ছোট্ট শিশু মেঘ এখন বুঝতে শিখেছে-উত্তরহীন নানা প্রশ্ন করছে সাগর-রুনি খুনের এক দশক পূর্তি তদন্ত যত পেছায় তত খুশি হয় খুনিরা

তোফাজ্জল হোসাইন কামাল : মাহির সারওয়ার মেঘ। পনের বছর ছুঁই ছুঁই করছে বয়স। সাড়ে চার বছর বয়সে পিতা মাতার অকাল মৃত্যুতে ইয়াতিম হয়ে পড়া এই শিশুটি আজ বুঝতে শিখেছে, জানতে শিখেছে। প্রশ্ন করতে শিখেছে, কেন কি কারণে তার পিতা মাতার অকাল মৃত্যু ঘটেছে। সব প্রশ্নের সাথে আরও কতো প্রশ্ন-খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জানতে চায় মেঘ। কিন্তু কোন  প্রশ্নেরই উত্তর দিতে পারেনা তাঁর বর্তমানের নিকটাত্মীয়রা। দিনের প্রায় সময়ই নানা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়ে কোন উত্তর না পেয়ে মনমরা হয়ে থাকে মেঘ। এক সময় মান অভিমান পর্ব সেরে পিতা মাতার স্মৃতি হিসেবে ফ্রেমে বাঁধা ছবিই তখন শেষ ভরসা হয়ে ওঠে মেঘের কাছে। এসব কথা জানালেন মেঘ‘র মামা নওশের রোমান। যার সাথে ভালোমন্দ সময় কাটে মেঘের।
ঠিক ১০ বছর আগে সাগর সরওয়ার এবং মেহেরুন রুনি সাংবাদিক দম্পতিকে রাজধানী ঢাকার পশ্চিম রাজাবাজার এলাকায় তাদের বাসায় নির্মমভাবে হত্যা করা হয় ২০১২ সালের ১১ই ফেব্রুয়ারি। ঘটনার সময় ঐ বাসায় থাকা তাদের একমাত্র শিশু সন্তান মাহির সরওয়ার মেঘ বেঁচে যায়। তখন তার বয়স ছিল সাড়ে চার বছর। পিতা মাতার খুনের পর থেকেই মেঘ দাদী-নানু আর মামার আশ্রয়ে বেড়ে উঠছে।
আর দিন কয়েক বাদেই আলোচিত সাংবাদিক দম্পতি হত্যাকান্ডের ১০ বছর পূর্ণ হবে। এক দশক আগের চাঞ্চল্যকর এই মামলাটির তদন্তেই কেটেছে বিগত সময়। অন্ধকারে থাকা সাগর-রুনির মামলাটি নিয়ে একদিকে বিচারপ্রার্থীদের হতাশার পাল্লা ভারি হয়েছে অন্যদিকে প্রশ্ন উঠেছে তদন্তকারী সংস্থার সদিচ্ছা নিয়ে। আইনজীবীরা বলছেন, চাঞ্চল্যকর এ মামলার সুরাহা করতে না পরলে আস্থা হারাবেন ভুক্তভোগীরা।
জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহদীন মালিক  বলেন, কেবল বিচারের দীর্ঘসূত্রতার কথা বলা হয়, কিন্তু তদন্তের দীর্ঘসূত্রতার বড় দৃষ্টান্ত হয়ে রইল সাগর-রুনির হত্যাকাণ্ড। পারিবারিক, পেশাগত বা ব্যবসায়িক- এসব কারণে সাধারণত এমন হত্যাকাণ্ড ঘটে থাকে। তাঁদের হত্যা করে কার লাভ এবং কে, কাকে ভাড়া করেছে-এসব প্রশ্নের সুরাহা এত দিনে যেহেতেু হয়নি, আর হবে বলেও মনে হয় না।
তাহলে কি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী হাল ছেড়ে দেবে? ডিবি তো বলেই দিয়েছিল, তারা এটি পারবে না। এরপর হাইকোর্ট বলেছেন র‌্যাবকে তদন্ত করতে। র‌্যাব বিষয়টি নিয়ে বিব্রত, এটি ধারণা করা যায়। কারণ সাংবাদিকেরা যখন বিষয়টি নিয়ে র‌্যাবের সঙ্গে যোগাযোগ করেন, তখন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বিব্রত ও বিরক্ত হন।
র‌্যাব যদি এই তদন্ত শেষ না করতে পারে, তাহলে হাইকোর্টকে তা জানাতে পারে। দেশে আরও তদন্ত সংস্থা রয়েছে। পিবিআই, সিআইডিসহ বিভিন্ন সংস্থা উল্লেখযোগ্য তদন্ত সম্পন্ন করেছে। তারাও চেষ্টা করে দেখতে পারে। আর যদি রাজনৈতিক সদিচ্ছার বিষয় যুক্ত থাকে, সেটিও বলে দেয়া ভালো। তবে হত্যার বিচার একমাত্র খুনিরা ছাড়া রাষ্ট্র, সরকার ও প্রত্যেক নাগরিক চাইবে।
২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারির পর সাগর- রুনির হত্যা মামলাটির তদন্তের গতির দিতে তাকালে দেখা যায়, এ সময়ের মধ্যে ৭ জন তদন্ত কর্মকর্তা বদল হলেও এগোয়নি মামলার তদন্ত কার্যক্রম। উল্টো ৭৮ বার সময় নিয়েছেন তারা। বিচারের আশায় বুক বাঁধতে গিয়ে এখন হতাশগ্রস্ত পরিবার।
নিহতের রুনীর ভাই নওশের রোমান বলেন, প্রথম দুই-তিনদিন যা ছিল এখনও তাই আছে। তদন্তে অগ্রগতি না থাকায় তাদের পরিবারগুলো হতাশা প্রকাশ করেছে। এই দু’টি পরিবারে এখন বিচার পাওয়া না পাওয়ার প্রশ্নেই সন্দেহ তৈরি হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে সান্ত্বনা পাওয়ার পথও খুঁজে পাচ্ছে না সাংবাদিক দম্পতির বিপর্যস্ত পরিবার দু’টো। মেহেরুন রুনির ভাই নওশের রোমান বলছিলেন, তাদের মাঝে একদিকে রয়েছে শূন্যতা, অন্যদিকে হতাশা তৈরি হচ্ছে। ‘সাগর-রুনি’র শিশু সন্তান মেঘ বড় হচ্ছে। যখন সে পুরোপুরি বুঝতে শিখবে, নির্মমভাবে বাবা-মা হারানোর ঘটনা তার ওপর নেতিবাচক প্রভাব কতটা ফেলবে, সেটা নিয়েই আমরা পরিবারের সদস্যরা এখন শঙ্কিত।”
পশ্চিম রাজাবাজারে মেহেরুন রুনির মায়ের বাসায় যখন নওশের রোমানের সাথে কথা হচ্ছিল, সেখানেই মাহি সরওয়ার মেঘ ঘুর ঘুর করছিল। এখন তাঁর কিছু বোঝার সময় হয়েছে। হত্যার বিচার না হলে মেঘ যখন বড় হবে, তাকে কি জবাব দেবেন, সেটি বড় চিন্তার বিষয় তাঁর দাদী-নানীর কাছে।
মেঘের দাদী অর্থাৎ সাগর সরওয়ারের মা সালেহা মনির বলছিলেন,তদন্ত নিয়ে তারা অন্ধকারেই আছেন। নিশ্চয়ই কোথাও কোনো প্রতিবন্ধকতা আছে। আর সেকারণে তদন্ত এগুচ্ছে না।”
হত্যাকাণ্ডের পর পরই তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে হত্যাকারীদের শনাক্ত করে গ্রেফতার করার কথা বলেছিলেন। কিন্তু ঘণ্টা, দিন, মাস, বছর অনেক সময় পার হয়ে গেছে। নওশের রোমান বলছিলেন, এক দশকেও তদন্তকারীরা নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারছে না। র‌্যাবকে প্রশ্ন করলে এককই জবাব পাওয়া যায় যে, তারা দেখছে, তদন্ত করছে।” তবে হত্যাকারীদের চিহ্নিত করা গেছে কিনা, বা কবে নাগাদ তদন্ত শেষ হতে পারে, এতবছর পরও এসব প্রশ্নের কোনো উত্তর মিলছে না।
সর্বশেষ গত ৩ ফেব্রুয়ারী বুধবার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের নির্ধারিত দিন ছিল। কিন্তু সেদিন মামলার দন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়ার দিন ধার্য থাকলে তা দেয়নি র‌্যাব। আগামী ১১ মার্চ তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার নতুন দিন ঠিক করে দেন আদালত। এ নিয়ে মামলার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়ার জন্য ৭৮ বার সময় দিলেন আদালত। ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতের ম্যাজিস্ট্রেট দেবদাস চন্দ্র অধিকারী এই দিন ঠিক করেন।
সব মিলিয়ে এ মামলায় আট সন্দেহভাজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাঁরা হলেন রফিকুল ইসলাম, বকুল মিয়া, মো. সাইদ, মিন্টু, কামরুল হাসান ওরফে অরুণ, সাগর-রুনির ভাড়া বাসার নিরাপত্তাপ্রহরী এনামুল, পলাশ রুদ্র পাল এবং নিহত দম্পতির বন্ধু তানভীর রহমান। তাঁদের মধ্যে প্রথম পাঁচজনই মহাখালীর বক্ষব্যাধি হাসপাতালের চিকিৎসক নারায়ণ চন্দ্র হত্যার ঘটনায় র‌্যাব ও গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) হাতে গ্রেপ্তার হন। প্রথম পাঁচজন ও নিরাপত্তারক্ষী এনামুল এখনো এই মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে আছেন। বাকি দুজন জামিনে আছেন।
এর আগে গত বছরের ২৯ ডিসেম্বর মঙ্গলবার সাগর ও রুনি হত্যা মামলার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ায় তারিখ ছিল। সেদিনও জমা দিতে না পারায় ৭৭ বারের মতো পিছিয়ে  তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য চলতি মাসের ৩ ফেব্রুয়ারি দিন ধার্য করেছিল আদালত। সেদিন ঢাকা ম্যাট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আবু সাঈদ নতুন এ দিন ধার্য করেন।
তদন্ত যত পেছায় তত খুশি হয় খুনিরা
‘র‌্যাব-পুলিশ চাইলে সব পারে’, এ কথা সাগর-রুনির হত্যাকারীদের খুঁজে বের করার বেলায় খাটেনি। এক দশকেও  চাঞ্চল্যকর একটি মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের সময় এভাবে পেছানোর নজির নেই। বিচারের দীর্ঘসূত্রতা হয় নানা কারণে, কিন্তু তদন্তের এই দীর্ঘসূত্রতা অনেকটাই নজিরবিহীন। মামলাটি যে ‘নো ক্লু, আইও ফজলু’এমন পরিস্থিতির দিকে এগোচ্ছে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। তদন্তে ঘটনার সূত্র বা জড়িত ব্যক্তিদের খুঁজে না পেলে কিছুটা ব্যঙ্গ করে এটা বলা হয়।
তদন্তের ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ব্যর্থতার অন্যতম উদাহরণ হয়ে রইল সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যা মামলা। এ নিয়ে নিহত দুজনের পরিবার ও স্বজনেরা ক্ষুব্ধ ও ব্যথিত। দুই সাংবাদিকের বয়স্ক মায়েদের চোখের পানি শুকিয়ে এসেছে, তাঁরা এখন জীবনসায়াহ্নে।
মামলাটি ঘিরে দেশজুড়ে মানুষের আগ্রহও রয়েছে। সাংবাদিক পরিচয় পেলে অনেকেই জানতে চান, ওই মামলার অগ্রগতি কত দূর, আসলে কারা জড়িত? সাধারণ মানুষ বা স্বজনদের আগ্রহ থাকলেও সরকার, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এমনকি সাংবাদিকদের আগ্রহ বা আন্তরিকতা অনেকটাই কমে গেছে। সাংবাদিক ইউনিয়ন বা ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির অগ্রাধিকার তালিকায় বিষয়টি আর আছে বলে এখন মনে হয় না। অর্থাৎ এ ঘটনার বিচারের জন্য বাইরের কোনো চাপ সেই অর্থে নেই।
ঢাকার চাঞ্চল্যকর সগিরা মোর্শেদ খুনের মামলার প্রকৃত রহস্য উদ্ঘাটিত হয়েছে-যা ঘটেছিল ৩০ বছর আগে। জঙ্গিবিরোধী বেশির ভাগ অভিযান নিখুঁতভাবে সম্পন্ন হয়েছে।
ঘটনাস্থলে গিয়ে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন বলেছিলেন, ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে হত্যার রহস্য উদ্ঘাটন করা হবে। ২০১২ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়েই মহীউদ্দীন খান আলমগীর ১০ অক্টোবরের মধ্যে সাগর-রুনির হত্যারহস্য উদঘাটিত হবে বলে আশা প্রকাশ করেছিলেন। এরপর ৯ অক্টোবর ‘চমক দেয়া’ সংবাদ সম্মেলনে একজনকে ধরতে ১০ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেন। পরে সেই ব্যক্তিকে ধরা হয়, কিন্তু ঘটনার রহস্য আর উন্মোচিত হয়নি।
সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের পর প্রথমে রাজধানীর শেরেবাংলা নগর থানার পুলিশ ও পরে গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) এই মামলার তদন্তভার পায়। দায়িত্ব পাওয়ার ৬২ দিনের মাথায় ২০১২ সালের ১৮ এপ্রিল হাইকোর্টে ব্যর্থতা স্বীকার করে ডিবি। এরপর আদালত র‌্যাবকে মামলার তদন্তের নির্দেশ দেন। সেই থেকে র‌্যাব মামলাটি তদন্ত করছে।
এটা বিশ্বাস করতে চাই না যে সাগর-রুনি হত্যায় জড়িত খুনিদের খুঁজে পাওয়া অসম্ভব। অত্যাধুনিক প্রযুক্তির যুগে কোনো ঘটনাই আড়াল করে রাখা যায় না। জঙ্গিবাদ দমনে সরকারের সদিচ্ছা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকার পাশাপাশি প্রযুক্তিই কিন্তু পথ দেখিয়েছে। সেই সদিচ্ছা ও প্রযুক্তির সমন্বয়ে সাগর-রুনি হত্যার তদন্তও দ্রুত শেষ হবে-এটাই ওই দুই ভুক্তভোগী পরিবারের প্রত্যাশা।

Please follow and like us:

Check Also

ইসরায়েলের অনুরোধে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের জরুরি বৈঠক

ইরান থেকে ইসরাইলের উদ্দেশ্যে শতাধিক ড্রোন ও ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়া হয়েছে। এসব প্রতিহত করতে ইসরাইলের …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।