সাতক্ষীরায় ২৫ কোটি ৮৮ লক্ষ টাকার পাটকাটি বিক্রি:আঁশ নয়,পাটকাঠি জাগিয়েছে চাষীদের নতুন আশার আলো

পাটের চেয়ে পাটখড়ির দাম বেশি #দক্ষিণাঞ্চলের চার জেলায় পাটকাটির বিক্রি মূল্য দাড়িয়েছে ৮২ কোটি ৭৯ লক্ষ টাকা:চারকোল স্থাপনের দাবী: রপ্তানি বাড়লে বাড়বে পাট চাষ

আবু সাইদ বিশ্বাস:    ক্রাইমবাতা রিপোট:  সাতক্ষীরা: মূল্য হারানো সোনালি আঁশ পাট এবার ভিন্নভাবে সম্ভাবনা হয়ে আসছে কৃষকের সামনে। তবে আঁশ নয়, তার বদলে পাটকাঠি দেখাচ্ছে নতুন আশার আলো। সাতক্ষীরায় পাটের চেয়ে পাট কাঠির দাম তুলনা মূলক বেশি। তাই জেলার চাষিরা এবার পাটখড়ির দিকে নজর দিচ্ছেন বেশি। জেলা জুড়ে এখন চলছে সেই আয়োজন। শুধু সাতক্ষীরা জেলাতে ৮৬ হাজার ২৯৮ বিঘা জমিতে পাটের চাষ হয়েছে। যার উৎপাদিত পাটকাটির মূল্য দাঁড়াবে ২৫ কোটি ৮৮ লক্ষ ৯৬ হাজার ১৩৭ টাকা। একই অবস্থা খুলনা,যশোর,কুষ্টিয়াসহ সহ সারা দেশে।
কৃষি অফিস সূত্র থেকে জানা যায়, চলতি মৌসুমে সাতক্ষীরা,খুলনা,বাগেরহাট ও নড়াইল জেলায় পাটের আবাদ হয়েছে ৩৬ হাজার ৯৩৯ হেক্টর জমিতে। ২.৪৭ একরে এক হেক্টর ধরে যার পরিমান দাঁড়ায় ৯১,২৩৯.৩৩ হেক্টর এবং ৩.০২৫ বিঘায় এক একর ধরে যার পরিমাণ দাঁড়ায় ২ লক্ষ ৭৫ হাজার ৯৯৮.৯৭ বিঘা জমি। এক বিঘা জমিতে উৎপাদিত পাটকাটির দাম ৩ হাজার টাকা ধরে মোট মূল্যে দাঁড়ায় ৮২ কোটি ৭৯ লক্ষ ৯৬ হাজার ৯১৯ টাকা । কৃষি অফিস সূত্র এমন তথ্য জানায়। এর মধ্যে সাতক্ষীরা জেলাতে আবাদ হয় ১১,৫৫০ হেক্টর, খুলনাতে ১,৫৬০ হেক্টর, বাগেরহাটে ১৯১৯ হেক্টও ও নড়াইলে ২১,৯১০ হেক্টর জমিতে পাটের আবাদ হয়েছে।
ইতোমধ্যে পাটখড়ি পুড়িয়ে কার্বন তৈরির জন্য দেশে গড়ে উঠেছে প্রায় ২৫টি কারখানা। দেশে মোট উৎপাদিত পাটখড়ির অর্ধেক এই খাতে ব্যবহার করে এ থেকে বছরে প্রায় আড়াই লাখ টন কার্বন তৈরি সম্ভব, যা থেকে রপ্তানি আয় আসবে ৩২ কোটি ডলার বা আড়াই হাজার কোটি টাকা বলে উৎপাদক ও রপ্তানিকারকরা মনে করেন। সৃষ্টি হয়েছে কর্মসংস্থানেরও। ছোট পরিসরে শুরু হলেও আগামী দিনে এর পরিসর বাড়বে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
সাতক্ষীরা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী জানা গেছে, চলতি ২০২০-২১ মৌসুমে জেলার সাতটির মধ্যে ছয়টি উপজেলাতে পাট উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১ লাখ ৩৮ হাজার বেল। এরমধ্যে সাতক্ষীরা সদরে ৫৭ হাজার বেল, কলারোয়ায় ৪২ হাজার বেল, তালায় ৩৫ হাজার ৪শ বেল, দেবহাটায় ১০২০ বেল, কালিগঞ্জে ১৬২০ বেল ও আশাশুনিতে ৯০০ বেল এবং শ্যামনগরে ৬০ বেল। ২০১৯-২০ মৌসুমে জেলাতে এক লাখ ৩৭ হাজার ৬২৪ বেল পাট উৎপাদিত হয়।
চলতি মৌসুমে জেলাতে পাটের আবাদ হয়েছে ১১ হাজার ৫শ হেক্টর জমিতে। এরমধ্যে সাতক্ষীরা সদরে ৪ হাজার ৭৫০হেক্টর, কলরোয়ায় ৩ হাজার ৫০০ হেক্টর, তালায় ২ হাজার ৯৫০ হেক্টর, দেবহাটায় ৮৫ হেক্টর, কালিগঞ্জে ১৩৫ হেক্টর, আশাশুনিতে৭৫ হেক্টর ও শ্যামনগরে ৫হেক্টর জমিতে পাটের আবাদ হয়েছে। গত বছরের তুলনায় ৭৩০ হেক্টর জমিতে পাটের আবাদ হ্রাস পেয়েছে। এরপরও ৩৭৬ বেল পাটের উৎপাদন বেশি ধরা হয়েছে। কৃষি বিভাগের দাবী বিগত বছরের তুলনায় চলতি মৌসুমে উৎপাদনের মান ভাল। চলতি মৌসুমে জেলা কৃষি বিভাগ হেক্টর প্রতি ১২ বেল পাট উৎপাদন হবে ধারণা করছেন।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক নূরুল ইসলাম জানান, নতুন করে জেলাতে পাঠখড়ির গুরুত্ব বেড়েছে। তাঁর মতে বিঘা প্রতি জমিতে তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার টাকার পাটখড়ি বিক্রি করছে পাট চাষীরা। এছাড়া পানের বরজ,ঘেরে সবজি চাষ ও জ্বালানি হিসেবে পাঠ খড়ির চাহিদা বরাবরই জেলা রয়েছে।
কৃষকরা জানান,পাটের চেয়ে পাটখড়ির চাহিদা ও দাম বেশি।
সম্প্রতি ব্যাপক পরিসরে পাটকাঠি থেকে অ্যাকটিভেটেড চারকোল উৎপাদন শুরু হয়েছে। এর মাধ্যমে বদলে যাবে পাটশিল্পের অবস্থান। পাট থেকে খুলবে সম্ভাবনার দ্বার। দেশের মোট উৎপাদিত পাটকাঠির ৫০ ভাগ চারকোল উৎপাদন করে রপ্তানি করতে পারলে প্রায় ২ হাজার ৫০০ কোটি টাকার বিদেশি মুদ্রা অর্জন সম্ভব বলে জানান এ শিল্পের সঙ্গে জড়িতরা। তারা এ শিল্পকে এগিয়ে নিতে সরকারের প্রওয়োজনীয় পৃষ্ঠপোষকতা চান।
সম্প্রতি সচিবালয়ে বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী জানিয়েছেন, প্রতিবছর দেশে প্রায় ৩০ লাখ টন পাটকাঠি উৎপাদিত হয়। এর মধ্যে যদি ৫০ ভাগ পাটকাঠি চারকোল উৎপাদনে সঠিকভাবে ব্যবহার করা যায়, তবে বছরে প্রায় ২ লাখ ৫০ হাজার টন চারকোল উৎপাদন সম্ভব হবে, যা বিদেশে রপ্তানি করে প্রায় ২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন সম্ভব।
দেশে ২০১২ সালে প্রথম বাণিজ্যিকভাবে পাটকাঠি থেকে অ্যাকটিভেটেড চারকোল উৎপাদন শুরু হয়। ওই বছরই চীনে এ পণ্য রপ্তানি হয়। ৮বছর আগে পাটকাঠিকে ছাই বানিয়ে তা রপ্তানির পথ দেখান ওয়াং ফেই নামের চীনের এক নাগরিক। বর্তমানে চীন ছাড়াও তাইওয়ান, জাপান, হংকং ও ব্রাজিলেও এটির চাহিদা রয়েছে। এ ছাড়া চারকোলের বড় বাজার রয়েছে মেক্সিকো, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, জাপান, তুরস্ক, দক্ষিণ কোরিয়া, জার্মানিসহ ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশে।
তবে দেশে এখন পর্যন্ত পাটখড়ি থেকেই চারকোল উৎপাদিত হচ্ছে। এখন চারকোল তৈরির মিলে ব্যবহৃত হওয়ায় পাটকাঠির চাহিদা বেড়েছে কয়েক গুণ। ফলে পাটচাষিও লাভবান হচ্ছে। পাটকাঠি পুড়িয়ে পাওয়া কার্বন থেকে আতশবাজি, কার্বন পেপার, প্রিন্টার ও ফটোকপিয়ারের কালি, মোবাইলের ব্যাটারি, ফেসওয়াশের উপকরণ ও প্রসাধনপণ্য, পানির ফিল্টার, বিষ ধ্বংসকারী ওষুধ, জীবন রক্ষাকারী ওষুধ, দাঁত পরিষ্কারের ওষুধ ও সারসহ নানা পণ্য তৈরি হয়।
সাতক্ষীরার বিস্তৃত এলাকা ঢাকা পড়েছে সোনালী আঁশ পাট আর পাটখড়িতে। সড়কের পাশে বসেই আঁশ ছাড়ানোর ব্যস্ততা। গৃহিনীরা সহযোগীতা করছেন কাজে। স্কুল বন্ধ থাকায় কিশোরেরাও যোগ দিয়েছেন আঁশ ছাড়াতে।
সাতক্ষীরা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক নূরুল ইসলাম জানান,পাটখড়ির কথা বিবেচনা করে জেলাতে চারকোল স্থাপনের জন্য সরকারের কাছে দাবী জানানো হবে। যাতে চাষীদের মাঝে পাট চাষে আগ্রহ সৃষ্টি হয়।
সাতক্ষীরা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সদ্য বিদায়ী ও যশোরের নবাগত কৃষি উপপরিচালক বাদল চন্দ্র বিশ্বাস জানান,কৃষি পণ্যকে শিল্পে রূপান্তরের জন্য কৃষি মন্ত্রী ড.মো: আব্দুর রাজ্জাক কৃষি ক্ষেত্রে সরকারের নানা উদ্যোগের কথা জানান। বন্ধ থাকা চারকল চালু ও বিদেশে পাঠজান পণ্যের বাজার সৃষ্টির জন্য কৃষি মন্ত্রালয় কাজ করে যাচ্ছে।

আবু সাইদ বিশ্বাস: সাতক্ষীরা ১০/০৯/২০২০–০১৭১২৩৩৩২৯৯

Check Also

মালয়েশিয়ার পাম তেলে ইইউ’র নিষেধাজ্ঞা বাংলাদেশের শ্রমবাজারে অশনি সংকেত

বন উজাড়, কার্বন নির্গমনের ঝুঁকি এবং পরিবেশের ভারসাম্য নষ্টগত কারণ দেখিয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ মালয়েশিয়ার …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।