সাতক্ষীরায় নদ-নদী খননে হ-জ-ব-র-ল: পরিস্থিতি পূর্বের চেয়ে আরো খারাপ হয়েছে

সাতক্ষীরা শহর ও পাশ্ববর্তী এলাকার নিষ্কাশন ব্যবস্থার উন্নয়ন প্রকল্প কার্যকর করতে জেলা নাগরিক কমিটি ১৩ দফা প্রস্তাবনা পেশ করেছে। রোববার বেলা ১২টার সময় সাতক্ষীরার জেলা প্রশাসক এসএম মোস্তফা কামালের কাছে উক্ত প্রস্তবনা পেশ করা হয়।

এসময় উপস্থিত ছিলেন, জেলা নাগরিক কমিটির আহবায়ক মো. আনিসুর রহিম, যুগ্ম আহবায়ক এড. শেখ আজাদ হোসেন বেলাল, সদস্য সচিব এড. আবুল কালাম আজাদ, যুগ্ম সদস্য সচিব আলী নুর খান বাবুল, সদস্য শেখ বায়দুস সুলতান বাবলু, মাধব চন্দ্র দত্ত, অপারেশ পাল, জিএম মনিরুজ্জামান প্রমুখ।

উল্লেখ্য, গত ২ জুন ২০২০ জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের বৈঠকে ‘সাতক্ষীরা জেলার পোল্ডার নং ১, ২, ৬-৮, ৬-৮ (এক্সটেনশন)-এর নিষ্কাশন ব্যবস্থার উন্নয়ন’ শীর্ষক ৪৭৫ কোটি ২৬ লাখ ১৬ হাজার টাকা ব্যয়ে একটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। এই প্রকল্পের মাধ্যমে সাতক্ষীরা শহর ও পার্শ্ববর্তী এলাকার জলাবদ্ধতা নিরসনে বেতনা ও মরিচ্চাপ নদীর ৮১ কি.মি. পুনঃখনন ও ড্রেজিং এবং ৮২টি খালে ৩৪৪.২২ কি.মি. সংস্কার ও পুনঃখনন করা হবে।

এছাড়া ২৭টি রেগুলেটর ও স্লুইস গেট মেরামত, পুণর্গঠন, পুনরাকৃতিকরণ, ১১৩.১২ কি.মি বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ সংস্কার, বেতনা নদীর ডান তীরের ১.৭০ কিমি ঢাল প্রতিরক্ষামূলক কাজ এবং ৪টি আরসিসি ঘাটলা নির্মাণ করা হবে।

জেলা নাগরিক কমিটির প্রস্তাবনার ভূমিকায় বলা হয়েছে, গত ১০ বছরের মধ্যেই গৃহীত উক্ত প্রকল্পের অধিকাংশ কাজই পানি উন্নয়ন বোর্ড, জেলা প্রশাসন, উপজেলা প্রশাসন, কর্মসৃজন প্রকল্প, ব্লু-গোল্ডসহ বিভিন্ন এনজিও এর মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা হয়েছে। কিন্তু তার কোন ফলাফল পাওয়া যায়নি। বরং পরিস্থিতি পূর্বের চেয়ে আরো খারাপ হয়েছে। বিশেষ করে ৩/৪শ’ফুট চওড়া বেতনা ও মরিচ্চাপ নদীর মাঝ বরাবর ৫০/৬০ ফুট খাল খনন করে নদী ভরাট করার কারণে পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে।

নাগরিক কমিটি এই পরিস্থিতি নিরসনের জন্য সাতক্ষীরা জেলার উপর দিয়ে প্রবাহিত উজানের সাথে সম্পর্কযুক্ত একমাত্র প্রবাহমান নদী ইছামতির শাখা সাপমারা ও লাবন্যবতীর স্লুইস গেট অপসারণ করে মরিচ্চাপ-খোলপেটুয়া ও অন্যান্য নদী খালের জোয়ার ভাটার স্বাভাবিক প্রবাহ পুনুরুজ্জীবিত করাসহ ১৩ দফা সুনিদিষ্ঠ প্রস্তাবনা পেশ করেন।

প্রস্তাবনা সমূহঃ
০১. ইছামতি নদীর সাথে মরিচ্চাপ নদীর সংযোগ পুর্নস্থাপনে লাবন্যবতীর দু’মুখে স্থাপিত শাখরা-টিকেট এবং সাপমারার দু’মুখে স্থাপিত হাড়দ্দহা-কামালকাটি স্লুইসগেট অপসারণ অথবা দুই নদীর সরাসরি সংযোগ স্থাপনের জন্য স্লুইসগেটের পার্শ্ব দিয়ে বেড়িবাঁধ কেটে বিকল্প চ্যানেল তৈরী করতে হবে।

০২. সাতক্ষীরা শহরের মধ্যদিয়ে প্রবাহিত প্রাণসায়র খালের সাথে বেতনা নদীর পুর্নসংযোগ স্থাপনে খেজুরডাঙ্গী স্লুইসগেট এবং মরিচ্চাপ নদীর পুনঃসংযোগ স্থাপনে এল্লারচার স্লুইসগেট (বর্তমানে অস্তিত্বহীন) অপসারণ অথবা পার্শ্ব দিয়ে বেড়িবাঁধ কেটে বিকল্প চ্যানেল তৈরী করতে হবে।

০৩. কোলকাতার খাল এবং শ্রীরামপুর-বাকাল খালের দু’মুখের সকল বাঁধা অপসারণ করতে হবে।

০৪. ইছামতির পানি প্রবাহ পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে আনার পূর্বেই লাবন্যবতী, সাপমারা, মরিচ্চাপ, কোলকাতার খাল ও শ্রীরামপুর-বাঁকাল খালের বেড়িবাঁধ যেখানে প্রয়োজন সেখানে উঁচু ও মজবুত করতে হবে এবং বিলের পানি নিষ্কাশনের খালের মুখে থাকা স্লুইস গেটগুলো সংস্কার করতে হবে। এছাড়া মরিচ্চাপ ও বেতনা নদীর সংযোগ স্থাপনকারী অন্যান্য খালগুলো উন্মুক্ত করে স্লুইস গেটগুলো সংস্কার করতে হবে। এজন্য অতিরিক্ত অর্থের প্রয়োজন হবে না। নদী ও খাল খননের পরিধি ছোট করে ঐ টাকার কিছু অংশ ব্যয় করলে কাজগুলো সম্পন্ন করা সম্ভব হবে।

০৫. প্রকল্পভুক্ত সকল নদী-খালের সিএস ম্যাপ অনুযায়ী সীমানা নির্ধারণ ও অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে সীমানা পিলার স্থাপন করতে হবে। নদী খালের ম্যাপ তৈরির ক্ষেত্রে জনগণকে সম্পৃক্ত করতে হবে।

০৬. প্রকল্পভুক্ত নদী খাল খননের সকল মাটি নদী খালের সীমানার বাইরে অবক্ষেপণ করতে হবে। কোন আবস্থাতেই নদী-খালের মধ্যে ডাম্পিং করে নদী বা নদীর পাড় ভরাট করা যাবে না।

০৭. গ্রাম-শহরের বর্ষার পানি নিষ্কাশনের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা রেখে মাছ চাষের জন্য পরিকল্পিতভাবে নিদিষ্ট জোন সৃষ্টি করতে হবে। জোনের বাইরে কোন ঘের করতে দেওয়া যাবে না এবং নদী-খালের বেড়িবাঁধ ও সরকারী রাস্তাকে কোনভাবেই মাছের ঘেরের বাঁধ হিসেবে ব্যবহার করতে দেওয়া যাবে না। বর্ষা মৌসুমের বৃষ্টির পানি লোকালয় থেকে বিলে, বিল থেকে খালে এবং খাল থেকে নদীতে প্রবাহিত হওয়ার সময় তীব্র ¯্রােত সৃষ্টির মাধ্যমে নদীর প্রাকৃতিক খনন প্রক্রিয়া বাঁধাগ্রস্ত করতে দেওয়া যাবে না।

০৮. শালিখা নদীর সাথে বেতনা নদীর পুর্নসংযোগ স্থাপনসহ প্রকল্পের বাইরে থাকা অন্যান্য নদীগুলোর আন্তঃসংযোগ পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে হবে।

০৯. ইছামতি নদীর পানি প্রবাহ নিশ্চিত হওয়ার পর লাবন্যবতী, সাপমারা, কোলকাতার খাল, শ্রীরামপুর-বাঁকাল খাল, মরিচ্চাপ ও খোলপেটুয়া নদী খনন ছাড়াই স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসবে। সেক্ষেত্রে নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ নিশ্চিত হলে আশাশুনির প্রতাপনগর, শ্রীউলা, খাজরা, আনুলিয়া এলাকার উপর দিয়ে প্রবাহিত খোলপেটুয়া নদীর ভরাট প্রক্রিয়া বন্ধ হবে এবং এলাকা ভয়াবহ নদী ভাঙনের হাত থেকে রক্ষা পাবে।
ইছামতির ঐ পানির আর একটি প্রবাহ কোলকাতার খাল ও শ্রীরামপুর-বাঁকাল খালের মাধ্যেমে সাতক্ষীরা প্রাণ সায়র খাল দিয়ে বেতনা নদীর জোয়ার-ভাটার সাথে সংযুক্ত হবে। একইভাবে ইছামতির খোলপেটুয়া নদীতে জোয়ার-ভাটার তীব্রতা বৃদ্ধি পেয়ে বুধহাটার গাং দিয়ে বেতনা নদী প্রবাহমান হবে।

এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন স্লুইসগেট নির্মাণের পূর্বে ইছামতি এবং মরিচ্চাপ নদীর জোয়ার-ভাটার ব্যবধান দুই ঘন্টা ছিল। অর্থাৎ ইছামতিতে জোয়ার শুরু হলে সেই জোয়ারের পানি লাবন্যবতী-সাপমারা হয়ে মরিচ্চাপ-খোলপেটুয়া দিয়ে ভাটিতে প্রবাহিত হতো। ঠিক একই প্রক্রিয়ায় খোলপেটুয়া-মরিচ্চাপে জোয়ার হলে সেই জোয়ারের পানি লাবন্যবতী-সাপমারা হয়ে ইছামতিতে ভাটি হতো।
আবার কোলকাতার খাল, শ্রীরামপুর-বাকাল খাল দিয়ে ইছামতির জোয়ারের পানি সাতক্ষীরা শহরের প্রাণসায়র খাল দিয়ে বেতনা নদীতে যেয়ে ভাটিতে প্রবাহিত হতো। একই প্রক্রিয়ায় শালিখা, কপোতাক্ষসহ প্রকল্পের বাইরের এলাকায় জোয়ার-ভাটা হতো।
এই আন্তঃসংযোগের কারণে নদী-খাল প্রবাহমান থাকায় পলি পড়ে ভরাট হওয়ার সুযোগ ছিল না। কিন্তু আন্তঃসংযোগ বন্ধ করাতেই এবং অন্যান্য কারণে বর্তমান পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।

১০. ইছামতির পানিতে নদী-খালের এই স্বাভাবিক প্রবাহ নিশ্চিত করার পরও বেতনা আববাহিকার উজানে খুব বেশী প্রবাহ পূর্বের অবস্থায় ফিরে আসার সম্ভাবনা কম। ফলে সেখানে পলি পড়ে দ্রুত নদী ভরাটের আশংকা থেকেই যাবে। এজন্য সুবিধাজনক স্থানে টিআরএম চালু করতে হবে। একই সাথে অন্যান্য নদী-খালের স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসার পর নিচু বিল উঁচু করতে এবং যেখানে পর্যাপ্ত ¯্রােত সৃষ্টি হবে না সেই সমস্ত এলাকায়ও টিআরএম চালু করতে হবে।

১১. নদী খাল খনন এলাকায় জন্য মনিটরিং ব্যবস্থা করতে হবে।

১২. প্রকল্পের জন্য একটি টেকনিক্যাল এডভাইজারি গ্রুপ তৈরী করতে হবে। যারা সাপ্তাহিক/মাসিক প্রতিবেদন দিবেন এবং এই সম্পর্কিত একটি ওয়েব সাইট তৈরি করতে হবে। যেখানে নাগরিকরা পরামর্শ ও মতামত প্রদান করবেন।

১৩. মাননীয় জেলা প্রশাসকের ঘোষণা অনুযায়ী ‘সকল নদী খালর ইজারা বাতিল’ এর সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে হবে।

প্রেসবিজ্ঞপ্তি

Please follow and like us:

Check Also

ঈদে স্ত্রীর জন্য মাংস কিনতে না পারায় দিনমজুর স্বামীর আত্মহত্যা

জামালপুরের বকশীগঞ্জে স্ত্রীর জন্য মাংস কিনতে না পেরে চিঠি লিখে আত্মহত্যা করেছেন হাসান আলী (২৬) …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।