পবিত্র লাইলাতুল কদরের আমল ফজিলত গুরুত্ব ও তাৎপর্য

লাইলাতুল কদর বা ভাগ্য নির্ধারণ রাত্রি মুসলিম জীবনে অতিপূণ্যময় ও অনন্য রজনী। এ রাতের সম্মানেই পবিত্র কুরাআনে একটি পূর্ণাঙ্গ সূরা ‘সূরাতুল কদর’ অবতীর্ণ হয়েছে। সম্মান বা মর্যাদার এ রাতটিতে রয়েছে শান্তি, সান্তনা এবং সার্বিক কল্যাণ। এ রজনী ভাস্বর হয়ে আছে পবিত্র কুরআন নাজিলের মহিমায়, ভাস্বর হয়ে থাকবে স্বল্প সময়ে অধিক পূণ্য (সওয়াব) লাভের নিশ্চয়তায়।
আমাদের সমাজে ১৪শাবান দিবগত রাতকে ‘লাইলাতুল বরাত’ ‘শবে বরাত’ বা ভাগ্য রজনী বলা হয়ে থাকে। যেটি ভুল ধারণা। প্রকৃতপক্ষে লাইলাতুল কদর-ই মূলত ভাগ্য রজনী। আরবি ‘লাইলাতুন’ শব্দের অর্থ হচ্ছে রাত। ‘কদর’ শব্দের অর্থ হচ্ছে পরিমাপ, পরিমাণ, নির্ধারণ ও ভাগ্য নিরূপণ। ‘কদর’ থেকেই ‘তাকদির’ শব্দের উৎপত্তি। অবশ্য কদর শব্দের অন্য অর্থ সম্মান, গৌরব, মর্যাদা ও মহিমা। সুতরাং ‘লাইলাতুল কদর’ মহিমান্বিত রজনী, সম্মানিত রাত্রি, ভাগ্য নিরূপণ, বিশ্ব নিয়ন্ত্রণ রজনী অর্থে সাধারণত ব্যবহৃত হয়ে থাকে। হজরত আবু বকর রা. বর্ণনা করেন, ‘এ রাতকে এ জন্য ‘লাইলাতুল কদর’ বলা হয়, যে ব্যক্তি ইতোপূর্বে কোনো ইবাদত-বন্দেগি করে ‘কদর’ বা সম্মানের অধিকারী হয়নি, সে ব্যক্তি এ রাতে তওবা ইস্তেগফার করে ইবাদত-বন্দেগি করলে ‘কদর’ বা সম্মানের অধিকারী হতে পারবে।’
কদরের রাতটি কিন্তু নির্ধারিত বা নির্দিষ্ট নয়। এ মহিমান্বিত রাতটি পবিত্র রমজানের শেষ দশ দিনের যে কোনো বিজোড় রাত। তবে এ রাতকে চিহ্নিত করার কিছু আলামত হাদিস শরিফে (বুখারী ও মুসলিম) পাওয়া যায়। যেমন- ০১. রাতটি গভীর অন্ধকারে ছেয়ে যাবে না; ০২. নাতিশীতোষ্ণ হবে; ০৩. মৃদুমন্দ বাতাস প্রবাহিত হতে থাকবে; ০৪. ইবাদতে অধিক তৃপ্তি পাবে; ০৫. বৃষ্টি বর্ষণ হতে পারে; ০৬. হালকা আলোকরশ্মিসহ সূর্যোদয় হবে, যা হবে পূর্ণিমার চাঁদের মতো।
হযরত ইবনে জারির রা.-এর বর্ণনায় আছে, মহানবী সা: একবার ইসরাইল গোত্রের জনৈক ইবাদতকারী সম্পর্কে আলোচনা প্রসঙ্গে বলেছিলেন, তিনি (ইসরাইলী ব্যক্তি) একাধারে এক হাজার মাস ধরে সমস্ত রাত্রি ইবাদতে মশগুল থাকতেন এবং সকাল হলেই জেহাদে বের হয়ে যেতেন। মুসলমানগণ একথা শুনে বিস্মিত হন। মহানবী সা. তাঁর উম্মতের জন্য শুধু এক রাত্রির ইবাদতকেই (লাইলাতুল কদর) সে ইবাদতকারীর এক হাজার মাসের ইবাদত অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ প্রতিপন্ন করেছেন। (তাফসিরে মাজহারি) যার বর্ণনা সুরা আল-কদরে সুস্পষ্টভাবে পাওয়া যায়। মহান আল্লাহ কদরের রাতকে হাজার মাস অপেক্ষা অধিক উত্তম হিসেবে উল্লেখ করেছেন। অর্থাৎ এক হাজার মাস মহান আল্লাহর ইবাদত করার চেয়েও এই একটি রাত ইবাদত করলে অনেক বেশি সওয়াব পাওয়া যাবে।
এ রাতে হজরত জিবরাইল আ. অসংখ্য ফেরেশতা নিয়ে এ ধরাপৃষ্ঠে অবতরণ করেন। তিনি যাদের দ-ায়মান এবং বসা অবস্থায় নামাজ ও মহান আল্লাহর জিকির ও কুরআন তিলাওয়াতরত দেখতে পান, তাদের জন্য রহমতের দোয়া করেন।
পবিত্র কুরআনের সুস্পষ্ট বর্ণনায় লাইলাতুল কদর রমজান মাসেই। তবে কবে? এ নিয়ে আলেমদের একাধিক মতামত পরিলক্ষিত হয়। তাফসিরে মাজহারির বর্ণনা মতে, ‘এ রাত রমজান মাসের শেষ ১০ দিনের মধ্যে অবস্থিত। কিন্তু এরও কোনো নির্দিষ্ট তারিখ নেই। সহিহ হাদিস দৃষ্টে এই ১০ দিনের বেজোড় রাতগুলোতে ‘লাইলাতুল কদর’ হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। মহানবী সা: বলেছেন, ‘লাইলাতুল কদরকে রমজানের শেষ ১০ দিনের বেজোড় রাতগুলোতে তালাশ করো’। (সহীহ বুখারি)
মহান আল্লাহ তাঁর প্রিয় বান্দাদের রমজানের শেষ ১০ দিন অধিক পরিমাণে ইবাদত করার প্রতি আকৃষ্ট করার জন্যই মূলত লাইলাতুল কদরকে প্রচ্ছন্ন রেখেছেন। তারপরও অধিক সম্ভাব্য রাত হিসেবে ২৭তম রাতকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। তাফসিরে রুহুল বায়ানে উল্লেখ রয়েছে, হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. গণিত সূত্র দিয়ে এর অধিক সম্ভাব্যতা প্রমাণ করেছেন। যেমন- ‘সূরা কদর’-এ ‘লাইলাতুল কদর’ শব্দটি তিনবার উল্লেখ আছে। আরবি বর্ণমালা অনুযায়ী ‘লাইলাতুল কদর’ লিখতে ৯টি অক্ষরের প্রয়োজন হয়। তিন কে ৯-এর সাথে গুণ করলে গুণফল ২৭ হয়। উপরোক্ত হিসেবে ‘লাইলাতুল কদর’ রমজানের ২৭ তারিখ হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি’।
লাইলাতুল কদর অনির্দিষ্ট রাখার তাৎপর্য : কদরের পবিত্র রজনীকে অনির্দিষ্ট রাখার মধ্যে অসংখ্য তাৎপর্য রয়েছে। যেমন-
০১. প্রতিটি বেজোড় রাতে অধিক পরিমাণে ইবাদাত করে বান্দা যাতে মহান আল্লাহর সান্নিধ্য লাভে ধন্য হয়;
০২.পাপীগণ এ রাতের গুরুত্ব উপলব্ধি করে পাপকাজ থেকে বিরত থাকবে এবং সঠিক পথে আসার অনুপ্রেরণা পাবে;
০৩. নির্দিষ্ট হলে কেউ দূর্ভাগ্যবশত এ রাত হারিয়ে ফেললে সে অত্যন্ত মনকষ্টে নিপতিত হতে পারে;
০৪. যত রাতই লাইলাতুল কদর মনে করে ইবাদত করবে প্রত্যেক রাতের জন্য পৃথক পৃথক সওয়াব পাবে;
০৫. বছরের বাকি রাতগুলোতে সুযোগ পেলেই যাতে ইবাদতে কাটানো যায় তার একটি প্রশিক্ষণ দানের জন্য।
লাইলাতুল ক্বদরের আমল :
মহানবী সা. যেভাবে এ রাত কাটাতেন এর পূর্ণ অনুসরণ করাই হবে আমাদের প্রধান লক্ষ্য। এ লক্ষ্যে আমাদের বর্ণিত কাজগুলো করা আবশ্যক। ০১. নিজে রাত জেগে ইবাদাত করা এবং পরিবারের সদস্য ও অধীনস্থদের ইবাদাতে উদ্বুদ্ধ করা;  ০২. তারাবিহের সালাত আদায়ের পর রাতে তাহাজ্জুদ ও সালাতুত তাসবিহ আদায় করা;  ০৩ সিজদার মধ্যে তাসবিহ পাঠ শেষে দোয়া করা। কেননা সেজদাবনত অবস্থায় মানুষ তাঁর রবের নিকটে চলে যায়। ফলে তখন দোয়া কবুল হয়; ০৪. নিজের কৃত পাপের জন্য বেশি বেশি তওবা করা। ভবিষ্যতে যাতে আর কোনো পাপ না হয় তার জন্য দৃঢ় সঙ্কল্প করা; ০৫. অধিক পরিমাণে কুরআন তিলাওয়াত করা। উত্তম হবে অর্থ ও ব্যাখ্যাসহ কুরআন অধ্যয়ন করা; ০৬. সাধ্য অনুযায়ী জিকির-আসকার ও তসবিহ তাহলিল আদায় করা; ০৭. কবুল হওয়ার প্রত্যাশা নিয়ে নিজ, পরিবার-পরিজন, আত্মীয়-স্বজন, জীবিত-মৃত ব্যক্তিদের জন্য সর্বোপরি দেশ ও বিশ্ববাসীর শান্তি-সমৃদ্ধি কামনা করে একাগ্রচিত্তে দোয়া করা। বিশেষ করে মহানবী সা:-এর শেখানো এই দোয়াটি বেশি বেশি করে পড়া, ‘হে আল্লাহ তুমি অত্যন্ত ক্ষমাশীল, ক্ষমাকে তুমি ভালোবাস, অতএব আমাকে ক্ষমা করে দাও’।
লাইলাতুল কদরের ফজিলত :
অগণিত ফজিলতে পূর্ণ এ রাতটির কতিপয় ফজিলাত বর্ণনা করা হলোÑ
০১.এ রাতের ফজিলাত বর্ণনা করে এ রাতেই একটি পূর্ণাঙ্গ সূরা অবতীর্ণ হয়েছে, যার নাম ‘সূরাতুল কদর’;
০২. এ এক রজনীর ইবাদাত হাজার মাসের ইবাদাতের চেয়েও উত্তম;
০৩. এ রাতে পৃথিবীতে অসংখ্য ফেরেশতা নেমে আসে এবং তারা তখন দুনিয়ায় কল্যাণ, বরকত ও রহমত বর্ষণ করতে থাকেন;
০৪. এ রাতে ইবাদতে লিপ্ত বান্দাদের ফেরেশতাগণ জাহান্নামের আজাব থেকে মুক্তির বাণী শোনান;
০৫. এ রাতে নফল সালাত আদায় করলে মুমিনদের অতীতের সগিরা গুনাহ মাফ করে দেয়া হয়।

মহানবী সা: বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে ও সওয়াব লাভের আশায় কদরের রাতে নফল সালাত আদায় ও রাত জেগে ইবাদত করে আল্লাহ তার ইতঃপূর্বের যাবতীয় সগিরা গোনাহ ক্ষমা করে দেন’ । (বুখারি, মুসলিম) এছাড়াও, এ রাতে তওবা কবুল হয়।
লাইলাতুল কদর প্রাপ্তির উত্তম মাধ্যম : লাইলাতুল কদর প্রাপ্তির সুবর্ণ সুযোগ হচ্ছে রমজানের শেষ দশ দিন ইতেকাফের নিয়তে মসজিদে অবস্থান করা। মহানবী সা. প্রতি রমজানে ১০ দিন নিয়মিত ইতেকাফ করতেন।

মুমিন বান্দাদের জন্য লাইলাতুল কদর অত্যন্ত মঙ্গলময় এবং বরকতময় রাত। এক রাত ইবাদত করে এক হাজার মাসেরও অধিক সময়ের ইবাদতের সাওয়াব পাওয়া যাবে, এর চেয়ে বড় সুবর্ণ সুযোগ আর কী হতে পারে? এ রাতের ইবাদত হতে বিমুখ ব্যক্তি সত্যিই হতভাগা। মহানবী সা: বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি শবে কদর থেকে বঞ্চিত হয়েছে, সে ব্যক্তি সর্ব প্রকার মঙ্গল থেকেই বঞ্চিত হলো। আর যে বঞ্চিত হলো প্রকৃতপক্ষে সে সকল কল্যাণ থেকেই বঞ্চিত হলো’। (সুনানু নাসায়ি) তাই আসুন, পবিত্র লাইলাতুল কদরের ফজিলত ও বরকতের অমিয় সুধা পান করে আল্লাহর কাছে উত্তম বান্দা হিসেবে ফিরে যাই। (আমিন)
লেখক :প্রভাষক বিলাল মাহিনী
পরীক্ষক : ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা ও প্রভাষক : গাজীপুর রউফিয়া কামিল মাদরাসা
প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী সম্পাদক : সিংগাড়ী আঞ্চলিক গণ-গ্রন্থাগার ও ভৈরব সংস্কৃতি কেন্দ্র,
জীবন সদস্য : নওয়াপাড়া ইনস্টিটিউট, অভয়নগর, যশোর।

Check Also

শিকড়ের সন্ধানে : হজরত নূহ আ.-এর জ্যেষ্ঠপুত্রের বাংলাদেশ

॥ হারুন ইবনে শাহাদাত ॥ আমাদের প্রিয় জন্মভূমি বাংলাদেশের সাথে ঐতিহাসিকভাবে জড়িয়ে আছে হজরত নূহ …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।