হাতের কাছেই হরিণের মাংশ বেচাকেনা: বনরক্ষীরদের সহয়তায় শরিণ শিকার!

আবু সাইদ বিশ্বাস: সাতক্ষীরা: বনদস্যু ও বাঘের সংখ্যা কমতে থাকায় করোনায় সুন্দরবনে হরিণ ও বাঘ শিকারিদের দৌরাতœ বেড়েছে কয়েক গুণ। প্রতিনিয়ত হরিণ শিকারের ঘটনার খবর আসছে গণমাধ্যমে। সুসাধু মাংসের লোভে প্রতিবছর নির্বিচারে শত শত হরিণ মারছে চোরা শিকারিরা। শিকারের পর হরিণের মাংস, চামড়া, মাথা, শিং ও হাড় বিক্রি করে কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে এসব চক্র। সেই সঙ্গে সুন্দরবনের অভ্যন্তরের নদী-খালে বিষ দিয়ে মাছ ও কাঁকড়া নিধন করছে। এমনকি সরকার ঘোষিত অভয়ারণ্য এলাকায়ও বন্যপ্রাণীরা নিরাপদে নেই। সুন্দরবনের শ্রেষ্ঠ সম্পদ রয়েল বেঙ্গল টাইগার এখন অস্তিত্ব সংকটে। বনরক্ষীদের সহয়তায়ও হরিণ শিকারের ঘটনা অহরহ।
সংংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ৬ হাজার ১৭ বর্গকিলোমিটার আয়তনের বিশ্বখ্যাত এ সুন্দবনের স্থলভাগ রয়েছে ৪ হাজার ১৪৩ বর্গকিলোমিটার। তবে ১ লাখ ৩৩ হাজার ২৪৭ হেক্টর আয়তন বিশিষ্ট পূর্ব সুন্দরবনের শরণখোলা রেঞ্জের পর্যটক স্পট হিসেবে খ্যাত বঙ্গোপসাগর তীরবর্তী কটকা, কচিখালী এবং দুবলার চর, আলোর কোল, হিরণ পয়েন্টসহ বিভিন্ন পয়েন্টে বিশেষ করে সকাল ও বিকেলে মায়াবী চিত্রল হরিণের পাল দেখা যায়। যা প্রতি বছর প্রায় অর্ধলাখ দেশি-বিদেশি পর্যটকদের আকৃষ্ট করে। ১৯৯৫ সালের এফএও এবং ইউএনডিসি’র কারিগরি সহযোগিতায় পরিচালিত পশু শুমারী অনুযায়ী সুন্দরবনে হরিণের সংখ্যা ছিল ১ লাখ ২০ হাজার। ১৯৯৬-৯৭ সালের ইন্টিগ্রেড রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট প্রকল্পের আওতায় বন্যপ্রাণির উপর এক জরিপে হরিণের সংখ্যা ছিল এক লাখ থেকে দেড় লাখ। ২০০১ সালের আরেক জরিপে হরিণের সংখ্যা ছিল একই। ২০২১ সালে সুন্দরবনের হরিণের সংখ্যা প্রায় দুই লাখ ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে বন সংশ্লিষ্টদের অভিমত। এর মধ্যে ব্যাপক ভাবে শরিণ শিকারের ঘটনা ঘটছে।
(২৩ জানুয়ারি) ২০২১ শনিবার দুপুরে বাগেরহাটের শরণখোলা উপজেলায় ঘরের পাটাতন থেকে সুন্দরবনের ১৯টি হরিণের চামড়াসহ জেলা গোয়েন্দা পুলিশ(ডিবি) দুই পাচারকারীকে আটক করেছে । বাগেরহাট জেলা পুলিশের সম্মেলন কক্ষে সংবাদ সম্মেলনে পুলিশ সুপার (এসপি) পঙ্কজ চন্দ্র রায় এ তথ্য জানান। আটক করা হয় শরণখোলার রাজৈর গ্রামের মো. মতিন হাওলার ওরফে মতি কাজীর ছেলে ইলিয়াস হাওলাদার (৩৫) ও বাগেরহাট সদর উপজেলার ভদ্রপাড়া গ্রামের মো. মোশারেফ শেখের ছেলে মনিরুল ইসলাম শেখ (৪৮)।
(১৯ জানুয়ারি) ২০২১ মঙ্গলবার ক্রেতা সেজে সুন্দরবনের একটি রয়েল বেঙ্গল টাইগারের চামড়াসহ এক চোরা শিকারিকে গ্রেফতার করে পূর্ব সুন্দরবন বিভাগ ও র‌্যাব- ৮ সদস্যরা। মঙ্গলবার রাত ৮টার দিকে শরণখোলার রায়েন্দা বাস স্ট্যান্ড এলাকা থেকে একটি বাঘের চামড়াসহ মো. গাউস ফকির নামে এই চোরা শিকারিকে গ্রেফতার করা হয়। (১৯ জানুয়ারি) ২০২১ মঙ্গলবার পশ্চীম সুন্দরবনের সাতক্ষীরা রেঞ্জের মুন্সিগঞ্জ কলবাড়ী এলাকায় চুনা নদীর পাড়ে প্রায় ৯ বছর পর সুন্দরবনের লোকালয়ের একেবারে কাছে দেখা মিলেছে রয়েল বেঙ্গল টাইগার । বাঘটি যেন নদী পার হয়ে লোকালয়ে আসতে না পারে সে বিষয়ে সবাই সতর্ক থাকতে নির্দেশ দেন বনবিভাগ। সুন্দরবনে খাদ্য সংকটের কারণে বাঘটি লোকালয়ে প্রবেশের চেষ্টা করে বলে সংশ্লিষ্টরা জানান।(২১ জানুয়ারি) ২০২১ বৃহষ্পতিবার সুন্দরবন ভারতের অংশের সীমাখালী খাল থেকে দুই জেলের লাশ ভারতের অংশ থেকে উদ্ধারের খবর পাওয়া গিয়েছে। নিহতরা হলো- সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার কৈখালী ইউনিয়নের পশ্চিম কৈখালী গ্রামের রতন (৩৫) ও একই গ্রােেমর মিজানুর রহমান (৪০)।
সুন্দরবন দেখভালের জন্য বন অধিদপ্তরের দুটি বিভাগ রয়েছে। একটি খুলনা ও সাতক্ষীরা নিয়ে (সুন্দরবন পশ্চিম), অন্যটি খুলনার অংশ ও বাগেরহাট নিয়ে (সুন্দরবন পূর্ব বিভাগ)। দুই বিভাগের অধীনে আছে চারটি বন অঞ্চল, এতে এক হাজার ২শ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী কাজ করেন।বনজীবীদের কাছে জানা গেছে, চোরা শিকারিরা জেলে বা বাওয়ালি সেজে ছোট নৌকা নিয়ে দু-তিনজনের ছোট দলে বনের গহিনে প্রবেশ করে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তারা ফাঁদ, বিষ, টোপ এমনকি আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করে হরিণ শিকার করে। মারার পর বনের ভেতরেই ছিলে কেটে চক্রের এজেন্টদের মাধ্যমে ৪০০-৫০০ টাকা কেজি দরে মাংস বিক্রি করে। পরে শিকার করা হরিণ কৌশলে আশপাশের লোকালয়ে আনা হয়। এবং দেশের বিভিন্ন স্থানে পাচার করা হয়।
সরেজমিনে অনুসন্ধানে জানা গেছে, সুন্দরবনসংলগ্ন গ্রাগুলোতে হরিণের মাংস বিক্রি হয় প্রতিনিয়ত। এসব স্থানে ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা কেজি দরে মাংস কেনেন স্থানীয় লোকজন। তবে এলাকার বাইরের লোকজন কিনতে গেলে দাম একটু বেশি পড়ে। ওয়াইল্ড লাইফ ট্রাস্ট অব বাংলাদেশ নামের একটি বেসরকারি সংস্থার মতে সুন্দবনে বছরে ১১ হাজারের বেশি হরিণ নিধন হচ্ছে। তবে সুন্দরবন অঞ্চলে বন বিভাগের দুটি শাখা ও কোস্টগার্ড যে হিসাব দিয়েছে, তাতে বছরের গড়ে ১০০ হরিণের মাংস, মাথা বা চামড়া উদ্ধার করা হয় চোরা শিকারিদের হাত থেকে। কিছু শিকারিও গ্রেপ্তার হন।

এ বিষয়ে বন বিভাগের মুন্সিগঞ্জ ক্যম্পের ইনচার্জ ফরেস্টার আনোয়ার হোসেন বলেন, সুন্দরবনের হরিণ শিকার ও পাচাররোধে কঠোর নজরদারি রয়েছে। তিনি দাবি করেন হরিণ শিকারের ঘটনা আগের চেয়ে কমেছে। সুন্দরবন বিশাল এলাকা তাই হরিণ শিকার রোধে সর্ব মহলের সহযোগিতা প্রয়োজন।
সুন্দরবন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মুহাম্মদ বেলায়েত হোসেন জানান, পেশাদার বাঘ চোরা শিকারি গাউস ফকিরকে একটি রয়েল বেঙ্গল বাঘের চামড়াসগ গ্রেফতার করা হয়েছে। তিনি আরো জানান,বন বিভাগের প্রত্যেক কর্মী বন্যপ্রাণী ও বন সংরক্ষণের জন্য ২৪ ঘণ্টা দায়িত্বপালন করছে। যখন যেখানে খবর পাচ্ছি আমরা ছুটে যাচ্ছি। তিনি বলেন শিকারিদের ধরতেআমরা সবসসময় টহল জোরদার রেখেছি। সুন্দরবনের প্রাণ-প্রকৃৃতি রক্ষার্থে বন বিভাগের সদস্যরা সবসময় তৎপর রয়েছেন।

Please follow and like us:

Check Also

কারিগরি শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যানকে অব্যাহতি

সনদ বাণিজ্য চক্রের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে স্ত্রী গ্রেফতার হওয়ার পর এবার বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষাবোর্ডের …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।