নীতি দুর্নীতি অর্থনীতি: পরিস্থিতি বুঝতে সঠিক পরিসংখ্যান জানা দরকার

দু’দিন পরপরই নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য নিয়ে হইচই হয়। শাকসবজির কথা বলছি না। এগুলোর মূল্য তো বাড়েই। বাড়ে বেশি চাল, ডাল, চিনি, পেঁয়াজ ইত্যাদি ভোগ্যপণ্যের দাম। এই তো দু’দিন আগে গোল আলু নিয়ে বিরাট হইচই। কথা নেই, বার্তা নেই-গোল আলুর বাজার হঠাৎ ঊর্ধ্বমুখী। গোল আলুতে আমাদের অভাব আছে এমন কথা সাম্প্রতিককালে অন্তত শুনিনি। কিন্তু এবার শুনতে হল এবং অধিকতর দাম গুনতে হল। এর আগে পেঁয়াজ নিয়ে ঘটে গেল তুলকালাম কাণ্ড। পেঁয়াজের কথা কিছুটা বুঝি। পেঁয়াজের ঘাটতি আছে আমাদের। আমদানি করে খেতে হয়। কিন্তু ঘাটতির খবর কেউ রাখে না। হঠাৎ করে দাম বাড়লে তখন ঘাটতির কথা বলে শান্তি পাই। শাকসবজি গেল, গোল আলু গেল, গেল পেঁয়াজও। সব ঠিক আছে। এসবের ধাক্কা হয়তো কোনোমতে সামলানো যায়; কিন্তু চালের ধাক্কা সামলানো যায় না।

এ মুহূর্তে চালের দাম ঊর্ধ্বমুখী। কেন তা হবে? অগ্রহায়ণী ফসলের সময় এখন। কার্তিক মাস যায় যায়। গুদামে চাল আছে-বলে যাচ্ছে সরকার। তাহলে মোটা চালের দাম বাড়ছে কেন? ‘মিনিকেটের’ দামই ৪০ কেজিপ্রতি ২০০-৩০০ টাকা বাড়তি। শোনা যাচ্ছে সরকার চাল আমদানি করবে। কেমন কথা! চালে তো আমাদের অভাব নেই বলেই জানি। তাহলে তা কেন? কেন-এর কোনো জবাব নেই। জবাব আছে একটা। আমরা কেউ জানিই না পেঁয়াজ, আলু, চাল, ডাল, সয়াবিন, চিনি ইত্যাদি ভোগ্যপণ্যের বার্ষিক চাহিদা কত। মাথাপিছু এসব দ্রব্যের ভোগ কত। দেশে কত উৎপাদন হয়, বিদেশ থেকে কখন কী পরিমাণ দ্রব্য আমদানি করতে হয়। টাকার ব্যবস্থা কী ইত্যাদি নানা বিষয় এর সঙ্গে জড়িত। মূল ইস্যু পরিসংখ্যান, তথ্য। এখানেই ঝামেলা বেধে আছে।

বর্তমান চালের মূল্যবৃদ্ধি এবং আমদানির খবরে আমার তাই তথ্যের কথা মনে পড়ল। এ ব্যাপারে লোকমুখে একটা গল্প শুনেছিলাম অনেকদিন আগে। সেটা পাকিস্তান আমল। লৌহমানব ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান তখন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট এবং বটতলার উকিল মোনায়েম খান ‘পূর্ব-পাকিস্তানের’ (বাংলাদেশ) গভর্নর। হঠাৎ আইয়ুব খানের মাথায় ঢুকল-তার জানা দরকার দেশে কত গরু-ছাগল আছে। যথা চিন্তা তথা কাজ। তিনি হুকুম দিলেন। হুকুম পেয়ে মোনায়েম খানের মাথা খারাপ। এত অল্প সময়ের মধ্যে কীভাবে গরু-ছাগলের পরিসংখ্যান জোগাড় করা যাবে। মুখ্য সচিব বললেন, কোনো সমস্যা নেই। তিনি খবর পাঠালেন জেলা প্রশাসকদের কাছে। তাদের মাথাও খারাপ। খবর যেতে যেতে গেল গ্রামের চৌকিদারদের কাছে। চৌকিদাররা এসব কাজে অভ্যস্ত। তারা কালবিলম্ব না করে গরু-ছাগলের হিসাব দিয়ে দিল। জেলা প্রশাসকের কাছে তথ্য উপস্থিত করলে তিনি তার অফিসারকে জিজ্ঞেস করলেন কী করে এ তথ্য সংগৃহীত হল? তিনি সব খুলে বললেন এবং জানালেন এভাবেই তথ্য সংগৃহীত হয়। তখন তিনি তার অফিসারকে বললেন গরু-ছাগলের মোট সংখ্যার সঙ্গে ‘দুই’ নম্বর যোগ করতে। কারণ, এক নম্বর হচ্ছেন অফিসার যিনি তথ্য সংগ্রহ করেছেন, আরেকজন হচ্ছেন ‘ডিসি’ স্বয়ং। কারণ, তার সইয়ে তথ্য গভর্নরের কাছে যাচ্ছে। অতএব, গরু-ছাগল মাত্র দুটি বাড়ল। এর অর্থ হল, এমন কাজ এত সহজে হয় না। তবু তারা গরু-ছাগলের মতো এ কাজটা করেছেন।

বহুদিন আগের এ গল্পটি এখন মনে পড়ল খবরের কাগজের একটি প্রতিবেদন পড়ে। এ মাসের ১০ তারিখের একটি কাগজের শিরোনাম হচ্ছে: ‘৩ লাখ টন চাল আমদানি করবে সরকার’। এর কারণ, চলতি বছর বোরো মৌসুমে ধান ও চাল সংগ্রহের লক্ষ্য পূরণ করতে পারেনি সরকার। চুক্তি অনুযায়ী সরকারকে চাল সরবরাহ করেনি মিল মালিকরা। উল্টো করোনা দুর্যোগের মধ্যেও বাজারে চালের দাম আরও বাড়িয়ে দেন তারা। যার কারণে পাইকারি ও খুচরা বাজারে সরু, মাঝারি ও মোটা সব চালের দাম বাড়তির দিকে। খবরটিতে বলা হয়েছে, ৫ নভেম্বর পর্যন্ত সরকারের গুদামে খাদ্যশস্যের মোট মজুদের পরিমাণ ছিল ১০ লাখ ৩ হাজার টন। এর মধ্যে চাল ৭ লাখ ২৫ হাজার টন এবং বাকিটা গম। অথচ গত বছরের একই সময়ে খাদ্য মজুদ ছিল ১৫ লাখ ৯৬ হাজার টন। তার মানে খাদ্য মজুদের পরিমাণ প্রায় ৬ লাখ টন কম। আবার গত এক মাসের ব্যবধানে মজুদ কমেছে প্রায় ৩ লাখ টন। তার মানে মজুদ কমেছে খুবই দ্রুতগতিতে।

উদ্ভূত পরিস্থিতিকে একটু অস্বাভাবিকই মনে হয়। ঘাটতির কারণ হিসেবে বলা হয়েছে বন্যার কথা, ঘনঘন বন্যার কথা। সেই বন্যা তো গতকাল হয়নি। সেও ২-৩ মাস আগের কথা। তখন কোনো হিসাব করা হয়নি কেন? কত চাল গুদামে আছে, কত উৎপাদন ‘লস’ হয়েছে। কোনো আমদানির প্রক্রিয়া চলছে কি না। এসব ব্যাপারে কোনো মাথাব্যথা কারও আছে বলে মনে হয় না। অথচ চাল তো আলু বা পেঁয়াজ নয়, অথবা নয় চিনি বা সয়াবিন। চাল অত্যন্ত স্পর্শকাতর ভোগ্যপণ্য। এর দাম ওঠানামা করা মানে সরকারের দুশ্চিন্তার কারণ হওয়া। বিশেষ করে এমন সময় যখন দেশে করোনার আঘাত চলছে। তাছাড়া যখন বলা হচ্ছে-চালে আমাদের কোনো ঘাটতি নেই। বস্তুত চাল আমদানিও কম। এবার হঠাৎ করে ৩ লাখ টন চাল আমদানির প্রয়োজনীয়তা কেন হল? এ প্রসঙ্গেই বাজারে কথা আছে-চালের হিসাব আমাদের ঠিক নেই। আমাদের কত চাল উৎপাদন হয়, কত চাল ভোগে লাগে এ তথ্যের কোনো ‘বাপ-মা’ নেই। খাদ্য মন্ত্রণালয় বলে এক কথা, কৃষি মন্ত্রণালয় বলে এক কথা, অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলে অন্য কথা। আবার বাংলাদেশ ব্যাংকের পাবলিকেশনে থাকে অন্য কথা। এসব থেকে বোঝা দায় আমাদের চালের প্রয়োজন কত। মাথাপিছু চালের ভোগ কত। কী পরিমাণ চাল প্রসেসিংয়ে নষ্ট হয়।

বস্তুত চালের ব্যাপারে আমরা সবাই একটা গা-ছাড়া ভাব নিয়ে বসে আছি। বিষয়টি পরিষ্কার করি একটা বক্তব্য দিয়ে। চালের বর্তমান সংকট সামনে রেখে সরকারের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা গত মাসে (২৩.১০.২০২০) খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, ‘জনপ্রতি চালের যে ভোগ দেখানো হচ্ছে তাতে উৎপাদনের তথ্যের সঙ্গে ন্যূনতম ৫০ লাখ টন চাল উদ্বৃত্ত থাকার কথা। কিন্তু বাজারের তথ্য সেটা বলছে না। উৎপাদন কিংবা ভোগের তথ্যে গরমিল আছে।’ তার বক্তব্যের সঙ্গে সরকারি, বেসরকারি তথ্যের মিল আছে। আমরা তিনটি সূত্রে চালের ভোগের তথ্য পাই। একটি হল বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস), আরেকটি বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) এবং অপর একটি হচ্ছে ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইন্সটিটিউট (ইফপ্রি)। ২০১৬ সালের তথ্যে দেখা যাচ্ছে, এদের হিসাবেও বেশ পার্থক্য আছে। ‘বিবিএস’ বলছে মাথাপিছু ভোগ ৩৬৭ গ্রাম, ‘বিআইডিএস’ বলছে ৪৬০ গ্রাম এবং ‘ইফপ্রি’ বলছে ৪২৬ গ্রাম। এখন কোনটা ধরে আমরা এগোবো, তা-ই বিবেচনার বিষয়। এবং তা করবে সরকারি বিভাগ নানা তথ্য বিশ্লেষণ করে। ২০১৮ সালের আগস্টের এক হিসাবে দেখতে পাচ্ছি ‘বিআরআরআই’র মতে আমাদের চাল উদ্বৃত্ত থাকার কথা ৩০ লাখ টন। এ ধরনের উদ্বৃত্তের কথাই সব সময় বলা হয়। অথচ এবার হঠাৎ করেই চাল আমদানি করার কথা বলা হচ্ছে। তাও ৩ লাখ টন। উল্লেখ্য, গম আমদানি কিন্তু নিয়মিত হচ্ছে এবং তা ভালো পরিমাণে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে দেখতে পাচ্ছি খাদ্য সাহায্য ও আমদানি দুটো মিলিয়ে ৯৭ লাখ টনেরও বেশি গম দেশে এসেছে। বস্তুত ৩০-৪০ লাখ টন গম প্রতিবছর দেশে আসে। এ মুহূর্তে আমরা যে চিত্র দেখি তাতে মনে হয় মানুষ শুধু চালের ওপর নির্ভরশীল নয়। মানুষ এখন আটার রুটি খায়। এক সময় মানুষ আটার রুটি খেতে চাইত না। বলা হতো রুটি খায় গরিবেরা। এখন দেখা যায় মধ্যবিত্ত পরিবারেও রুটির চল হয়েছে। সকালের নাশতা রুটিতে। রোগীদের খাবার রুটিতে। শাকসবজির ব্যবহারও বেড়েছে। এমনকি মাছ-মাংস, ডিম-দুধের ভোগও বেড়েছে।

এসব বলার কারণ, এ ধরনের দ্রব্যের ভোগের কারণে চালের ওপর চাপ কমার কথা। কিন্তু সঠিক কোনো তথ্য আমরা পাচ্ছি না। গণ্ডগোলটা কোথায়? লোকসংখ্যা গণনায় গণ্ডগোল, না ভোগের হিসাবে? কেউ কেউ বলেন, চাল নাকি এখন গরুতেও খায়। এ ক্ষেত্রে চাল লাগে অনেক, লাগলেও তার তো একটা হিসাব আছে। এসব হিসাব কে করবে? হিসাব করার জন্য জাতীয় প্রতিষ্ঠান আছে। সরকারের বিভিন্ন বিভাগ তো আছেই। তাদের তথ্যের সঙ্গে জাতীয় প্রতিষ্ঠানের তথ্য মিলিয়ে দেখা যায় এবং সিদ্ধান্ত নেয়া যায়। কিন্তু দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, জাতীয় প্রতিষ্ঠান খুব বেশি কাজে আসছে না। এর নানা কারণ আছে। কারণ, বলার আগে সরকারের একজন মন্ত্রী পর্যায়ের প্রভাবশালী ব্যক্তির ধারণার কথা বলি। তিনি কিছুদিন আগে ‘বিবিএস’ সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেন, এটি একটি ‘বামন’ প্রতিষ্ঠান। ‘বামন’ মানে তুলনামূলকভাবে অদক্ষ, খর্ব একটি প্রতিষ্ঠান। দেখা যাচ্ছে, ৪৮২টি উপজেলায় এর অফিস আছে। অথচ কর্মকর্তা মাত্র ১৪৬ জন। বাকিগুলোয় কোনো কর্মকর্তা নেই। এটা দু-তিন বছর আগের ঘটনা। এখন অফিসার নিয়োগ পেয়েছে কি না, জানা নেই। দেখা যাচ্ছে, উপজেলা পরিসংখ্যান কর্মকর্তার পদ বিলুপ্ত হয়েছে। উপাত্ত সংগৃহীত হয় ‘চেইন ম্যান’ দিয়ে। তাদের শিক্ষা অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত। এই হচ্ছে জাতীয় প্রতিষ্ঠানের অবস্থা। সেখানে শুনেছি পরিসংখ্যান জানা লোকের অভাব। সরকারের আমলারাই এটা চালান। এমন একটা প্রতিষ্ঠানের ওপর ভর করে দেশের তথ্য সংগ্রহ ও সরবরাহের কাজ চালিয়ে যাওয়া খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। অথচ এ কাজটিই আমরা করে যাচ্ছি। কোন পণ্যের প্রয়োজন কতটুকু, কোনটার উৎপাদন কত, কত আমদানির প্রয়োজন-তার কোনো নির্ভরযোগ্য তথ্য কোথাও পাওয়া যায় না। পাওয়া যাওয়ার কথা বিবিএসের কাছে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি সরকারি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার ভাষাতেই ‘বামন’। অতএব…।

ড. আর এম দেবনাথ : অর্থনীতি বিশ্লেষক; সাবেক শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

rmdebnath@yahoo.com

Please follow and like us:

Check Also

‘বেনজীরের ঘরে আলাদীনের চেরাগ’

দুর্নীতির খবর নিয়ে প্রধান শিরোনাম করেছে কালের কণ্ঠ, ‘বেনজীরের ঘরে আলাদীনের চেরাগ’। প্রতিবেদনে রাষ্ট্রীয় শুদ্ধাচার …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।