চীনের মোকাবিলায় প্রতিবেশীদের কাছে টানার চেষ্টা ভারতের

॥ অর্চনা চৌধুরী ॥
দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্কে উত্তেজনা নিরসনসহ আঞ্চলিক পর্যায়ে চীনের কাছে নিজ প্রভাব হারানোর অবস্থা কাটিয়ে উঠতে চাইছে ভারত। এজন্য সাম্প্রতিক সময়ে কিছুটা নমনীয় হয়ে সম্পর্কোন্নয়নের চেষ্টা চালাচ্ছে নয়াদিল্লি। উদ্যোগ বেশ দৃশ্যমান। চলতি সপ্তাহেই ভারতীয় পররাষ্ট্র সচিব হর্ষবর্ধন শ্রিংলা ও জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল নেপাল এবং শ্রীলংকা সফর করেন। সফরে প্রাধান্য পায় নিরাপত্তা সহযোগিতা আর অর্থনৈতিক সম্পর্কের আলোচনা।
শুক্রবার (২৭ নভেম্বর) নাগাদ ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয়শঙ্কর শুব্রামনিয়াম দ্বীপরাষ্ট্র সিচেলেস সফরে আছেন। দেশটির সঙ্গে চীনের সামরিক সম্পর্ক অনেক গভীর হয়েছে সাম্প্রতিক সময়ে, যার ফলে দ্বিপাক্ষিক বিমান চলাচল শুরু হয় এবং চীনা নৌবাহিনীর জাহাজ সেখানে ভিড়তে পারে। দেশটির পার্লামেন্ট ভবন তৈরিতেও সাহায্য করেছে চীন।
অবকাঠামো নির্মাণে গত এক দশক ধরেই চীনের এই মুক্তহস্ত বিনিয়োগের সঙ্গে পাল্লা দিতে ব্যর্থ হয় ভারত। উপরন্তু, প্রতিবেশীদের নিরাপত্তা সহযোগিতা দেওয়ার ব্যাপারেও ছিল স্পষ্ট ব্যর্থতা। পাশাপাশি নয়াদিল্লির নীতিও আশপাশের দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্কে চিড় ধরায়, এমন অভিমত প্রকাশ করেন আমান ঠাক্যার। তিনি সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের গবেষক এবং অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্যাপিরো স্কলার।
আমান ব্যাখ্যা করেন, “দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিবেশীদের নিজের ‘কৌশলগত আঙিনা’ ধরে নিয়েই এতদিন তাদের ব্যাপারে নীতি প্রণয়ন করেছে ভারত। অর্থাৎ এসব দেশে নিজ ক্ষমতার আধিপত্যকে সে ন্যায়সঙ্গত অধিকার হিসেবে ধরে নেয়। তাই ভারতের প্রভাব হ্রাসে চীনই একমাত্র কারণ নয়, তবে উল্লেখযোগ্য প্রভাব অবশ্যই ফেলেছে। বিশেষ করে এতে নিজ দোরগোড়ায় আধিপত্য হারানোসহ ভারত মহাসাগরের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে দিল্লি।”
উত্তেজনার বৈশ্বিক পরিসর
গত জুনের মাঝামাঝি চীনা গণমুক্তি ফৌজের সঙ্গে সংঘর্ষে প্রাণ হারায় ২০ ভারতীয় জওয়ান। সেই উত্তেজনা এখনো চলমান। দুই পক্ষের সেনাবাহিনী এবার তীব্র শীতের মধ্যে পরস্পরের মুখোমুখি অবস্থান করছে হিমালয়ের উচ্চতায়।
গত মে থেকে শুরু এই পরস্পর বিরোধে উভয় পক্ষই হাজার হাজার সেনা, ট্যাঙ্ক আর ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েন করেছে। যুদ্ধবিমান প্রস্তুত রাখা হয়েছে নির্দেশ পাওয়ামাত্র আক্রমণের সতর্ক অবস্থায়।
চলতি সপ্তাহে ভারতীয় কূটনীতিকদের বৈঠকগুলোর পেছনে খুব সম্ভবত ওয়াশিংটনের চাপও আছে। গত অক্টোবরের শেষদিকে ভারত ও দক্ষিণ এশিয়া সফরে আসেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও এবং প্রতিরক্ষামন্ত্রী মাইক এস্পার। ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে বেইজিংয়ের প্রভাব ঠেকানোর কৌশলগত পরিকল্পনার একটি দিক বাস্তবায়ন ছিল ওই সফরের উদ্দেশ্য।
ওয়াশিংটনের সহজাত উপলব্ধি, বৈরী প্রতিবেশী নিয়ে ভারতকে সহযোগী করাটা ফলপ্রসূ হবে না। তাই সম্ভবত আলোচনার মনোভাব দেখাতে দিল্লিকে চাপ প্রয়োগ করা হয়েছে।
শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ আর সিচেলেসের মতো ভারত মহাসাগরের দ্বীপরাষ্ট্রসমূহ; চীনকে ঠেকাতে গঠিত অনানুষ্ঠানিক জোট- কোয়াড গ্রুপের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কোয়াড গঠিত হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, অস্ট্রেলিয়া ও ভারতকে নিয়ে। বলাইবাহুল্য, মূল নেতৃত্ব যুক্তরাষ্ট্রের হাতেই।
মিত্রদের চাপেই হয়তো শ্রিংলা নেপালে গিয়ে হাজির হন। গত মে মাসে দুই দেশের মধ্যে সীমান্ত উত্তেজনার পর তিনিই প্রথম শীর্ষ কোনো ভারতীয় কর্মকর্তা, যিনি দেশটি সফর করলেন। গত ২৬ নভেম্বর বৃহস্পতিবারের ওই সফরে তিনি দেশটিতে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ওষুধ এবং কোভিড-১৯ টিকা সরবরাহের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। বৈঠকে অবকাঠামো খাতেও বিনিয়োগের আশ্বাস দেন। এর মধ্যে একটি বাঁধ নির্মাণও রয়েছে।
সিচেলেস সফরে জয়শঙ্করও প্রায় ৯ কোটি ডলারের অবকাঠামো প্রকল্প বাস্তবায়নের ঘোষণা দেন। অন্যদিকে অজিত দোভাল শ্রীলঙ্কা সফরে ত্রিপাক্ষিক নৌ-সীমানা নিরাপত্তা নিয়ে আলোচনা সচল করবেন। ভারত, শ্রীলঙ্কা এবং মালদ্বীপÑ এই তিন দেশের সমুদ্রসীমায় নিরাপত্তা সহযোগিতা গড়ে তোলাই ত্রিপক্ষীয় বৈঠকের অংশ। কিন্তু গত পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে নয়াদিল্লির অনাগ্রহে তা অনুষ্ঠিত হতে পারেনি।
সবকিছু মিলিয়ে আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে, নয়াদিল্লি এবার ওয়াশিংটনের পরামর্শ বেশ ভালোই আমলে নিয়েছে। আর পরিস্থিতির গুরুত্বও বেশ অনুধাবন করছে। সাউথ এশিয়ান মনিটর।

Please follow and like us:

Check Also

আশাশুনির বিছটে খোলপেটুয়া নদীর বেড়ীবাঁধে ভাঙন

নিজস্ব প্রতিনিধি: আশাশুনি উপজেলার আনুলিয়া ইউনিয়নের বিছট বাজার সংলগ্ন খোলপেটুয়া নদীর দীর্ঘ বেড়িবাঁধে ভাঙন ধরায় …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।