সাতক্ষীরার ২৭ নদ-নদী দখল ও দূষণে মুমূর্ষু

আবু সাইদ বিশ্বাস, সাতক্ষীরা : সুন্দরবন ও সাগর বিধৌত সুজলা সুফলা সাতক্ষীরা জেলায় ২৭টি নদ-নদী অস্তিত্ব সংকটে। ফারাক্কা বাঁধ, অপরিকল্পিত ব্রিজ স্লুইচগেট, বাঁধ নির্মাণ, চর দখল করে ইটভাটা তৈরি এবং নদী শাসন করে অবৈধ স্থাপনা নির্মাণের ফলে জেলার ছোট-বড় নদীর অধিকাংশই মৃত প্রায়। সাতক্ষীরা ছাড়াও ভৌগোলিক অবস্থানগতভাবে খুলনা ও যশোর এলাকার কয়েকটি নদী এরই মধ্যে মারা গেছে। কয়েকটি নদী অস্তিত্ব হারানোর পাশাপাশি অনেকগুলো মুমূর্ষু অবস্থায় রয়েছে। প্রশাসন ও প্রভাবশালীদের দায়ী করে সাতক্ষীরায় নদী বাঁচান’ মানুষ বাঁচান স্লোগানে বিশ্ব নদী দিবস উপলক্ষে মানব বন্ধন অনুষ্ঠিত হয়েছে।
বুধবার সকাল ১০টায় হিউম্যান রাইটস এন্ড এনভাইরনমেন্ট এ্যাকশন ডেভলপমেন্ট (হেড) ও স্বদেশ’র যৌথ উদ্যোগে এবং সাতক্ষীরা সদর উপজেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় বিনেরপোতা বেতনা ব্রিজের উপর এ জনসমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়।
বিশেজ্ঞরা বলছেন,  দখল ও দূষণে ভরে গেছে সাতক্ষীরার ২৭ নদ-নদী। এর মধ্যে সবচেয়ে বেহাল অবস্থা বেতনা ও মরিচ্চাপ নদী।
অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে জেলার ৪২৯টি খাল। এছাড়া খালের উপর নির্মিত ২১৬টি স্লুুইস গেটের বেশির ভাগ অকেজো। ২৭টি নদীর ১৩ টি পলিপড়ে ভরাট হয়ে গেছে। ফলে এসব নদী থেকে প্রবাহিত চার শতাধিক খাল তার অস্তিত্ব হারিয়েছে।  মাত্র কয়েকটি খাল পানিউন্নয়ন বোর্ড ও জেলা পরিষদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।
জাতীয় নদী সংরক্ষণ কমিশনের (এনআরসিসি) সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে দেশের নদীগুলোর ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে। একসময় দেশে ছিলো ৭০০টি নদী। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী এ সংখ্যা মাত্র ৪০৫টি। এর মধ্যে ভারতের সঙ্গে যৌথনদী ৫০টিরও বেশি। স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশ শতাধিক নদী হারিয়েছে। বর্তমানে ৬৪ জেলার ১৩৯টি নদীর বিরাট অংশ দখল হয়ে গেছে। সারা দেশে মোট ৪৯ হাজার ১৬২ জন দখলদারকে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে।
পানির গুণগতমান হিসেবে দেশের ২৯টি নদী মারাত্মক দূষণের শিকার। এর মধ্যে রয়েছে ঢাকার চারপাশের চারটি নদী, যেগুলোকে ‘জৈবিকভাবে মৃত’ বলে ধরে নেওয়া যায়।
নদীগুলোর এই শোচনীয় অবস্থার কারণে চাহিদা মেটাতে ভূগর্ভ থেকে প্রতিনিয়ত বেপরোয়াভাবে পানি তোলা হচ্ছে। ১৯৯০ সালে ঢাকার ভূগর্ভস্থ পানির স্তর যেখানে ছিলো পাঁচ মিটার নিচে, ২০১০ সালে তা নেমে গিয়েছিলো ৭০ মিটারে। অর্থাৎ সমুদ্রপৃষ্ঠের চেয়েও ৫১ মিটার (১৭০ ফুট) নীচে ছিলো ভূগর্ভস্থ পানির স্তর। এখন বোধহয় তা আরও নীচে নেমে গেছে। এতে ভূগর্ভে সমুদ্রের নোনা পানি অনুপ্রবেশের ঝুঁকি বাড়ছে।
২০০৯ সালে দেওয়া যুগান্তকারী রায়ের পরেও হাইকোর্ট নদী বাঁচাতে অসংখ্য নির্দেশনা দিয়েছেন। ২০১৯ সালে হাইকোর্ট নদী নিধনকে ‘যূথবদ্ধ আত্মহত্যা’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। এরপরও নদীর ধ্বংসলীলা চলছে।
এদিকে  নদী দখল করে অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ ও নদীর জোয়ার ভাটা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সাতক্ষীরার অধিকাংশ নদী তার গতি প্রকৃতি হারিয়ে ফেলেছে। কপোতাক্ষ, বেতনা, কাকশিয়ালী, মরিচ্চাপ, যমুনা, সোনাই, বলুয়া, গলঘেষিয়া, গুতিয়াখালি, সাপমারা নদীসহ অধিকাংশ নদী এখন মরা খালে পরিণত হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে ফাঁরাক্কা বাঁধ, অপরিকল্পিত ব্রিজ স্লুইচগেট, বাঁধ নির্মাণ, চর দখল করে ইটভাটা তৈরি এবং নদী শাসন করে অবৈধ স্থাপনা নির্মাণের ফলে সাতক্ষীরার ২৭টি ছোট-বড় নদীর অধিকাংশই মৃত প্রায়। নদীর বুকে বসত ঘর, বেড়ি বাঁধ দিয়ে মৎস্য চাষের কারণে সাতক্ষীরা ছাড়াও ভৌগোলিক অবস্থানগতভাবে সংলগ্ন খুলনা ও যশোর এলাকার কয়েকটি নদী এরই মধ্যে মারা গেছে। কয়েকটি নদী অস্তিত্ব হারানোর পাশাপাশি অনেকগুলো মুমূর্ষু অবস্থায় রয়েছে ।
স্বাধীনতা পরবর্তীকালে প্রথম এক দশক পর্যন্ত নদীগুলো প্রবাহমনা থাকলেও আশির দশক থেকে এর মরণদশা শুরু হয়। ফলে পানি নিষ্কাশনের অভাবে চলতি বর্ষা মৌসুমে সৃষ্ট হয়েছে জলাবদ্ধতা। বছরে প্রায় ৪/৫ মাস জলাবদ্ধতা স্থায়ী থাকায় এ জনপদে কৃষকদের ফসল ফলানো দুষ্কর হয়ে পড়ে। সুন্দরবন ও সাগর বিধৌত সুজলা সুফলা সাতক্ষীরা জেলায় ২৭টি নদ-নদীর তীরে গড়ে উঠেছে শহর বন্দর ও জনপদ। স্বেচ্ছাচারিভাবে নদীর তীরে এমনকি চর দখল করে নদীর মধ্যেও গড়ে তোলা হয়েছে বসতবাড়ি, দোকানপাট, ইটভাটা, কৃষিখামার। পানি প্রবাহ হারিয়ে মূমুর্ষ দশায় নদী গুলোর এ দখলদারিত্ব নদীর অস্তিত্বকে আরেক দফা হারিয়ে দিয়েছে। বেতনা নদীর বিনেরপোতার দুই তীর দিয়ে নদীর জায়গা দখল করে গড়ে উঠেছে ২০ থেকে ২৫টি ইটভাটা। চরভরাটিয়া জমি দখল করে স্থানীয় ভূমি অফিস থেকে কাগজপাত্র তৈরি করে ব্যক্তি মালিকানার নামে গড়ে তুলছে স্থাপনা।
উপকূলীয় বাঁধ প্রকল্প, অপরিকল্পিত স্লøুইচগেট ছাড়াও এ অঞ্চলের নদীর ওপর ৪৮টি সেতু নদীমৃত্যুর অন্যতম কারণ। এছাড়া ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণের ফলে উজানে পানির চাপ কমে যাওয়াও নদী মৃত্যুর অপর কারণ। নদী সমূহ ও সংযোগ স্থাপনকারী খালে অপরিকল্পিত নির্মাণ এবং চিংড়ি চাষের নামে ছোট ছোট বাঁধ দিয়ে পানি প্রবাহ গতি হ্রাস করাও দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলে নদী মৃত্যুর অন্যতম কারণ।
গত কয়েক বছর আগে সরকারের পক্ষ থেকে ২৬১ কোটি ৫৪ লক্ষ ৮৩ হাজার টাকা ব্যয়ে কপোতাক্ষ খনন করা হয়েছে। কিন্তু সেখানে আর আগের মত জোয়ার-ভাটা হয় না। কোন ভাবে নদীটি মরা খালের মত বেঁচে আছে। বেতনা নদী সহ মরিচ্চাপ ও যমুনা খনন করা হলেও দখল দারিত্বের কারণে তা পূর্বের অবস্থায় ফিরে যেতে পারেনি। কাকশিয়ালী নদীরও নাব্যতা দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। বেতনা নদী তার নাব্যতা হারিয়ে পুরোপুরি একটি মৃত খালে রূপ নিয়েছে। অনেক আগেই মৃত্যু হয়েছে মরিচ্চাপের । এসব নদীর প্রবাহ ঠিক রাখার জন্য বারবার জনগণের পক্ষ থেকে দাবি তোলা হলেও তা খুব বেশি কাজে আসছে না।
একইভাবে সাতক্ষীরা সীমান্তবর্তী ইছামতি ও সোনায় নদীর এখন পলিযুক্ত হয়ে উঠছে। এরই মধ্যে এই নদীতে বিশাল বিশাল চর জেগেছে। ভারতীয় ভূখন্ডের নদনদীর সাথে সংযুক্ত এ দুটি নদী বাংলাদেশ ভারতের সীমান্ত বিভাজন করে আছে। সুন্দরবনের নদী আড়পাঙাসিয়া, মাদার, মালঞ্চ, চুনা, ও,খোলপেটুয়া নদীর মাঝেও জেগে উঠছে বড়বড় চর। এরই নিকটস্থ যমুনা নদী মারা গেছে তিন দশক আগে।

Please follow and like us:

Check Also

আশাশুনির বদরতলা-ব্যাংদহা সড়কে পল্লী বিদ্যুতের পরিত্যাক্ত খুটির রড: l দুর্ঘটনার শঙ্কা

এস,এম মোস্তাফিজুর রহমান( আশাশুনি) সাতক্ষীরা।। আশাশুনি উপজেলার শোভনালী ইউনিয়নের বদরতলা টু ব্যাংদহা সড়কে পল্লী বিদ্যুতের …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।