বিআইডব্লিউটিএর গেজ স্টেশনের তথ্য উপকূলে পানি কমছে, তলিয়ে যাওয়ার ঝুঁকিতে নেই দেশ

জলবায়ুজনিত ঝুঁকিপূর্ণ দেশের তালিকায় বাংলাদেশ অন্যতম। ঝুঁকি কমাতে নানা পদক্ষেপের কথা বলা হলেও যথাযথভাবে বাস্তবায়ন হচ্ছে না কোনোটির। জলবায়ু তহবিলের প্রকল্পগুলোতেও চলছে অর্থের তছরুপ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অদক্ষতা, অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের নানা দিক ও এ খাতের অনিয়ম নিয়ে শাহেদ শফিকের ধারাবাহিক প্রতিবেদনের আজ থাকছে শেষ পর্ব।

স্বাধীনতার ৫০ বছরে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের সাগরের মোহনায় সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা কমেছে দশমিক ৫১ মিটার। এমন তথ্য জানাল বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ বিআইডব্লিউটিএ। ওই অঞ্চলে অবস্থিত প্রতিষ্ঠানটির ৫টি গেজ স্টেশনের তথ্য বিশ্লেষণে এ তথ্য পেয়েছে বাংলা ট্রিবিউন। জলবায়ু বিশেষজ্ঞরাও এর সঙ্গে একমত পোষণ করে বলেছেন, নদীর পানি কমলে তার প্রভাব সাগরেও পড়বে। অর্থাৎ সাগরের পানি বাড়লে নদীর পানিও বাড়বে। আবার কেউ বলছেন, এ তথ্য এটাও প্রমাণ করে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা না কমলেও তা বাড়েনি। আর বাড়লেও তা বাংলাদেশের জন্য ক্ষতির কারণ হবে না।

দীর্ঘদিন ধরে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে বলে আশঙ্কা জানিয়ে আসছে আন্তর্জাতিক জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা। এর কারণে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হবে বাংলাদেশ, এমন খবরও চাউর হয়েছে বেশ। তারা বলেছেন, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে উপকূলীয় অঞ্চলসহ বাংলাদেশের এক তৃতীয়াংশ তলিয়ে যাবে। কিন্তু বাস্তবতার সঙ্গে সেই আশঙ্কার মিল খুঁজে পাচ্ছেন না দেশীয় বিশেষজ্ঞরা। তাদের দাবি, বৈশ্বিক উষ্ণতা নিয়ে বাংলাদেশের আশঙ্কারে এখনই বিশেষ কারণ নেই।

সম্প্রতি বঙ্গোপসাগর সংলগ্ন বাংলাদেশের দক্ষিণ উপকূলীয় অঞ্চলে অবস্থিত বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) ৫টি গেজ স্টেশনের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে স্বাধীনতার পর থেকে ওই স্থানগুলোর পানি ০ দশমিক ৫১ মিটার কমেছে। যেখানে দেশীয় জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সমুদ্রের উচ্চতা বাড়লে নদীর উচ্চতাও বাড়ার কথা। তাতে আশঙ্কা অনুযায়ী বাংলাদেশের এক তৃতীয়াংশ ডুবেও যাবে। কিন্তু সেটার কোনও লক্ষণ নেই।

২০১৮ সালের মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও জার্মানির পটসডাম ইনস্টিটিউট অব ক্লাইমেট ইমপ্যাক্ট রিসার্চের একদল গবেষক নতুন এক মডেলে গবেষণা করেন। ওই বছরের ২১ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত সেই গবেষণার ফলাফলে বলা হচ্ছে, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ২৩০০ সালের মধ্যে ০ দশমিক ৭ থেকে ১ দশমিক ২ মিটার বেড়ে যাবে। শুধু তাই নয়, কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাস নিঃসরণের মাত্রা শূন্যে নামিয়ে আনতে যদি দেরি হয়, তা হলে ২০২০ সালের পর থেকে প্রতি পাঁচ বছরের জন্য ২০ সেন্টিমিটার করে পানির উচ্চতা বাড়বে। সমুদ্রের গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধি, বরফ ও হিমবাহ গলে যাওয়ার কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের এমন উচ্চতা বাড়বে বলে আশঙ্কা তাদের।

IMG_4450সরেজমিন বাংলা ট্রিবিউনের সাংবাদিক শাহেদ শফিকগবেষণায় আরও বলা হয়েছে, ১ দশমিক ২ মিটার পানির উচ্চতা বাড়লে বাংলাদেশসহ ভিয়েতনাম ও ভারতের উপকূলবর্তী এলাকাগুলোতে ভয়াবহ বিপর্যয় নেমে আসবে। নিউ সাউথ ওয়েলেস বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জন চার্চের মতে, এ এলাকাগুলোতে এক মিটার উচ্চতার ঝুঁকিতে প্রায় ১০ কোটি মানুষ বাস করে। এক মিটার উচ্চতা বাড়লে এই ১০ কোটি মানুষ বাস্তুহারা হবে। আগের অনেক গবেষণায় দেখানো হয়েছিল, ২০২০ সাল নাগাদ সমুদ্রে পানির উচ্চতা এমন পর্যায়ে পৌঁছাবে যার ফলে বাংলাদেশের ৪০ শতাংশ এলাকা বন্যার ঝুঁকিতে পড়বে।

গবেষকদের এমন আশঙ্কা একেবারেই উড়িয়ে দিচ্ছেন দেশি জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, ২০২০ সাল তো শেষ, কিন্তু বাংলাদেশের কোনও এলাকা তলিয়ে যাওয়ার তথ্য নেই। বরং দেখা যাচ্ছে যেসব এলাকা তলিয়ে যাবে বলে আশঙ্কা করা হতো, সেখানে শত কিলোমিটার এলাকা নতুন করে জেগে উঠছে। বিশেষ করে নোয়াখালী, চট্টগ্রাম, সন্দ্বীপ, ভোলা, বরিশাল ও পটুয়াখালী এলাকা থেকে দক্ষিণের বঙ্গোপসাগরের দিকে বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে নতুন চর জেগে উঠছে।

বাংলাদেশ নিয়ে করা আরেক গবেষণায় বলা হয়েছে, ২০৩০ ও ২০৫০ সাল নাগাদ সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বর্তমানের তুলনায় যথাক্রমে ১৪ ও ৩২ সেন্টিমিটার এবং ২১০০ সাল নাগাদ ৮৮ সেন্টিমিটার পর্যন্ত বাড়তে পারে। এতে বাংলাদেশের কমপক্ষে ১০ শতাংশ এলাকা সমুদ্রের পানিতে তলিয়ে যাবে ও উপকূলীয় অঞ্চলের কোটি কোটি মানুষ উদ্বাস্তু হবে। এছাড়া সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ৬৭ সেন্টিমিটার বাড়লে গোটা সুন্দরবনই পানিতে তলিয়ে যাবে।

এ অবস্থায় বাংলা ট্রিবিউনের পক্ষ থেকে উপকূলীয় অঞ্চলে বঙ্গোপসাগরের মোহনায় অবস্থিত বিআইডব্লিউটিএ‘র গেজ স্টেশনগুলোর তথ্য সংগ্রহের উদ্যোগ নেওয়া হয়। তাতে প্রতিটি স্টেশন স্থাপনের গোড়া থেকে এ পর্যন্ত সকল ডাটা সংগ্রহ করা হয়। তাতে দেখা যায়, স্বাধীনতা পরবর্তী গত চার দশকে ওই এলাকায় ০ দশমিক ৫ মিটার পানি কমেছে।

টেকনাফের নাফ নদী

১৯৮২ সাল থেকে এ নদীর পানির উচ্চতা নির্ণয় করে আসছে বিআইডব্লিউটিএ। তখন থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত নাফে পানির সর্বোচ্চ উচ্চতা ছিল ৪ দশমিক ১৪ মিটার। কিন্তু ২০০৯ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত শেষ ১০ বছরে এ স্টেশনে পানির গড় উচ্চতা ০ দশমিক ৩২ মিটার কমে দাঁড়িয়েছে ৩ দশমিক ৮২ মিটারে।

কক্সবাজারের বাঁকখালী নদী

১৯৭৭ সাল থেকে এ নদীর পানির তারতম্য রেকর্ড করা হচ্ছে। ওই বছর থেকে ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত ১০ বছর সময়ে এ নদীতে পানির গড় উচ্চতা ছিল ৩ দশমিক ৯৪ মিটার। সর্বশেষ ২০০৯ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ১০ বছরে ০ দশমিক ০৮ মিটার কমে দাঁড়িয়েছে ৩ দশমিক ৮৬ মিটারে।

নোয়াখালীর হাতিয়ার চরচেঙ্গা, শাহবাজপুর নদী

১৯৭৯ সাল থেকে এ নদীর পানির পরিমাণ রেকর্ড করে আসছে বিআইডব্লিউটিএ। ওই বছর থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত ১০ বছরে এ নদীতে পানির গড় উচ্চতা ছিল ৩ দশমিক ৮৯ মিটার। সর্বশেষ ২০০৯ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত সময়ে ০ দশমিক ২৩ মিটার বেড়ে এর গড় পরিমাণ দাঁড়ায় ৪ দশমিক ১২ মিটারে।

কুয়াকাটার খাপড়াভাঙ্গা নদী

১৯৮৮ সাল থেকে এ নদীর পানির স্তর মাপা হচ্ছে। ওই বছর থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত ১০ বছরের পানির গড় উচ্চতা ছিল ৩ দশমিক ৮৮ মিটার। সর্বশেষ ২০০৯ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত সময়ে এ নদীতে পানির গড় পরিমাণ ০ দশমিক ৪২ মিটার কমে দাঁড়িয়েছে ৩ দশমিক ৪৬ মিটারে।

সাতক্ষীরার হিরণ পয়েন্ট, পশুর নদী

এই গেজ স্টেশনে ১৯৭৭ সাল থেকে কার্যক্রম শুরু করে বিআইডব্লিউটিএ। ওই বছর থেকে ১৯৮৬ পর্যন্ত ১০ বছরে পানির গড় উচ্চতা ছিল ৩ দশমিক ২৯ মিটার। কিন্তু সর্বশেষ ২০০৯ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ১০ বছরে এর পরিমাণ ০ দশমিক ৯ মিটার বেড়ে দাঁড়ায় ৩ দশমিক ৩৮ মিটারে।

উল্লেখিত ৫টি নদীর শুরুর ১০ বছরের গড় উচ্চতা দাঁড়ায় ৩ দশমিক ৮৩ মিটার। আর সর্বশেষ দশ বছরের গড় উচ্চতা দাঁড়ায় ৩ দশমিক ৭৩ মিটার। অর্থাৎ, আগের তুলনায় শেষ ১০ বছরে ০ দশমিক ৫১ মিটার উচ্চতা কমেছে।

জানতে চাইলে জলবায়ু ও নদী বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী ম. ইনামুল হক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের যে বিষয়টা সে প্রসঙ্গে আমি গোড়া থেকেই বলে আসছি এটা একটা ভাঁওতা। বাংলাদেশের মানুষের কাছে জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়গুলো প্রকল্প আকারে আসছে। এনজিওসহ যারা ফান্ড নিয়ে কাজ করে তারা সেটাকে প্রমাণ করার জন্য মাঠে যায়। তারা কৃষকের ইন্টারভিউ নিতে গিয়ে বলে, আগে কি এমন গরম পড়তো? পড়তো না। আপনি কী বলেন? তখন কৃষক বলতো, হ্যাঁ পড়তো না। অর্থাৎ উত্তর আগেই বলে দিচ্ছে

Please follow and like us:

Check Also

তালায় অগ্নিকাণ্ডে ৭টি বসতঘর পুড়ে ছাই

তালা(সাতক্ষীরা) সংবাদদাতা:সাতক্ষীরার তালায় অগ্নিকাণ্ডে সাতটি বসতঘর পুড়ে গেছে। উপজেলার ধলবাড়িয়া গ্রামে সোমবার বিকাল সাড়ে পাঁচটার …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।