়ারের পানি ওঠে আর নামে।
২০০৯ সালে ঘূর্ণিঝড় ‘আইলা’ এই এলাকার প্রায় সব শেষ করে দিয়েছিল। তার আগে ২০০৭ সালের ঘূর্ণিঝড় ‘সিডর’। দুটো ঝড়েই বেড়িবাঁধের বড় একটা অংশ ধসে সমুদ্রের লোনাপানিতে সয়লাব হয়ে গিয়েছিল গোটা এলাকা। গত ১০ বছরে এ মানুষগুলো একটু ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছিলেন। ধীরে ধীরে সবুজ হয়ে উঠছিল প্রতাপনগরসহ আশাশুনি উপকূলীয় অঞ্চল। আম্পান তাঁদের সব কেড়ে নিল। ২০০৯ সালের আইলায় যে লোনাপানি ঢুকেছিল, সেই পানি ঢোকার মধ্য দিয়ে এই এলাকার জীবিকা কৃষিনির্ভর থেকে চিংড়ি চাষের দিকে ঝুঁকে যায়। ফলে দরিদ্র হয়ে পড়ে আরও দরিদ্র গত ১০ বছরে মানুষ একটু একটু করে আবার ঘুরে দাঁড়াচ্ছিলেন। জমিতে আবার ঘের. ধান, মাছ ও সবজি চাষ হচ্ছিল! লবণ শুষে নিয়ে আবার কৃষির দিকে মুখ ফেরাচ্ছিলেন মহান আল্লাহ। এবার ছিল বাম্পার ফলন। কিন্তু আম্পানে সব শেষ। নিঃস্ব হয়ে গেল শতশত পরিবার।

স্থানীয় মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, আম্পানে প্রতাপনগর বেড়িবাঁধ অন্তত ৯ স্থানে ভেঙ্গেছে। এর মধ্যে স্থানীয়রা স্বেচ্ছা শ্রমের ভিত্তিতে ৪টি পয়েন্টে বেড়িবাঁধ মেরামত করতে সক্ষম হয়। বাকি ৪টি পয়েন্ট দিয়ে পানি প্রবেশ করতে থাকে। কিন্তু গতকাল পর্যন্ত স্থানীয়দের স্বেচ্ছা শ্রমের ভিত্তিতে মেরামতকৃত বাঁধ জোয়ারের পানিতে ভেসে যায়। ফলে গোটা ইউনিয়নের ১৯টি গ্রাম নতুন করে সমুদ্রের পানিতে প্লাবিত হচ্ছে।

বলা দরকার যে এ এলাকার বাঁধগুলো ৬০ বছরের পুরোনো। ২০ বছর আগেই এগুলোর মেয়াদ পেরিয়েছে। পাকিস্তান আমলে সেচের স্বার্থে এগুলো তৈরি হয়েছিল। পরে শুধু সংস্কার ও লম্বালম্বিভাবে বাঁধগুলোর আয়তন বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু তার সবটাই অবৈজ্ঞানিকভাবে এবং বাঁধের সামনে বনাঞ্চল সৃষ্টি না করেই। বাঁধের সামনে বনের পাহারা না থাকলে তা সহজেই ঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে ভেঙে যায়। এর আগের সব ঝড়ে তা দেখা গেছে।
জলবায়ু পরিবর্তনে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি যানবাহন চলাচল, বাঁধ কেটে চিংড়ির ঘেরে লোনাপানি ঢোকানো এবং সার্বিক রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে এ ভাঙন ত্বরান্বিত হয়েছে। তাঁরা স্বেচ্ছাশ্রমের মাধ্যমে কাজটা শুরুও করেছিলেন। হাতে হাত ধরে মাটির ঢেলা দিয়ে বাঁধ মেরামতের চেষ্টা করেন তাঁরা! এক ফোঁটা কম পানি ঢোকা মানে তাঁদের জন্য আনন্দের। মাইলের পর মাইল নৌকায় ঘুরে একচিলতে খালি জায়গাও দেখা যায়নি। নৌকার মাঝিকে জিজ্ঞেস করতে তিনি বললেন, ‘স্যার, উপকূলের মাইনষ্যের কোনো দল নাই! তাগো কেউ নাই, স্যার!’

দুর্গত মানুষদের জন্য জরুরি ভিত্তিতে সহায়তা দরকার। এর জন্য প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদি পুনর্গঠন কর্মসূচি, যাতে জনগণ এ পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারে। বিকল্প জীবিকার জন্য উদ্যোগ নিতে হবে। আর বিচ্ছিন্নভাবে যত উদ্যোগই নেওয়া হোক, যদি সরকারি ভাবে বেড়িবাঁধগুলো নির্মাণ ও সুরক্ষার ব্যবস্থা না করা হয়, বেড়িবাঁধ নির্মাণে সুশাসন প্রতিষ্ঠা না করা যায়, তাহলে কোনো উদ্যোগই টেকসই হবে না। উপকূলবাসীর দুঃখও ঘুচবে না। এখন সময়ের দাবী টেকশই বেড়িবাঁধের পাশাপাশি সূপেয় পানি,খাদ্য সরবরাহ ও পূর্ণবাসন।

সর্বপরি এ দুযোর্গ থেকে মুক্তি পেতে মহান আল্লাহর রহমত কামন করি। এবং আমাদেও সকলের উচিৎ মহান প্রভূর দিকে ফের আসা।
লেখক: আজিজুর রহমান: কালিগঞ্জ: সাতক্ষীরা:

 

Please follow and like us:

Check Also

ইমাম ও মুয়াজ্জিন কল্যাণ ট্রাস্টের আওতায় সুদমুক্ত ঋণ বিতরণ

রাকিবুল ইসলাম, আলিপুর,২৩শে এপ্রিল ২০২৪:সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসন ও ইসলামিক ফাউন্ডেশন সাতক্ষীরার আয়োজনে ইমাম ও মুয়াজ্জিন …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।