এ কোন রাজনীতির আগুন? লাভ ক্ষতি কার: কেন সুপরিকল্পিত ভাবে বাসে আগুন লাগানো হলো

॥ জামশেদ মেহদী॥
গত ১৬ নভেম্বর সোমবার দৈনিক ‘যুগান্তরের’ প্রথম পৃষ্ঠায় প্রকাশিত দ্বিতীয় প্রধান সংবাদ শিরোনাম, “সংসদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা/আবারো বাসে আগুন কার স্বার্থে”। সংবাদের শুরুতে বলা হয়েছে, “বিএনপি-জামায়াতের অতীতের অগ্নিসন্ত্রাসের দিকে ইঙ্গিত করে প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা শেখ হাসিনা বলেছেন, সম্প্রতি কয়েকটি বাসে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটানো হয়েছে।” তিনি বলেন, “করোনা যখন চলছে, তখন এলো ঘূর্ণিঝড়, এলো বন্যা। এর মধ্যে কোনো কথা নেই, বার্তা নেই, কয়েকটি বাসে আগুন দিয়ে অগ্নিসন্ত্রাস। কেন, কী স্বার্থে, কার জন্য?” প্রথম আলোর প্রথম পৃষ্ঠায় প্রকাশিত প্রধান সংবাদের শিরোনাম, “পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে হঠাৎ বাসে আগুন/সংসদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা”। খবরে আরো বলা হয়, “কোনো রাজনৈতিক দলের নাম উল্লেখ না করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, নির্বাচন হয়। নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার নামে অংশগ্রহণ করে টাকা-পয়সা যা পায় পকেটে নিয়ে রেখে দেয়। ইলেকশনের দিন ইলেকশনও করে না। এজেন্টও দেয় না। কিছুই করে না। মাঝপথে ইলেকশন বয়কটের নাম দিয়ে বাসে আগুন দিয়ে পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে চায়। এসব ঘটনার উদ্দেশ্য কী?”
প্রধানমন্ত্রী জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে যে প্রশ্নটি করেছেন, সেই প্রশ্নটি সমগ্র দেশবাসীরও। ১২ নভেম্বর স্টার অনলাইনে এবং ১৩ নভেম্বর ডেইলি স্টারের মুদ্রণ সংস্করণে এই রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। অনলাইন সংস্করণে বলা হয়েছে যে, আটটি বাস পোড়ানো হয়েছে। কিন্তু পরের দিন প্রিন্ট সংস্করণে বলা হয়েছে যে, ১১টি বাসে অগ্নিসংযোগ দেয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী যেমন প্রশ্ন রেখেছেন, কারা এসব আগুন লাগানোর ঘটনা ঘটাল। জনগণের মনেও একই প্রশ্ন, কারা এসব ঘটনা ঘটাল? কিন্তু পত্রিকার রিপোর্ট; বিশেষ করে ডেইলি স্টারের রিপোর্ট পড়লে এটি পরিষ্কার হয়েছে যে, অত্যন্ত সুসমন্বিতভাবে এবং সুপরিকল্পিতভাবে কাজটি করা হয়েছে।
রিপোর্টে বলা হয়েছে, অগ্নিকা-ের প্রথম ঘটনাটি ঘটে দুপুর সাড়ে ১২টায়। স্থান নয়াপল্টন। দ্বিতীয় অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটে মতিঝিলের মধুমিতা সিনেমা হলের সামনে। সময় দুপুর ১২টা ৩৫ মিনিট। তৃতীয় ঘটনাটি ঘটে শাহবাগে অবস্থিত আজিজ সুপার মার্কেটে। সময় দুপুর ১টা ৩৮ মিনিট। তারপরের অগ্নিসংযোগের ঘটনাটি ঘটে শাহজাহানপুরে। সময় দুপুর ১টা ৪৭ মিনিট। দুপুর ২টার সময় আগুন লাগে সচিবালয়ের উত্তর গেটে। বংশালের নয়াবাজারে আগুন লাগে দুপুর ২টা ২৮ মিনিটে। প্রগতি সরণিতে আগুন লাগে অপরাহ্ন ৪টা ৩০ মিনিটে। পুলিশ এবং দমকল বাহিনীর সূত্র উল্লেখ করে ইংরেজি দৈনিকটি এই রিপোর্ট করেছে।
পরের দিনের প্রিন্ট মিডিয়ায় দেখা যায় যে, ৯টি বাসে আগুন লাগেনি। আগুন লাগানো হয়েছে ১১টি বাসে। বলা হয়েছে যে, অগ্নিসংযোগের কারণ সম্পর্কে তাৎক্ষণিকভাবে সুনির্দিষ্ট করে কিছু জানা না গেলেও পুলিশ সন্দেহ করছে যে, এসব অগ্নিসংযোগ বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করার উদ্দেশ্যে রচিত একটি পরিকল্পনার অংশ। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের ডেপুটি কমিশনার ওয়ালিদ হোসেন বলেন যে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটানোর জন্যই বাসে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটানো হয়েছে। লক্ষ করার বিষয় হলো এই যে, মাত্র দেড় ঘণ্টার ব্যবধানে ৮টি বাসে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। এমন নয় যে বাসগুলো একটি স্থানে সারিবদ্ধভাবে অবস্থান করছিল। বরং সেগুলো এই বিশাল মহানগরীর বিভিন্ন প্রান্তে অবস্থান করছিল। ওয়ালিদ হোসেন বলেন যে, তারা ঢাকার টঙ্গীর তুরাগ থেকে হাতবোমাসহ এক ব্যক্তিকে আটক করেছেন। ওই ব্যক্তি ধ্বংসাত্মক কাজের প্রস্তুতি নিচ্ছিল। তিনি আরো বলেন যে, সিসিটিভির ফুটেজ পরীক্ষা করে এবং ঘটনা প্রত্যক্ষকারী কয়েক ব্যক্তির সাথে কথা বলে পুলিশ জানতে পেরেছে যে, কারা এই অগ্নিসংযোগের পরিকল্পনা করছিল। এই ঘটনা ঘটার কিছুক্ষণ পরই পুলিশ বিএনপি অফিস ঘেরাও করে।
সিভিল ডিফেন্স ও দমকল বাহিনীর ডিউটি অফিসার রাসেল শিকদার বলেন যে, এই অগ্নিসংযোগের ঘটনায় কোনো ব্যক্তি আহত বা নিহত হয়নি। এই অগ্নিসংযোগের ঘটনায় একদিকে জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে, অন্যদিকে তেমনি অনেক প্রশ্নেরও উদয় হয়েছে। এখনো কোনোরূপ তদন্ত অনুষ্ঠিত হয়নি। কিন্তু ঘটনার একদিন পরই অন্তত ৩৮ ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হয়েছে এবং ৬ শতাধিক ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে। ১৪ নভেম্বর দৈনিক ‘প্রথম আলোর’ প্রথম পৃষ্ঠায় প্রকাশিত সংবাদ মোতাবেক কার নির্দেশে কারা বাসে আগুন দিয়েছে, সে বিষয়ে পুলিশ এখনো পুরোপুরি নিশ্চিত হতে না পারলেও রুজুকৃত মামলাসমূহে বিএনপিকেই দায়ী করা হয়েছে। এসব মামলার আসামিদের মধ্যে রয়েছেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী ও মরহুম সাদেক হোসেন খোকার পুত্র ইঞ্জিনিয়ার ইশরাক হোসেন, ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি ফজলুর রহমান, সাধারণ সম্পাদক ইকবাল হোসেন, ছাত্রদল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা সভাপতি রকিবুল ইসলাম, সদস্য সচিব আব্দুল্লাহ আমানসহ বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মী রয়েছেন। প্রথম আলোর রিপোর্ট মোতাবেক মামলা করা হয়েছে ৬৪৭ জনের বিরুদ্ধে। পুলিশের অভিযোগে বলা হয়েছে যে, সদ্যসমাপ্ত ঢাকা ১৮ আসনের উপনির্বাচন বানচাল করতে ও দেশে অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে বিএনপি ও এর অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীরা বাসে আগুন লাগিয়েছে। যাদের গ্রেফতার করা হয়েছে, তাদের মধ্যে ২৭ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে রিমান্ডে নেয়া হয়েছে।
মামলার অন্যতম প্রধান আসামি ইশরাক হোসেন বলেন যে, করোনায় আক্রান্ত হয়ে কয়েকদিন ধরে তিনি বাসায় আইসোলেশনে আছেন। অপর আসামি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদলের আহ্বায়ক রকিবুল ইসলাম বলেন, যখন অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটে, তখন তিনি ঢাকাতেই ছিলেন না। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, বাসে আগুন দেওয়ার ঘটনা বিএনপির সন্ত্রাসী কর্মকা-। ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার ও কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম বলেন, বাসে আগুন দেওয়ার ঘটনায় তারা একটি কল রেকর্ড পেয়েছেন। এই কল রেকর্ডের কথোপকথনের সঙ্গে অগ্নিকা-ের ঘটনার মিল রয়েছে। যারা কথা বলছেন, তাদের পরিচয় জানার চেষ্টা করা হচ্ছে। ডিআরইউতে অনুষ্ঠিত এক আলোচনা সভায় বিএনপি মহাসচিব ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, বাস পোড়ানোর ঘটনা ঘটিয়েছে সরকারি এজেন্টরা। তিনি বলেন, “আমি স্পষ্ট ভাষায় বলতে চাই, সরকারে আছে কিছু এজেন্ট সাবোটিয়ার। যখনই কোনো আন্দোলন শুরু হওয়ার পথে যায়, তখনই এসব এজেন্ট সাবোটিয়ার ঘটনা ঘটায় এবং বিএনপি ও তার মিত্রদের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে সেই আন্দোলনকে অঙ্কুরেই বিনষ্ট করে।”
এ ব্যাপারে গত ১৫ নভেম্বর একটি টকশোতে অংশ নিয়ে বিএনপি দলীয় জাতীয় সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা বলেন, আমরা এমন একটি সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি, যখন গোয়েন্দা নজরদারি বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চাপ বলেন আমরা এক ঘর থেকে আরেক ঘরে তাদের অনুমতি ছাড়া যেতে পারি না (ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানার টকশোটি আমরা রেকর্ড করেছি)। যেখানে ৮টি বাসে আগুন লাগলো, তখন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কোথায় ছিল? এটি একটি রহস্যম-িত ব্যাপার। এখন ঢাকা শহরে প্রচুর জ্যাম। সেখানে প্রকাশ্য দিবালোকে আটটি বাসে আগুন লাগল। এই আগুন লাগানোর শক্তি কারা রাখে? আওয়ামী লীগ অনেকদিন থেকেই বলে বেড়াচ্ছে বিএনপি এখন কোথাও নেই। বিএনপি এখন ঘরে বসে গেছে। সবকিছু এখন সরকারের নিয়ন্ত্রণে। এমন শান্ত পরিবেশে এই আগুনে উত্তাপ কারা ছড়াল? চোখের সামনে দিনের বেলায় এত বড় ঘটনা ঘটলো অথচ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ঘটনাস্থল থেকে একজনকেও ধরতে পারছে না। তিনি প্রশ্ন করেন, এই ঘটনার বেনিফিশিয়ারি কে? তিনি আরো বলেন, ২০১৫ সালে বিএনপি যখন আন্দোলন করে, তখনো অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। তখন অধিকাংশ গণমাধ্যম খবর ছাপে যে, এগুলোর পেছনে আছে ছাত্রলীগ ও যুবলীগ। তিনি বলেন, এই যে একটি ট্যাগ দেওয়া, আন্তর্জাতিক পরিম-লে বিএনপিকে সন্ত্রাসী হিসেবে চিহ্নিত করাÑ এগুলো করা তো আওয়ামী লীগের জন্য নতুন কিছু নয়। যদি বলা হয় যে, ২০১৫ সালে সন্ত্রাসী হিসেবে আওয়ামী লীগ বিএনপিকে চিহ্নিত করেছে, এবারের ঘটনাও আওয়ামী লীগের সেই অতীত দোষ চাপানোর স্বভাবের ধারাবাহিকতা, তাহলে অন্যায় কিছু বলা হবে না। তিনি আরো বলেন, ২০১৫ সাল থেকেই আওয়ামী লীগের চেষ্টা ছিল বিএনপিকে একটি ব্র্যান্ডিং দেওয়া। এবারে যা করা হচ্ছে, সেটি ২০১৫ সালেরই কন্টিনিউয়েশন। (এই ফুটেজ আমাদের কাছে সংরক্ষিত আছে)।
আমরা এ ব্যাপারে অত্যন্ত নিরপেক্ষতা বজায় রাখার চেষ্টা করছি। আমরা জানি না, কে বা কারা বা কোন গোষ্ঠী এসব করেছে বা কারা এর পেছনে পরিকল্পনাকারী ছিল। তবে কয়েকটি ব্যাপার দেখে বিস্মিত হতে হয়। মহানগরীর ১১টি স্থানে ১১টি বাস পুড়ল। কিন্তু কেউ দেখল না, কে বা কারা আগুন লাগাচ্ছে। এই ধরনের নাশকতামূলক কাজে কারো মৃত্যু হোক বা কেউ আহত হন, সেটা আমরা চাই না। তবে এটি একটি বিস্ময়ের ব্যাপার যে, ১১টি বাস পুড়ল অথচ কেউ নিহত বা আহত হলেন না। কয়েকটি বাস রানিং ছিল। আর কয়েকটি বাস দাঁড়ানো ছিল। রানিং বাস থেকে একের পর এক সব যাত্রী নেমে গেছেন। সবগুলো বাসেরই পেছনে আগুন দেওয়া হয়েছে। অথচ যাত্রীরা বা পথচারীরা কেউ দেখলেন না, কে বা কারা আগুন লাগাচ্ছে। শাহবাগের মতো ব্যস্ত এলাকা বা মতিঝিল-শাহজাহানপুরের মতো জনবহুল এলাকায় অগ্নিসংযোগ করা হলো। অথচ তারপরও কেউ দেখলেন না।
তারপরও আমরা কারো ওপর দোষারোপ করব না। ২৪ ঘণ্টার কম সময়ের মধ্যে পুলিশ বিএনপির ঘাড়ে দোষ চাপালো। এই ২৪ ঘণ্টায় কোনো তদন্ত হওয়া তো দূরের কথা, কোনো তদন্ত তো শুরুই হয়নি। তাহলে একটি রাষ্ট্রীয় সংস্থা হয়ে পুলিশ এই ধরনের আচরণ কীভাবে করতে পারে?
সুতরাং দোষারোপের রাজনীতির পুরনো অভ্যাস থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। গত ১০ মাস ধরে রাজনীতির ময়দান শান্ত সমাহিত। একটি সম্প্রীতিমূলক রাজনৈতিক পরিবেশ সৃষ্টির এখনই উৎকৃষ্ট সময়। এর মধ্যে সম্প্রীতি বিনষ্টের কাজ করা উচিত নয়।
জনগণ চায় যারা এসব বাসে আগুন লাগিয়েছে, নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে, সম্ভব হলে বিচার বিভাগীয় তদন্তের মাধ্যমে তাদের আইনের আওতায় আনা হোক। একবার যদি আসল অপরাধীরা শাস্তি পায়, তাহলে ভবিষ্যতে আর এই ধরনের ভয়াবহ অপরাধের পুনরাবৃত্তি ঘটবে না।

Please follow and like us:

Check Also

‘জলবায়ুু পরিবর্তন’ —– ঝুঁকিতে উপকূলের ৪০ শতাংশ কৃষিজমি

বাস্তুচ্যুত হওয়ার আশঙ্কা দুই লাখ ৪০ হাজার কৃষকের আবু সাইদ বিশ্বাস,সাতক্ষীরাঃ ‘জলবায়ুু পরিবর্তনে সবচেয়ে বড় …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।