শ্রমিক অধিকার ও মালিক-শ্রমিক সম্পর্ক : ২য় পর্ব

শ্রমজীবী মানুষের অধিকার ও মর্যাদা সমুন্নত রাখতে বিশ্বনবী (স.)-ই সর্বপ্রথম মানবিক শ্রমের নীতি ও আইন প্রনয়ন করেন। ইসলাম মালিকের কাঁধে যেসব বাধ্যবাধকতা আরোপ করেছে তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো শ্রমের মূল্য বা মজুরি। পবিত্র কুরআনে কমপক্ষে দেড় শ’ স্থানে ‘আজর’ তথা শ্রমের মূল্য বা বিনিময় শব্দটি উল্লেখ করা হয়েছে। শ্রমের এই পবিত্র দৃষ্টিভঙ্গির ভিত্তিতে ইসলাম শ্রমিকের মজুরি বা পারিশ্রমিককেও পবিত্র ঘোষণা করে, উদ্বুদ্ধ করে যাতে সব শ্রমিককে তার পারিশ্রমিক দেয়া হয়। সবই কর্মজীবনে পারস্পরিক বিনিময়ের অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন সূরা কাসাসে হজরত মূসা (আ:)-এর ঘটনা বর্ণনায় বলা হয়েছে ‘অতঃপর নারীদ্বয়ের একজন তার কাছে এসে বললেন, আমার বাবা আপনাকে ডাকছেন, যেন তিনি আপনাকে পশুগুলোকে পানি পান করানোর বিনিময়ে পারিশ্রমিক দিতে পারেন।’

রাসূল (স.) পারিশ্রমিক নির্ধারণ ছাড়া শ্রমিক নির্বাচন করে শ্রমিকের কাছ থেকে কাজ আদায় করতে নিষেধ করেছেন। কাজের আগে মালিক-শ্রমিকের সাথে চুক্তি করে, সেই চুক্তির আওতায় শ্রমিক কাজ করে, বিনিময়ে মালিক তাকে মজুরি দেয়। এখানে মালিক ও শ্রমিক পরিপূর্ণভাবে চুক্তি বাস্তবায়নে সচেষ্ট থাকবে। শ্রমিক নিজের ওপর মালিকের দায়িত্ব নিয়ে এমন এক নৈতিক চুক্তিতে আবদ্ধ হয় যে, এ কাজ সে অর্থ উপার্জনের জন্য করে না, বরং এর সাথে পরকালের সফলতা জড়িত বলে মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে। চুক্তি পূর্ণ করার ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তোমরা প্রতিশ্রুতি পূর্ণ করো। নিশ্চয়ই প্রতিশ্রুতি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে’ (আল কুরআন; ২৮ : ২১৬, ৫ : ১)। শ্রমিকের দায়িত্ব চুক্তি মোতাবেক মালিকের প্রদত্ত কাজ অত্যন্ত নিষ্ঠা ও বিশ্বস্ততার সাথে সম্পাদনা করা। রাসূল সা: বলেন ‘ধনী ব্যক্তির পক্ষ থেকে কারো পাওনা প্রদানে টালবাহানা করা জুলুম, আর যখন তোমাদেরকে কোনো সক্ষম ব্যক্তির প্রতি ন্যস্ত করা হয় তখন সে যেন তা অনুসরণ করে’ (বুখারি : হা/২২৮৭)। অন্য হাদিসে এসেছে- মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘কিয়ামতের দিন আমি তিন ব্যক্তির বিপক্ষে থাকব তার মধ্যে একজন হচ্ছে ওই ব্যক্তি যে কাউকে কর্মচারী হিসেবে নিয়োগ করার পর তার থেকে কাজ বুঝিয়ে নিয়েছে অথচ তার প্রাপ্য দেয়নি’ (বুখারি : হা/২২২৭)।

হজরত আবু হুরাইরা (রা:) থেকে বর্ণিত রাসূল সা: বলেন, ‘তোমাদের অধীনস্থ ব্যক্তিরা দাস-দাসী, শ্রমিক, কর্মচারীরা তোমাদের ভাই। সুতরাং আল্লাহ যে ভাইকে যে ভাইয়ের অধীন করে দিয়েছেন সে তার (শ্রমিকের) ভাইকে যেন তাই খাওয়ান যা সে নিজে আহার করেন, আর তাই পরিধান করান যা সে নিজে পরিধান করেন’ (আবু দাউদ ২/৩৩৭)। আল্লাহ বলেন, ‘মুমিনরা পরস্পর ভাই ভাই। অতএব ভাইয়ের সাথে সর্বদাই সদ্ভাব স্থাপন করবে’ (আল কুরআন; ৪৯:১০)। মালিক-শ্রমিক কর্মচারীদের এমন সব আচরণ করতে নিষেধ করা হয়েছে যা দ্বারা সম্পর্কের অবনতি ঘটতে পারে। এমন ভ্রাতৃত্বপূর্ণ সম্পর্ক একটি সুস্থ ও সভ্যসমাজ ব্যবস্থার পূর্বশর্ত।

ইসলামের আলোকে শ্রমনীতি হলো-

ক. মালিক-শ্রমিক পরস্পরকে ভাই ভাই মনে করবে।

খ. মৌলিক মানবিক প্রয়োজনের ক্ষেত্রে শ্রমিক ও মালিক উভয়ের মান সমান হবে।

গ. কাজে নিযুক্তির আগে শ্রমিকদের সাথে যথারীতি চুক্তি হবে এবং তা যথাসময়ে পালিত হবে।

ঘ. শ্রমিকের অসাধ্য কাজ তার ওপর চাপানো যাবে না।

ঙ. শ্রমিকের স্বাস্থ্য, শক্তি ও সজীবতা বজায় রাখার জন্য ন্যূনতম প্রয়োজনীয় ব্যয়ের নিচে মজুরি নির্ধারণ হবে না।

চ. উৎপন্ন দ্রব্যের অংশবিশেষ শ্রমিকদের দান করতে হবে।

ছ. পেশা বা কাজ নির্বাচনের ও মজুরির পরিমাণ বা হার নির্ধারণ সম্পর্কে দর দস্তুর করার পূর্ণ স্বাধীনতা শ্রমিকের থাকবে।

জ. অনিবার্য কারণ বা নিয়ন্ত্রণ ঘটনার বহির্ভূত ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে কাজে কোনো ত্রুটি-বিচ্যুতি ঘটলে শ্রমিকদের ওপর নির্যাতন না চালানো।

ঝ. মালিকপক্ষ দুর্ঘটনা ও ক্ষয় এড়ানোর সব ধরনের প্রস্তুতি গ্রহণ করবে।

ঞ. কোনো অবস্থাতেই শ্রমিকদের অসহায় করে ছেড়ে দেয়া যাবে না, অক্ষম ও বৃদ্ধ হয়ে পড়লে উপযুক্ত ভাতার ব্যবস্থা করা।

ট. পেশা পরিবর্তনের অধিকার শ্রমিকের থাকবে।

ঠ. পরিবার গঠনের অধিকার শ্রমিকের থাকবে।

ড. স্বাধীনভাবে ধর্মীয় অনুশাসন পালনের অধিকার শ্রমিকের থাকবে।

ঢ. স্থানান্তর/ গমন/ ছুটি নেয়ার অধিকার শ্রমিকের থাকবে।

ন. শ্রমিকের স্বাস্থ্য সংরক্ষণ ও চিকিৎসার উপযুক্ত সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে।

অর্থনৈতিক মুক্তির মাধ্যমে সামাজিক শান্তি ও রাষ্ট্রীয় সমৃদ্ধি তখনি কেবল সম্ভব হবে যখন শ্রমিকের প্রতি ইসলামের উদার দৃষ্টিভঙ্গি বাস্তবে রূপায়িত হবে। কারণ, ইসলামে শ্রম যদি হয় ব্যক্তির দায়িত্ব, তবে রাষ্ট্রের দায়িত্ব প্রতিটি ব্যক্তির জন্য কর্মের সংস্থান করা। ব্যক্তির যদি দায়িত্ব হয় কাজে নিষ্ঠার পরিচয় দেয়া, তবে রাষ্ট্রের দায়িত্ব সম্পদ ও মালিকানায় সুষম বণ্টন করা। কাজ যদি হয় উৎপাদনের প্রধান স্তম্ভ, তবে রাষ্ট্রের দায়িত্ব মানবসম্পদের উন্নয়ন ঘটানো। শ্রমিক যদি হয় প্রকৃত সম্পদ, তবে রাষ্ট্রের দায়িত্ব খেটে খাওয়া লোকগুলোর ওপর চলমান জুলুম বন্ধ করা। তাদের অধিকার আদায় নিশ্চিত করা। শ্রমিক যদি হয় খেটে খাওয়া শ্রেণী, তাহলে রাষ্ট্রের দায়িত্ব তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। ইসলাম মানুষের কাজ করার অধিকারের সাথে সাথে শ্রমিকের মর্যাদাকেও স্বীকৃতি দেয়। ইসলাম মালিক-শ্রমিক সম্পর্কের যে নীতিমালা দিয়েছে উভয়েই যদি তা অনুসরণ করে তাহলে পৃথিবীতে বঞ্চিতদের আর্তনাদ শোনা যাবে না, শ্রমিক অসন্তোষও দেখা দেবে না। পৃথিবী হয়ে উঠবে একটি শান্তির আবাসস্থল।

লেখক : বিলাল মাহীনি, প্রভাষক : গাজীপুর রউফিয়া কামিল মাদরাসা, অভয়নগর, যশোর।

  প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী সম্পাদক : সিংগাড়ী আঞ্চলিক গণগ্রন্থাগার ও ভৈরব সংস্কৃতি কেন্দ্র, অভয়নগর, যশোর।

  আজীবন সদস্য : নওয়াপাড়া ইনস্টিটিউট।

Check Also

বেড়িবাঁধ কেটে নোনাপানি ঢুকিয়ে ঘের ব্যবসা

সুন্দরবন–সংলগ্ন খুলনার কয়রা উপজেলায় যত্রতত্র বেড়িবাঁধ কেটে ও ছিদ্র করে পাইপ দিয়ে নোনাপানি উঠিয়ে চলছে …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।