সিনহার হত্যার দিন রাতে কি হয়ে ছিল

ক্রাইমবার্তা রিপোট :  স্থানীয় বায়তুল নূর জামে মসজিদ থেকে এশার নামাজ পড়ে বাড়ি ফিরছিলাম। তখনই পথে গুলির শব্দ কানে এলো। হঠাৎ করেই চারটি গুলির আওয়াজ শুনতে পেলাম। ঘটনাস্থল থেকে ১৫ হাতের মতো দূরে দাঁড়িয়ে ছিলাম আমি। যেখানে ঘটনাস্থল তার বাঁ দিকে ঘুরলেই আমাদের বাড়ির পথ। গুলির শব্দে হঠাৎ থমকে যাই। একটু পরই দেখি এক ব্যক্তি গুলিবিদ্ধ অবস্থায় মাটিতে লুটিয়ে আছেন। জীবনে চোখের সামনে এমন দৃশ্য দেখিনি। গুলির পরপরই ওপরের বাজার থেকে অনেকে ঘটনাস্থলের দিকে আসতে শুরু করে। আর সেখানকার পুলিশ সদস্যরা সেভাবে কাউকে ঘটনাস্থলে আসতে বাধা দেননি। তারা বলছিলেন- ‘সবাই আসেন, দেখেন; ডাকাত মাইর‌্যা ফেলাইছি।’ চোখের সামনেই ৩১ জুলাই রাতে কক্সবাজারের টেকনাফের চেকপোস্টে ঘটে যাওয়া সেই দৃশ্যের বর্ণনা গতকাল রোববার রাতে ফোনে সমকালের কাছে বর্ণনা করেন নুরুল আমিন। টেকনাফের বাহারছড়া ইউনিয়নের এক নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা তিনি। মাছধরা বোট রয়েছে তার। নুরুল আমিন সমকালকে জানান, একই ধরনের বক্তব্য গতকাল তিনি তদন্ত কমিটির কাছেও দিয়েছেন।

গতকাল মেজর (অব.) সিনহা মো. রাশেদ খানের খুনের ঘটনায় গণশুনানি শুরু হয়েছে। টেকনাফের শামলাপুর রোহিঙ্গা ক্যাম্প ইনচার্জের কার্যালয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের গঠিত তদন্ত কমিটি রুদ্ধদ্বার এই গণশুনানি করে। শুনানিতে ১১ জন সাক্ষী দিতে আসেন। তাদের মধ্যে তদন্ত কমিটি ৯ জনের সাক্ষ্য নিয়েছেন। চট্টগ্রাম বিভাগের অতিরিক্ত কমিশনার মিজানুর রহমানের নেতৃত্বে তদন্ত কমিটির গণশুনানি অনুষ্ঠিত হয়।

গণশুনানি চলাকালে সংবাদকর্মীদের ভেতরে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। আবার সাক্ষী শেষ হওয়ার পরও তাদের অন্য দরজা দিয়ে বের করে নিয়ে যাওয়া হয়। সংবাদকর্মীরা সাক্ষীদের বক্তব্যও নিতে পারেননি। পরে নয় সাক্ষীর মোবাইল ফোনে কল করলে তাদের মধ্যে ছয়জনের নম্বর বন্ধ পাওয়া যায়। তিনজন সাক্ষীর ফোন খোলা পাওয়া যায়। তাদের সঙ্গে কথা হয় সমকালের। সাক্ষীরা জানান, তারা চোখের সামনে যা দেখেছেন তাই তদন্ত কমিটির কাছে বলেছেন। এ ঘটনায় তারা জড়িতদের বিচারও দাবি করেছেন।

প্রত্যক্ষদর্শী নুরুল আমিন জানান, চেকপোস্টে প্রাইভেটকারে কে কীভাবে নামল, সেটা বলতে পারব না। তবে গুলি করা থেকে শুরু করে পরবর্তী ৪০-৪৫ মিনিট কী ঘটেছে, সেটা বলতে পারব। সেটাই তদন্ত কমিটিকে জানিয়েছি। রাতে কীভাবে পুরো ঘটনা দেখলেন- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘একটি গাড়ির লাইট চেকপোস্টের অদূরে জ্বালানো ছিল। পরে জেনেছি, সেই গাড়িটি সিনহা সাহেবের। চেকপোস্টের সেখানে সিনহার সঙ্গী সিফাতও ছিল। পরে তার পরিচয় জানতে পারি। গুলির পর অনেক লোকের জটলা হয়েছিল। তবে পৌনে এক ঘণ্টার মতো সেখানে থাকার পর বাসায় চলে যাই। শেষের দিকে কেন যেন একটু ভয়ও পেয়েছিলাম। কারণ এটা হতে পারে এত কাছ থেকে কখনও গুলির ঘটনা দেখেনি।

আরেকজন এলাকাবাসী সমকালের কাছে ঘটনার বিবরণ দেন। তিনিও তদন্ত কমিটির কাছে তার বক্তব্য তুলে ধরেছেন। নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ করে তিনি জানান, একজন এলাকাবাসীর কাছে তিনি প্রথমে জানতে পারেন, মেরিন ড্রাইভ এলাকায় কেউ ‘ক্রসফায়ারে’ মারা গেছেন। এটা জানার পর তিনি চেকপোস্টের দিকে যান। প্রথমে সেখানে মাদ্রাসাছাত্রদের সঙ্গে তার কথা হয়। ওরাই তাকে গুলির ঘটনা জানান। এরপর তার সঙ্গে গ্রাম পুলিশের একজন সদস্যের দেখা হয়। গ্রাম পুলিশের ওই সদস্য তাকে জানান- বাহারছড়া পুলিশ ফাঁড়ির কনস্টেবল মামুন আপনাকে ফোন করছে। ফোন রিসিভ না করায় মামুন আপনার ওপর ক্ষুব্ধ। তাকে গুলির ঘটনায় সাক্ষী করতেই মামুন খোঁজাখুঁজি করছেন বলেও জানান গ্রাম পুলিশের ওই সদস্য। এটা জানার পর চেকপোস্টে না গিয়ে দূরে থেকেই সবকিছু দেখছিলেন তিনি।

ওই ব্যক্তি সমকালকে আরও জানান, গুলির ওই ঘটনার কয়েকদিন আগে তার ছোট বোনের জামাইকে ধরে নিয়ে ৪০ হাজার টাকায় আদায় করেন বাহারছড়া পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের পরিদর্শক লিয়াকত আলী। ধরে নেওয়ার পর ওই আত্মীয়র পক্ষ থেকে লিয়াকতকে ফোন করেন তিনি। তার ফোনের পরও আত্মীয়র কাছ থেকে টাকা আদায় করা হয়। এরপর লিয়াকতের সঙ্গে তার এক ধরনের দ্বন্দ্ব তৈরি হয়। তাই ৩১ জুলাই রাতে সিনহাকে গুলির করার পর সাক্ষী করতে লিয়াকত সরাসরি তাকে ফোন না করে কনস্টেবল মামুনকে দিয়ে করিয়েছেন।

গণশুনানিতে অংশ নেওয়া আনসারুল আলম বলেন, ‘আমি গণশুনানিতে সাক্ষী দিয়েছি। সেদিন পুলিশের চেকপোস্টে যা দেখেছি, তা সম্পূর্ণ বলেছি।’

অনেকে আসেন অভিযোগ জানাতে : গণশুনানি শুরু হওয়ার আগেই গতকাল শত শত এলাকাবাসী তাদের নানা অভিযোগ নিয়ে শামলাপুরে জড়ো হন। তাদের অনেকের ধারণা ছিল, শুনানিতে তারা টেকনাফ থানার সাবেক ওসি প্রদীপ কুমার দাশ ও বাহারছড়া তদন্ত কেন্দ্রের পরিদর্শক লিয়াকতের নানা অপকর্মের ব্যাপারে বক্তব্য দিতে পারবেন। পরে তারা নিশ্চিত হন, কেবল সিনহার ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীদের বক্তব্য নেওয়া হবে।

‘তদন্ত শেষ পর্যায়ে’ : গতকাল বিকেল পৌনে ৫টায় গণশুনানি শেষে চট্টগ্রাম বিভাগের অতিরিক্ত কমিশনার মিজানুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, আমাদের সাত কর্মদিবস দেওয়া হয়েছে। আমাদের যেখানে যেখানে যাওয়ার দরকার, আমরা প্রতিটি জায়গায় গিয়েছি। আমরা ঘটনাস্থল তিনবার পরিদর্শন করেছি। জায়গাগুলো রেকি করেছি। এ ছাড়া সংশ্নিষ্ট যারাই ছিল টেকনাফ থানা পুলিশ, ফাঁড়ি পুলিশ, বাহারছড়া তদন্ত কেন্দ্রের পুলিশ এবং আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন সদস্য প্রত্যক্ষদর্শীসহ এ ঘটনার সঙ্গে সংশ্নিষ্ট যেসব গাড়ি ছিল, গাড়িচালক, ময়নাতদন্তকারী ডাক্তার এবং সুরতহাল তৈরিকারী পুলিশ কর্মকর্তাসহ আমরা প্রায় ৬০ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছি। তাদের থেকে তথ্য সংগ্রহ করেছি।

তিনি বলেন, আমরা বিভিন্ন সংস্থাকে চিঠি দিয়েছি। তাদের কাছে যদি এ-সংক্রান্ত কোনো ডকুমেন্ট থাকে, তা সংগ্রহ করেছি। সেগুলো পর্যালোচনা করেছি। প্রত্যক্ষদর্শী অনেকে তাদের বক্তব্য দিয়েছেন। যাতে কোনো কিছু বাদ না পড়ে, সে জন্য আজকে আমরা ঘটনাস্থলের পাশের সরকারি স্থাপনা বেছে নিয়েছি। এখানে যারা প্রত্যক্ষদর্শী, একেবারে যারা দেখেছে, ঘটনাস্থলে ছিল- তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করেছি। আমরা তদন্ত কার্যক্রমের শেষ দিকে পৌঁছেছি। আশা করছি, ২৩ আগস্টের মধ্যে রিপোর্ট প্রস্তুত করে জমা দিয়ে দেব। এ তদন্ত মামলার কাজে লাগবে কিনা- এমন প্রশ্নে মিজানুর রহমান বলেন, আমাদের রিপোর্টিং মামলার কাজে লাগবে কিনা, তা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা বুঝবেন। আমরা সরকারকে জমা দেব। তিনি যদি সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করে সেটি তার মামলার কাজে লাগাতে চান, সেটি তার ওপর নির্ভর করবে। তদন্ত কর্মকর্তার আহ্বায়ক হিসেবে আমার এখানে সদস্যরা রয়েছে। মোট ১১ জন এসেছিল। আমরা ৯ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করেছি। দু’জন প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে বিবেচনা করা হয়নি।

কড়া নিরাপত্তা : সকাল ১০টা থেকে শুনানি হওয়ার কথা থাকলেও বৈরী আবহাওয়ার কারণে কিছুটা দেরিতে শুরু হয়। শুনানিতে ১১ জন সাক্ষ্য দিতে আসেন। সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য মাদ্রাসার একটি শিশুকেও আনা হয়েছিল। শুনানির স্থানটি ঘটনাস্থলের খুব কাছে মেরিন ড্রাইভ লাগোয়া। সকাল থেকেই সেখানে কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। সেনাসদস্য, পুলিশ-র‌্যাব ও আনসার সদস্যরা কড়া পাহারার ব্যবস্থা করেন। আশপাশ এলাকা থেকে অনেক উৎসুক জনতাও সেখানে ভিড় করে।

গণশুনানিতে উপস্থিত ছিলেন কক্সবাজারের রামু ১০ পদাতিক ডিভিশনের জিওসি মনোনীত লে. কর্নেল সাজ্জাদ, চট্টগ্রামের ডিআইজি মনোনীত অতিরিক্ত ডিআইজি জাকির হোসেন এবং কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ শাজাহান আলী। তবে গণশুনানির সময় কক্ষে কাউকে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। এর আগে সকালে শুনানিতে বক্তব্য দিতে আগ্রহীদের নাম রেজিস্ট্রেশন করা হয়।

গতকাল সকাল ১০টার দিকে প্রচণ্ড বৃষ্টির মধ্যে টেকনাফ বাহারছড়া শামলাপুর ২৩ নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পের সিআইসি কার্যালয়ে লোকজন জড়ো হতে শুরু করে। সর্বপ্রথম বাহারছড়ার পুরাতনপাড়ার আবদুল হামিদ ও লামারবাজার মসজিদের ইমাম মো. আমিন প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে গণশুনানিতে অংশ নেন। এরপর ধাপে ধাপে বাকিরা উপস্থিত হন। এ সময় এপিবিএন পুলিশ চেকপোস্টের কাছে রাহামানিয়া তাফিমুল কোরআন মাদ্রাসার সভাপতি নুরুল হকের নেতৃত্বে আট শিশু গণশুনানিতে সাক্ষী দিতে এলেও তাদের সাক্ষ্য নেয়নি তদন্ত কমিটি।

এ প্রসঙ্গে রাহামানিয়া তাফিমুল কোরআন মাদ্রাসার সভাপতি নুরুল হক বলেন, ‘শিশুরা আসতে ভয় পাচ্ছিল। তাই তাদের সঙ্গে আমি এসেছি। কোরবানির আগের দিন রাতে শিশুরা মাদ্রাসার ছাদে ছিল। এ সময় তারা সিনহা হত্যার ঘটনা দেখেছে। সে ঘটনার বর্ণনা দিতে তারা এই গণশুনানিতে হাজির হয়েছে।

গত ৩১ জুলাই রাতে টেকনাফের মারিশবুনিয়া পাহাড়ে ভিডিওচিত্র ধারণ করে মেরিন ড্রাইভ দিয়ে কক্সবাজারের হিমছড়ি এলাকার নীলিমা রিসোর্টে ফেরার পথে শামলাপুর এপিবিএন চেকপোস্টে পুলিশের গুলিতে নিহত হন সিনহা মো. রাশেদ খান। এ ঘটনায় নিহতের বোন শাহরিয়ার শারমিন ফেরদৌস বাদী হয়ে গত ৫ আগস্ট টেকনাফের সাবেক ওসি প্রদীপ কুমার দাশ ও বাহারছড়া পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের ইনচার্জ পরিদর্শক লিয়াকত আলীসহ ৯ পুলিশ সদস্যকে আসামি করে আদালতে মামলা করেন।

Please follow and like us:

Check Also

নতুন যোগ হচ্ছে ২০ লাখ দরিদ্র

মূল্যস্ফীতির কশাঘাত মোকাবিলায় ২০ লাখ ২৬ হাজার দরিদ্র মানুষকে নতুন করে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।