নীতিমালা ছাড়াই সাড়ে সাত কোটি টাকা ব্যয় প্রশিক্ষণ ভাতা নিয়ে ‘ঘুম হারাম’ ইসির

একাদশ জাতীয় সংসদ এবং পঞ্চম উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে প্রশিক্ষণের নামে প্রায় সাড়ে সাত কোটি (সাত কোটি ৪৭ লাখ ৫৭ হাজার) টাকা ভাতা নিয়ে বিপাকে পড়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন ও ইসির নীতিমালা ছাড়া এই অর্থ খরচ করায় সৃষ্টি হয়েছে এমন পরিস্থিতির। এ ব্যাপারে ইতোমধ্যে আপত্তি দিয়েছে স্থানীয় ও রাজস্ব অডিট অধিদপ্তর। এর পরই ইসি সংশ্লিষ্টদের একরকম ‘ঘুম হারাম’ হয়ে পড়েছে। বিষয়টি নিষ্পত্তি করতে শুরু করেছে নানা তৎপরতা।

সূত্র জানায়, অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদিত পদ ছাড়াই ‘বিশেষ বক্তা’, ‘কোর্স পরিচালক’ ও ‘কোর্স উপদেষ্টা’ হিসাবে ভাতা নেওয়া, নির্ধারিত হারের চেয়ে বেশি ভাতা দেওয়া এবং খাত পরিবর্তন করে এসব টাকা ভাতা হিসাবে নেওয়া হয়। কয়েকবার বৈঠক করেও এ টাকার আপত্তি এখনো নিষ্পত্তি করতে পারেনি ইসি। তবে এর বাইরে বেশকিছু অডিট আপত্তি নিষ্পত্তি হয়েছে। আজ অনুষ্ঠেয় কমিশন সভায় বিষয়টি সমাধানের লক্ষ্যে উত্থাপন করা হচ্ছে। ওই সভায় প্রশিক্ষণ পরিকল্পনা ও বাজেট প্রমিতকরণ নীতিমালা অনুমোদনের জন্য তোলা হবে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশনের সিনিয়র সচিব মো. আলমগীর যুগান্তরকে বলেন, অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন ছাড়া প্রশিক্ষণ ভাতা নেওয়ায় অডিট আপত্তি এসেছে। নিয়ম অনুসরণ করে এসব ভাতা দেওয়া হলে এমন হতো না। তিনি বলেন, গত সংসদ ও উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের প্রশিক্ষণ ভাতা নিয়েই এমন ঘটনা ঘটেছে। এর আগে এমন ঘটনা ঘটেনি। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সব প্রক্রিয়ায় মেনে এসব অডিট আপত্তি নিষ্পত্তি না হলে যারা ভাতার নামে এসব অর্থ নিয়েছেন তাদেরকে সেই টাকা ফেরত দিতে হবে-এটাই নিয়ম।

সূত্র আরও জানিয়েছে, অডিট অধিদপ্তরের আপত্তি করা টাকা ভাতা হিসাবে নিয়েছেন একাধিক নির্বাচন কমিশনার, বর্তমান ও সাবেক সচিব, কয়েকজন যুগ্ম সচিব ও উপসচিবসহ বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তারা। ওই সময়ে ‘বিশেষ বক্তা’ হিসাবে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনাররা বক্তব্য দেন। তবে দুজন কমিশনারের বিষয়ে আপত্তি জানিয়েছে অডিট বিভাগ। এ ছাড়া কোনো কোনো ক্ষেত্রে তৎকালীন সচিব ও অতিরিক্ত সচিব, নির্বাচনি প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের (ইটিআই) মহাপরিচালক ও কয়েকজন যুগ্ম সচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তাও বিশেষ বক্তা হিসাবে বক্তব্য দেন। কোর্স পরিচালক হিসাবে কেন্দ্রীয়ভাবে ইটিআইর তৎকালীন মহাপরিচালক মোস্তফা ফারুক, অঞ্চল পর্যায়ের ইসির আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা ও জেলা পর্যায়ের জেলা নির্বাচন কর্মকর্তারা ছিলেন।

এ ছাড়া ইসির সচিবালয়ের যুগ্মসচিব মো. আবুল কাশেম, ফরহাদ আহম্মদ খান, মো. আব্দুল বাতেনসহ কয়েকজন যুগ্মসচিব ও উপসচিবের নেওয়া প্রশিক্ষণ ভাতার ওপরও অডিট আপত্তি রয়েছে। সবচেয়ে বেশি আপত্তি এসেছে মোস্তফা ফারুকসহ কয়েকজন কর্মকর্তার বিষয়ে। অতিরিক্ত ভাতা নিয়ে বিতর্ক হলে তাকে ওই পদ থেকে সরিয়ে ফরিদপুর আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা হিসাবে বদলি করা হয়। ইতোমধ্যে এ কর্মকর্তা বেশ কয়েকটি খাতে নেওয়া অতিরিক্ত টাকা সরকারি ট্রেজারে জমাও দিয়েছেন। তবে রহস্যজনক কারণে এসব বিষয়ে তদন্ত করেনি ইসি।

এ বিষয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)-এর নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান  বলেন, নির্বাচন কমিশন যে নিয়ম মানছে সেটা আবারও পরিষ্কার। ইসির সদিচ্ছা থাকলে তারা প্রশিক্ষণের ভাতা নেওয়ার বিষয়ে তদন্ত করতে পারত। কিন্তু তা না করে কয়েকজন নির্বাচন কমিশনার ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা আর্থিক সুবিধা নিয়েছেন। তিনি বলেন, কোনো কর্মকর্তাকে বদলি কোনো সাজা নয়, তদন্ত করে দায় অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে।

জানা গেছে, প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কেএম নূরুল হুদার সভাপতিত্বে আজ রোববার কমিশনের ৭৪তম সভা অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এ সভায় অনুমোদিত পদের বাইরে কোর্স উপদেষ্টা, বিশেষ বক্তা ও কোর্স পরিচালক-এই তিন ধরনের পদ রাখা এবং ওই পদের বক্তাদের বক্তৃতা ভাতা পরিশোধ নিয়ে আপত্তির বিষয়গুলো তোলা হচ্ছে। অভ্যন্তরীণ প্রশিক্ষণে কোর্স উপদেষ্টা ও বিশেষ বক্তার পদ রাখা ও ভাতা দেওয়া হবে কি না, সেই সিদ্ধান্ত চেয়েছে ইসি সচিবালয়। কোর্স পরিচালককে অর্থ মন্ত্রণালয়ের নির্ধারিত হার থেকে বেশি ভাতা দেওয়া হবে কি না, সেই সিদ্ধান্ত হওয়ার কথা রয়েছে। এ সভায় ‘নির্বাচনি প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের পরিচালনায় প্রশিক্ষণ ও বাজেট প্রমিতকরণ নীতিমালা, ২০২০’ অনুমোদনের জন্য তোলা হচ্ছে। সেখানে একটি প্রশিক্ষণ কোর্সে প্রতি দেড় ঘণ্টায় বক্তব্যে অতিথি বক্তার জন্য সাত হাজার টাকা ভাতা ধরা হয়েছে। প্রতি কোর্সের জন্য ‘কোর্স উপদেষ্টা’ আট হাজার টাকা, ‘কোর্স পরিচালক’ ছয় হাজার টাকা, সুপারভাইজিং প্রশিক্ষক ছয় হাজার টাকা ও মনিটরিং কর্মকর্তা পাঁচ হাজার টাকা প্রস্তাব করা হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তা নাম গোপন রাখার শর্তে বলেন, প্রশিক্ষণ ভাতার অডিট আপত্তির সিংহভাগ নিষ্পত্তির বিষয়টি কমিশন সভার সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করছে। এ সভায় যেসব পদ নিয়ে বিতর্ক রয়েছে সেগুলো রেখেই প্রস্তাবিত নীতিমালা অনুমোদন পেলে অডিট আপত্তি নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে সেটি যুক্তি হিসাবে দেখানো হবে। সভার কার্যপত্রে অডিট আপত্তির কিছু অংশ সংযোজনও করা হয়েছে।

অডিট অধিদপ্তরের আপত্তি : জানা গেছে, শুধু ভাতা সংক্রান্ত বিষয়ে সাত কোটি ৪৭ লাখ ৫৭ হাজার ৮০৫ টাকা আপত্তি দিয়েছে অডিট অধিদপ্তর। এর মধ্যে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন ছাড়া প্রশিক্ষণ খাতে ভাতা দেওয়া হয়েছে ৩ কোটি ৩৫ লাখ ৭৫ হাজার টাকা। নির্ধারিত হারের চেয়ে বেশি ভাতা দেওয়া হয়েছে ১ কোটি ৩২ লাখ ১২ হাজার ২৮০ টাকা এবং নিয়মের বাইরে অর্থনৈতিক কোড পরিবর্তন করে ভাতা দেওয়া হয়েছে ২ কোটি ৭৯ লাখ ৭০ হাজার ৪৭৫ টাকা। এ পরিমাণ টাকা আপত্তির বিষয়ে কয়েক দফা বৈঠক করেও নিষ্পত্তি হয়নি। বিষয়টি নিয়ে নির্বাচন কমিশনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের মধ্যে বিব্রতকর পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। কয়েকটি খাতের টাকা ফেরত দেওয়ারও কথা জানিয়েছে অডিট অধিদপ্তর। বাকি টাকার বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন বা সম্মতি নেওয়ার কথা বলা হয়েছে।

এ ছাড়া প্রশিক্ষণে অধিকসংখ্যক খাবার কিনে ৩৭ লাখ ৫৩ হাজার টাকা এবং ভুল বিল ভাউচারে ১০ লাখ তিন হাজার ২৫০ টাকা ব্যয় নিয়েও আপত্তি জানিয়েছিল অডিট অধিদপ্তর। পরে বৈঠক করে ওই অডিট নিষ্পত্তি করা হয়েছে। তবে প্রশিক্ষণ ভাতার অডিট নিষ্পত্তি হয়নি। গাড়ি মেরামতে ৬ লাখ ৬৬৬ টাকার ব্যয়ের অডিটও নিষ্পত্তি হয়নি।

আরও জানা গেছে, কমিশন সভায় সব ধরনের অডিট আপত্তির সব ধরনের তথ্য উপস্থাপন করা হচ্ছে না। এ সভায় কোর্স উপদেষ্টা পদে ১৯ লাখ ৭৬ হাজার টাকা, বিশেষ বক্তা খাতে ১২ লাখ ৭৫ হাজার টাকা ও কোর্স পরিচালক খাতে ১৪ লাখ ৯৩ হাজার ৮০০ টাকার ভাতার বিষয়ে সিদ্ধান্ত চাওয়া হচ্ছে।

সূত্র জানিয়েছে, প্রশিক্ষণ ভাতার হার কী হবে, সে সংক্রান্ত কোনো নীতিমালা করেনি নির্বাচন কমিশন। নির্বাচন কমিশনের ৫৭তম সভায় প্রশিক্ষণের পদ ও ভাতার হার অনুমোদন করা হয়। এ ছাড়া জাতীয় সংসদ ও উপজেলা নির্বাচনের আগে পৃথক সভায় কতটি প্রশিক্ষণ হবে, কতজন অংশ নেবেন, প্রশিক্ষক কারা হবেন, তাদের ভাতা কত হবে-সে সংক্রান্ত বিষয় কমিশন সভায় অনুমোদন করা হয়। কিন্তু অর্থ মন্ত্রণালয়ের কোনো অনুমোদন নেওয়া হয়নি। এক্ষেত্রে ইসির যুক্ত হচ্ছে নির্বাচন কমিশন সচিবালয় আইন, ২০০৯-এর ৩(২) ধারা অনুযায়ী ইসি সচিবালয় কোনো মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও দপ্তরের অধীন নয়। এমনকি রুলস অব বিজনেসের আওতাধীনও নয়। যদিও প্রশিক্ষণ খাতের পদ ও হার অনুমোদনের জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ের সচিবকে চিঠি দিয়েছিল ইসি সচিবালয়। ২০২০ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি ওই চিঠি দেওয়া হলেও এখনো অনুমোদন মেলেনি।

এ বিষয়ে ইসির সিনিয়র সচিব মো. আলমগীর যুগান্তরকে বলেন, প্রশিক্ষণে কতজন অংশ নেবেন, কোথায় প্রশিক্ষণ হবে সেই সিদ্ধান্ত নেবেন নির্বাচন কমিশন। কিন্তু ভাতার হার কী হবে, তা অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে অনুমোদন নিতে হবে। এ অনুমোদন না থাকায় অডিট আপত্তি এসেছে।

তবে ভিন্ন তথ্য দিলেন ইটিআইর সাবেক মহাপরিচালক মোস্তফা ফারুক। তিনি বলেন, আইন সবার ওপরে। আইন নির্বাচন কমিশনকে প্রশিক্ষণের সবকিছু অনুমোদনের ক্ষমতা দিয়েছে। কমিশনের অনুমোদন নিয়েই সবকিছু করা হয়েছে। কয়েকটি খাতে নেওয়া বাড়তি টাকা ফেরত প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সবকিছু ভাউচার দিয়ে বিল নিয়েছি। কিন্তু অফিস যদি সেই ভাউচার হারিয়ে ফেললে আমার কী করার আছে। তাই কয়েকটি খাতে টাকা ফেরত দিয়েছি।যুগা।

Please follow and like us:

Check Also

আলিপুরে চেয়ারম্যান প্রার্থী জিয়ার মোটর সাইকেল বহরে বোমা হামলা, ৫জন আহত

নিজস্ব প্রতিনিধি: সন্ত্রাসী জনপদ আলিপুরে চেয়ারম্যান প্রার্থী জিয়াউল ইসলাম জিয়ার মোটর সাইকেল বহরে বোমা হামলা …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।