সিনহা হত্যা চার্জশিটের বিস্তারিত তথ্য দ্রুত চিকিৎসার ব্যবস্থা করেননি এসপি

আলামতের নয়টি জব্দ তালিকা আদালতে * শরীরে ও মুখে কয়েকটি লাথি মেরে মৃত্যু নিশ্চিত * কিলিং মিশনের মিটিংয়ে ছিলেন প্রদীপ, লিয়াকতসহ ৫ জন * র‌্যাব গল্প বানিয়েছে -এসপি মাসুদ

ক্রাইমবাতা ডেস্করিপোট: পুলিশের হাতে গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর মেজর (অব.) সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খানের ত্বরিত চিকিৎসার ব্যবস্থা নেননি কক্সবাজারের তৎকালীন পুলিশ সুপার (এসপি) এবিএম মাসুদ হোসেন।

সিনহার পরিচয় জানার পরও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা হিসেবে এসপি ঘটনাস্থল পরিদর্শন না করে অবহেলামূলক আচরণের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন। তার আচরণ ছিল পক্ষপাতিত্বমূলক।

শুধু তাই নয়, সিনহার শরীরে ও মুখে কয়েকটি লাথি মেরে মৃত্যু নিশ্চিত করেন টেকনাফ থানার সাবেক ওসি (বরখাস্ত) প্রদীপ কুমার দাস। আদালতে দেয়া চার্জশিট (অভিযোগপত্র) প্রতিবেদনের সারসংক্ষেপে উঠে এসেছে এসব তথ্য।

চার্জশিটে উল্লেখ করা হয়, হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনার বিষয়টি প্রদীপ প্রথমে জানান বাহারছড়া পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের ইনচার্জ লিয়াকত আলীকে।

পরে কিলিং মিশন বাস্তবায়নের জন্য বৈঠক করেন। ওই বৈঠকে প্রদীপ-লিয়াকত ছাড়াও পুলিশের তিন সোর্স- নুরুল আমিন, আইয়াছ ও নিজাম উদ্দিনও উপস্থিত ছিলেন।

এদিকে চাঞ্চল্যকর এ হত্যা মামলায় চার্জিশিট প্রতিবেদনের সঙ্গে ৯টি জব্দ তালিকা আদালতে উপস্থাপন করেছে তদন্ত সংস্থা র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটেলিয়ন (র‌্যাব)।

এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল- হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত নাইন এমএম পিস্তল (বাট নম্বর কক্স ১০২, তাওরাস), সিনহার, রক্তমাখা পোশাক এবং আসামিদের মোবাইল কললিস্ট।

চার্জশিটে বলা হয়েছে, জুলাই মাসে যখন টেকনাফের তৎকালীন ওসি প্রদীপের সঙ্গে সিনহা, শিপ্রা দেবনাথ এবং সাজেদুল ইসলাম সিফাতের দেখা হয় তখন তাদের সঙ্গে ক্যামেরা সিস্টেম ছিল।

এসব দেখে প্রদীপ তাদের হুমকি দিয়ে বলেন, ‘আমি মেজর-টেজর ধার ধারি না। বহু সাংবাদিককে পিটিয়েছি। জেলে পাঠিয়েছি। ইউটিউব, ইন্টারভিউ, ভিডিও চিত্র বানিয়ে আমার কাজে (অপকর্ম) প্রতিবন্ধকতা তৈরি করলে বা কর্তৃপক্ষকে জানালে মেজর সাহেবকে ধ্বংস করে দেব।’

এরপরও সিনহা এবং তার সহকর্মীরা তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যেতে থাকেন। এ কারণে প্রদীপ কুমার মনে করেন, তার দুঃশাসন বা অপকর্ম কোনোভাবে প্রচার হয়ে গেলে তার বিরাট ক্ষতি হয়ে যাবে।

এজন্য তিনি প্রথমে বিষয়টি বাহারছড়া পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের ইনচার্জ লিয়াকত আলীকে জানান। এরপর তিনি থানা এলাকায় নিয়োজিত সব সোর্সের সঙ্গে কথা বলেন ও গোপন মিটিং করেন।

এরই ধারাবাহিকতায় জুলাই মাসের মাঝামাঝি সময়ে প্রদীপ, লিয়াকত, নুরুল, আইয়াছ এবং নিজামের সঙ্গে মিটিং করে সিনহা হত্যার ছক আঁকেন। চার্জশিট প্রতিবেদনে সিনহার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করা হয়েছে।

অন্যদিকে চার্জশিট প্রতিবেদনে কক্সবাজারের এসপি সম্পর্কে যেসব অভিযোগে তুলে ধরা হয়েছে সেসবকে র‌্যাবের গল্প হিসেবে উল্লেখ করেছেন এসপি এবিএম মাসুদ হোসেন।

কক্সবাজারের তৎকালীন পুলিশ সুপার (এসপি) এবিএম মাসুদ হোসেনের বিষয়ে চার্জশিট প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মেজর সিহনা হত্যার আগে প্রদীপের আরও অনেক অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড সম্পর্কে এসপি জানতেন।

নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ হিসেবে এসপি ছিলেন উদাসীন। সেনাবাহিনীর একজন স্বনামধন্য অবসরপ্রাপ্ত মেজর নিহত হওয়ার সংবাদে দেশজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি হলেও এবিএম মাসুদ হোসেন ঘটনাস্থল পরিদর্শন না করে অপেশাদারিত্ব ও অবহেলামূলক আচরণের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন।

ঘটনার পর এসপির আচরণ ছিল পক্ষপাতিত্বমূলক। ঘটনার রহস্য উদ্ঘাটন এবং অপরাধী শনাক্তে দায়িত্ব পালন এবং তদারকি কাজে তার আরও তৎপর হওয়া উচিত ছিল।

সিনহা গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর তাকে দ্রুততম সময়ের মধ্যে হাসপাতালে পাঠানোসহ ত্বরিত চিকিৎসা কার্যক্রম গ্রহণে এসপির কোনো সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা বা মনিটরিং দেখা যায়নি।

এ সংক্রান্ত সার্বিক তদারকিতেই ঘাটতি ছিল এবিএম মাসুদ হোসেনের। তাই তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় বা প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সংশ্লিষ্ট অধিদফতর বা মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করা যেতে পারে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এবিএম মাসুদ হোসেন এখন রাজশাহী জেলার এসপি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। নিজের বিরুদ্ধে আনা র‌্যাবের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন তিনি।

মঙ্গলবার বিকালে  বলেন, আমার ব্যাপারে র‌্যাব যে গল্প বানিয়েছে আমি সে বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে চাই না। তবে এটুকু বলতে পারি, একটি চাঞ্চল্যকর ঘটনার তদারকিসহ সার্বিক কার্যক্রমে একজন এসপির যে ভূমিকা থাকার কথা, আমি সেই ধরনের ভূমিকাই পালন করেছি।

এক্ষেত্রে আমার কোনো অবহেলা, অপেশাদারিত্ব বা উদাসীনতা ছিল না। তিনি বলেন, আমি যদি সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন না করতাম তাহলে নিশ্চয় সরকার গঠিত উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি আমার বিরুদ্ধে প্রতিবেদন দিত। আমার জানা মতে, উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কমিটির তদন্ত প্রতিবেদনে আমার বিরুদ্ধে কিছু লেখা হয়নি।

চার্জশিট প্রতিবেদনে সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খানের ভূয়সী প্রশংসা করে বলা হয়, তিনি ছিলেন অত্যন্ত দক্ষ, বিচক্ষণ, উদ্ভাবনশীল এবং চৌকস সাবেক সেনা কর্মকর্তা। তিনি ১৯৯৯ সালে বিএফ শাহীন কলেজ থেকে প্রথম বিভাগে এসএসসি এবং ২০০১ সালে রাজউক উত্তরা মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে প্রথম বিভাগে এইচএসসি পাস করেন। তার বাবা বীর মুক্তিযোদ্ধা এরশাদ খান ছিলেন অর্থ মন্ত্রণালয়ের সাবেক উপসচিব। ২০০৩ সালের ২১ জানুয়ারি ৫১তম লং কোর্সে তিনি সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। ২০০৪ সালের ২২ ডিসেম্বর কমিশন লাভ করেন। চাকরি জীবনে তিনি অত্যন্ত সুনামের সঙ্গে বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৯ সালে তিনি মেজর পদ থেকে স্বেচ্ছায় অবসর গ্রহণ করেন। তিনি রামু সেনানিবাস এবং টেকনাফ বিজিবিতেও চাকরি করেছেন।

চার্জশিট প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, পূর্বপরিকল্পিতভাবে সম্পূর্ণ ঠাণ্ডা মাথায় লিয়াকত আলী গুলি করেন সিনহাকে। কয়েক রাউন্ড গুলি করার পর সিনহা মাটিতে লুটিয়ে পড়লে মৃত্যু নিশ্চিত করার জন্য লিয়াকত আলী আবারও গুলি করেন। প্রদীপ কুমার ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় মাটিতে পড়ে থাকা সিনহার শরীরে ও মুখে কয়েকটি লাথি মেরে মৃত্যু সম্পর্কে নিশ্চিত হয়। পরে তার বুটজুতা দিয়ে সিনহার মুখমণ্ডলে ঘষা দিয়ে মুখমণ্ডল বিকৃত করার চেষ্টা করতে থাকেন। আসামিরা ঘটনাস্থলে থাকা সাক্ষী ও আশপাশের লোকদের অস্ত্র উঁচিয়ে হুমকি দিয়ে ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন।

প্রসঙ্গত, ১৩ ডিসেম্বর সিনহা হত্যার চার্জশিট আদালতে জমা দেয় র‌্যাব। চার্জশিটে প্রদীপ কুমার দাশসহ ১৫ জনকে আসামি করা হয়। এর মধ্যে এতে ১৪ জন আসামিকে গ্রেফতার দেখানো হয়। আর টেকনাফ থানার তৎকালীন এএসআই সাগর দেবকে পলাতক আসামি হিসেবে উল্লেখ করা হয়। ইতোমধ্যে সাগর দেবের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছেন আদালত।

এর আগে ৩১ জুলাই রাতে টেকনাফ উপজেলার বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুর চেকপোস্টে পুলিশের গুলিতে নিহত হন সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান। এ ঘটনায় ৫ আগস্ট সিনহার বোন শারমিন শাহরিয়ার ফেরদৌস বাদী হয়ে বাহারছড়া পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের সাবেক ইনচার্জ পরিদর্শক লিয়াকত আলীকে প্রধান আসামি করে ৯ জনের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করেন।

পরদিন প্রধান আসামি লিয়াকত আলী ও টেকনাফ থানার সাবেক ওসি প্রদীপ কুমার দাশসহ পুলিশের ৭ সদস্য আদালতে আত্মসমর্পণ করেন। পরে সিনহা হত্যায় সংশ্লিষ্টতা পাওয়ার অভিযোগে পুলিশের দায়ের করা মামলার ৩ সাক্ষী এবং শামলাপুর চেকপোস্টের দায়িত্বরত আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) ৩ সদস্যকে গ্রেফতার করে র‌্যাব।

এছাড়া একই অভিযোগে পরে গ্রেফতার করা হয় কনস্টেবল রুবেল শর্মাকে। মামলায় গ্রেফতারকৃত ১৪ আসামিকে র‌্যাবের তদন্তকারী কর্মকর্তা বিভিন্ন মেয়াদে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। এদের মধ্যে টেকনাফ থানার সাবেক ওসি প্রদীপ কুমার দাশ ও কনস্টেবল রুবেল শর্মা ছাড়া বাকি ১২ জন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে।

Check Also

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গাড়িবহরে হামলা মামলার সাজাপ্রাপ্ত পলাতক আসামি গ্রেফতার

প্রাণনাশের উদ্দেশ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গাড়িবহরে হামলা মামলার সাজাপ্রাপ্ত পলাতক আসামি ইয়াছিন আলীকে গ্রেফতার করা …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।