জ্বের খুতবায় মহামারি করোনা মুক্তি ও বিশ্ব শান্তি কামনা

স্টাফ রিপোর্টার: পবিত্র হজ্বের খুতবায় মুসলিম উম্মাহর শান্তি, ঐক্য ও সমৃদ্ধির ওপর জোর দিয়েছেন খতিব। সেই সাথে বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারি থেকে মুক্তি কামনা করা হয়েছে মহান আল্লাহ তায়ালার দরবারে। দীর্ঘ খুতবায় তিনি সঠিক ইসলামের পথে মুসলিমদের ফিরে আসার আহ্বান জানিয়েছেন। মুসলিম উম্মাহর ঐক্য ও সমৃদ্ধি কামনা করে দোয়াও করেছেন। কুরআন ও হাদিসের বিভিন্ন উদ্ধৃতি উল্লেখ করে মুসলিম উম্মাহকে তাকওয়া অবলম্বনের আহ্বান জানানো হয়। কুরআন-সুন্নাহর নির্দেশনা মতো জীবন গঠনের প্রতি তাগিদ দেয়া হয়। পবিত্র গ্রন্থ আল কুরআনকে জীবনের পাথেয় বানাতে বলেন খতিব।

জাবালে রহমতের পাদদেশে ঐতিহাসিক আরাফাতের ময়দানে অবস্থিত মসজিদে নামিরা থেকে হজ্বের খুতবা দেন নতুন খতিব শায়খ ড. আব্দুল্লাহ ইবনে সুলাইমান আল-মানিয়া।

গতকাল বৃহস্পতিবার (৩০ জুলাই, ৯ জিলহজ্ব) স্থানীয় সময় দুপুর ১২টা ২৮ মিনিটে সালাম দিয়ে হজ্বের খুতবা শুরু করেন তিনি। খুতবার শুরুতে আল্লাহ তাআলার প্রশংসা ও রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওপর দরুদ পাঠ করেন।

আরাফাতের ময়দানে হাজিদের উদ্দেশে দেয়া খুতবায় তিনি প্রাণঘাতী বৈশ্বিক মহামারি করোনা থেকে মুক্তি, গোনাহ মাফ, আল্লাহর রহমত কামনাসহ সমসাময়িক প্রসঙ্গ নিয়ে বিশ্ববাসীর প্রতি নানা নির্দেশনামূলক বক্তব্য তুলে ধরেন।

গত ২৮ জুলাই খাদেমুল হারামাইন শরিফাইন সৌদি আরবের বাদশাহ সালমান বিন আবদুল আজিজ এক রাজকীয় ফরমানে ড. আব্দুল্লাহ ইবনে সুলাইমান আল-মানিয়াকে নিয়োগ দিয়েছেন। তিনি হলেন সবচেয়ে বেশি বয়স্ক হজ্বের খতিব।

মুসলিম উম্মাহর মুক্তির উপায় উল্লেখ করে ড. আব্দুল্লাহ ইবনে সুলাইমান আল মানিয়া হজ্বে¡র খুতবায় বলেন, পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালার রহমতের কথা বারবার বলা হয়েছে। আল্লাহর রজ্জু দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরাই মুক্তির একমাত্র উপায়। এ ছাড়া অন্য কোনো পথ নেই।

উল্লেখ্য, প্রতি বছর প্রায় বিশ লাখ হজযাত্রী পবিত্র হজ পালন করতেন। কিন্তু মহামারি করোনার কারণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে লাখ লাখ হজযাত্রী পবিত্র হজ পালনের সুযোগ পাননি। তবু মাত্র দশ হাজারের মতো হজযাত্রীর সমবেত কন্ঠে “লাব্বাইক” ধ্বনিতে মুখরিত হয়ে উঠে আরাফা ময়দান। বিঘোষিত হয় মহান আল্লাহর একত্ব ও মহত্ত্বের কথা। ।

 

১৯৮১ সাল থেকে আরাফার ময়দানের খতিবের দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন দৃষ্টিহীন ইমাম শাইখ আবদুল আজিজ। দীর্ঘ ৩৫ বছর পর তিনি বার্ধক্যজনিত কারণে অবসরে গিয়েছেন। ২০১৬ সালে প্রথমবারের মতো হজ্বের খুতবা দেন শাইখ আবদুর রহমান আস-সুদাইস। ২০১৮ সালে আরাফার ময়দানে হজ্বের খুতবা দেন বিচারপতি শাইখ হুসাইন ইবনে আবদুল আজিজ ইবনে হাসান।

এবারের হজ্বের খুতবায় হারামাইন শরিফাইনের মর্যাদা ও সম্মান রক্ষার আহ্বান জানিয়ে খতিব সৌদি রাজপরিবারের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন। সৌদি বাদশা সালমান বিন আবদুল আজিজসহ রাজপরিবারের সদস্যদের জন্য দোয়া করেছেন। খুতবায় মুহাম্মদ বিন সালমানের কথাও উল্লেখ করেন। তার দীর্ঘ হায়াত ও কল্যাণের জন্যও দোয়া করা হয়।

খুতবার শুরুতে তিনি আল্লাহতায়ালার প্রশংসা, রাসূলুল্লাহর (সা.) ওপর দরুদ পাঠ করেন। উপস্থিত হাজীদের সুস্থতা কামনা করেন। তাদের জন্য দোয়া করেন। খুতবায় রাসূলের (সা.) একটি হাদিস পড়েন, যার মূলকথা হলো- কোনো মুসলমানের যদি সক্ষমতা অর্জন হয়, তাহলে জীবনে একবার হলেও তাকে অবশ্যই হজ্ব করতে হবে।

খুতবায় বলা হয়, তাওহিদ ও খতমে নবুওয়তের সাক্ষী ইসলামের মৌলিক রোকন। এছাড়াও নামায ও জাকাত ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ বিধান। জাকাতের মাধ্যমে গরিব অসহায়দের ব্যাপক কল্যাণ সাধিত হয়।

হজ্বের খুতবায় আরও বলা হয়, আল্লাহ তায়ালার হুকুম কখনও পরিবর্তন হয় না। আল্লাহ তায়ালা মানুষ এবং জীন জাতিকে তার ইবাদতের জন্য সৃষ্টি করেছেন। এ জন্য তাওহিদ ও আল্লাহর একত্ববাদের বিষয়টি আমাদের গুরুত্ব দিতে হবে।

হজ্বের খুতবায় মুসলমানদের আমল পরিশুদ্ধ করার প্রতি বিশেষ জোর দেয়া হয়। পারস্পরিক আচরণ, লেনদেন পরিশুদ্ধ করার তাগিদ দেয়া হয়। আমলের ত্রুটির কারণে মুসলিমরা দুর্যোগের শিকার হবে এমন সতর্কতাও দেয়া হয়।

কুরআন ও হাদিসের বিভিন্ন উদ্ধৃতি উল্লেখ করে মুসলিম উম্মাহকে তাকওয়া অবলম্বনের আহ্বান জানানো হয়। কুরআন-সুন্নাহর নির্দেশনা মতো জীবন গঠনের প্রতি তাগিদ দেয়া হয়। পবিত্র গ্রন্থ আল কুরআনকে জীবনের পাথেয় বানাতে বলেন খতিব।

সৃষ্টির প্রতি দয়া ও সহনশীল হওয়ার আহ্বান জানানো হয়। সৃষ্টির প্রতি দয়ার্দ্র হলে আল্লাহ তার প্রতি দয়াশীল হবে বলে হাদিসের বাণী উদ্ধৃত করেন। ধৈর্য ধারণের কথা বলা হয়। এক মুমিন আরেক মুমিনের প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়ার তাগিদ দিয়ে বলা হয়, এর দ্বারা আল্লাহর রহমত অর্জিত হবে।

তিনি বলেন, রসুলগণ মানুষকে সত্যপথ দেখিয়েছেন এবং আল্লাহর একত্মবাদের কথা বলেছেন। তিনি বলেন, আল্লাহই সব কিছুর স্রষ্টা। তিনি বলেন, মহানবী (সঃ) যা বলেছেন তা আল্লাহর পক্ষ থেকে বলেছেন। তিনি মহানবীর (সঃ) সাহাবিদের মতো ঈমান আনয়নসহ মানুষকে আল্লহর প্রতি, নবী-রসুলদের প্রতি, কিতাবসমূহের প্রতি, ফেরেস্তাদের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করতে বলেন। নামায ও যাকাত আদায় রোজা ও হজ্ব পালনের কথা বলেন। কবুল হজ্বের প্রতিদান জান্নাত বলে উল্লেখ করেন তিনি। এছাড়া দশম হিজ্বরিতে নহানবী (সঃ) হজ্ব পালন করেন, শরিয়ত মতো চলা, সুদ থেকে বিরত থাকা, আল্লাহর নেয়ামত স্মরণ করার কথাও বলেন।

খুতবায় ইমাম বলেন, রসুল ছিলেন উত্তম চরিত্রের অধিকারী। তিনি মোমেন ও কাফেরদের পার্থক্যের কথা, কুরআন যে গোটা বিশ্বের জন্য রহমত সে কথা, ন্যায় বিচার, উত্তম চরিত্রের কথা, মহানবী(সঃ) যে পিতা-মাতার সাথে ভালো ব্যবহার করতেন সে কথা বলেন। তিনি শিরক না করা ও না জেনে কথা না বলার জন্য বলেন। পরস্পরের মধ্যে সুন্দর সম্পর্ক বজায় রাখা ও দরদী হবার জন্য তাগিদ দেন তিনি।

তিনি বলেন, মহানবী (সঃ) আল্লাহর পক্ষ থেকে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করেছেন। খুতবায় তিনি অন্যের মালামাল হেফাজত ও সীমা লক্ষঘন না করার জন্য বলেন। জুলম, অন্যের সম্পদ গ্রাস, প্রতিশ্রতি রক্ষা আল্লাহর আনুগত্য, শৃংখলা বিধান, সন্ত্রাসী কাজ থেকে বিরত থাকতে বলেন। নারী ও পুরুষদের অধিকার নিশ্চিত করা ও এ বিষয়ে শরিয়তের কঠিন তাগিদের উল্লেখ করেন।

তিনি বলেন, কাবা মানুষের জন্য শান্তি ও নিরাপদ, মক্কা ও মদিনার বিরুদ্ধবাদীদের আল্লাহ শাস্তি দিবেন এবং তা রক্ষা করার দায়িত্ব স্বয়ং আল্লাহ পাকের। মসজিদুর আকসার দায়িত্ব আবারও মুসলমানদের হবে। তিনি আরাফার দিবসের গুরুত্বেও কথা বলেন। এ দিন সবচেয়ে বেশী মানুষকে আল্লাহপাক ক্ষমা করবেন বলে উল্লেখ করেন।

খুতবার শেষ দিকে হজ্বের আহকাম জানিয়ে দেন খতিব। মুসলমানদের ঐক্য ও সমৃদ্ধি কামনা করে বিশেষ মোনাজাত করেন।

খুতবা সৌদি আরবের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন ও বিশ্বের বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি টেলিভিশন সরাসরি সম্প্রচার করছে। অনেক হজ্ব এজেন্সি নিজ উদ্যোগে আরাফার ময়দানে উপস্থিত হাজীদেরকে খুতবার অনুবাদ শোনানোর ব্যবস্থা নিয়েছেন।

আরাফার ময়দানে উপস্থিত সফেদ-শুভ্র কাপড়ের ইহরাম পরিহিত হাজীদের সামনে দেওয়া হজ্বের খুতবা বিশ্ব পরিস্থিতির কারণে বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। এ খুতবা যেমন সমবেত হাজীরা শোনেন, তেমনি শোনেন বিশ্ববাসী।

খুতবার মধ্য দিয়ে শেষ হলো হজ্বের মূল আনুষ্ঠানিকতা। খুতবার পরপরই মসজিদে নামিরায় এক আজানে জোহর এবং আসরের নামাজ অনুষ্ঠিত হয়। সূর্যাস্ত পর্যন্ত হাজিরা আরাফাতের ময়দানে অবস্থান করেন। সূর্যাস্তের পর তারা মাগরিবের নামাজ না পড়ে রওয়ানা করেন মুজদালিফার উদ্দেশে। সেখানে একসঙ্গে মাগরিব ও ইশার নামাজ আদায় করে রাত যাপন করবেন।

আজ ফজরের পর হাজিরা রওয়ানা করবেন মিনার উদ্দেশ্যে। সেখানে তারা আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে পশু কুরবানি করবেন। শয়তানকে পাথর মারবেন। এছাড়া বায়তুল্লায় গিয়ে তওয়াফ করবেন।

Check Also

মালয়েশিয়ার পাম তেলে ইইউ’র নিষেধাজ্ঞা বাংলাদেশের শ্রমবাজারে অশনি সংকেত

বন উজাড়, কার্বন নির্গমনের ঝুঁকি এবং পরিবেশের ভারসাম্য নষ্টগত কারণ দেখিয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ মালয়েশিয়ার …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।