লবনাক্ততা বৃদ্ধির কারণে সুন্দরবনে আশংকাজনকহারে হরিণ মারা যাচ্ছে

সামিউল মনির : বিশে^র বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশে হঠাৎ করেই আশংকাজনকহারে চিত্রল হরিণ মারা যাচ্ছে বলে দাবি করেছে বনজীবিরা। বনবিভাগের অনুমতি নিয়ে মাছ, কাঁকড়া শিকারসহ মধু সংগ্রহের কাজে যেয়ে তারা সুন্দরবনের বিভিন্ন অংশে এসব মরা হরিণের দেখা পেয়েছে।

কোন কোন স্থানে শুধুমাত্র হরিণের হাড় গোড় ও মাথা পড়ে থাকতে দেখা গেলেও অনেক জায়গাতে তারা সদ্য মরা হরিণও আবিস্কার করেছে। এমনকি বিভিন্ন স্থানে জীবিত হরিণগুলোকে অসুস্থ ও কংকালসার অবস্থায় দেখতে পাওয়ার দাবি তাদের।

যদিও বনবিভাগ জানিয়েছে এমন একটি সংবাদ শোনার পর সম্প্রতি তারা সুন্দরবনে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করেও দাবির পক্ষে কোন প্রমান পায়নি। তবে প্রত্যক্ষদর্শীরা বনবিভাগকে উপযুক্ত তথ্য দিয়ে সহায়তা করলে বিষয়টি নিয়ে অধিকতর অনুসন্ধান চালানো সহজ হবে।

লবনাক্ততা বৃদ্ধির পাশাপাশি লতা-পাতা পড়ে বিষক্রিয়ার সৃষ্টি হওয়া আবদ্ধ পানি পানের কারনে হরিণগুলো মারা যাচ্ছে বলে নিজস্ব ধারণার কথা শোনান বনজীবিরা। তবে কিছু স্থানে খাদ্য সংকটে ভুগতে থাকা অসুস্থ হরিণগুলো মশা ও ডাস কাটাশি এর তীব্র আক্রমনের শিকার হচ্ছে বলেও জানান এসব বনজীবি।

শ্যামনগর উপজেলার গাবুরা, বুড়িগোয়ালীনিসহ কয়রা উপজেলার কয়রাসহ বিভিন্ন অংশের অসংখ্য বনজীবির সাথে কথা বলে সুন্দরবনে হরিণ মারা যাওয়ার ব্যাপারে এমন স্পষ্ট ধারণা মিলেছে। হরিণ মারা যাওয়ার ঘটনা খুলনা রেঞ্জে বেশী হলেও সাতক্ষীরা রেঞ্জের কয়েকটি স্থানেও তারা মৃত হরিণের অস্থিত্ত্ব প্রত্যক্ষ করেছেন বলেও দাবি করেন।

প্রত্যক্ষদর্শী এসব বনজীবি জানায় পাতকোষ্টা, কাগার ঝেলে, হংস রাজসহ সুন্দরবনের বিভিন্ন অংশে তারা বেশিরভাগ মৃত হরিণ দেখতে পেয়েছে। এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহে সুন্দরবনে প্রবেশের পর থেকে তারা এমন অবস্থা প্রত্যক্ষ করেছেন বলেও দাবি করেন।

মধু সংগ্রহ করতে যাওয়া গাবুরার মোঃ জিন্নাত আলী জানান, নয় সদস্যের দলটি গভীর সুন্দরবনে প্রবেশের পর পাতকোষ্টা এলাকায় তাড়কেল (গুইসাপ) ও শুকর মিলে একটি হরিণকে তারা খেতে দেখে। পরবর্তীতে ছাটা দিয়ে যাওয়ার এক পর্যায়ে আরও প্রায় এক কিলোমটিার দুরে পৌছে মশা-মাছি বেষ্ঠিত অবস্থায় সদ্য মরা আরও একটি হরিণকে আবিস্কার করে দলটি। তার সহযোগী মৌয়াল একই গ্রামের মোঃ মুসা, বিল্লাল হোসেন ও আলআমিনসহ অন্যরা হরিণ মরার সত্যতা নিশ্চিত করে জানান, নিজেদের পনের দিনের সুন্দরবনে অবস্থানের সময়ে ন্যুনতম ১১টি হরিণকে তারা মৃত অবস্থায় দেখে।

শ্যামনগর উপজেলার সোরা গ্রামের মোঃ তাইজুল ইসলাম ও আজিজুর রহমান জানান, এপ্রিলের তৃতীয় সপ্তাহে দ্বিতীয় মেয়াদের পাশ (অনুমতিপত্র) নিয়ে ভিন্ন দুই দলের হয়ে মধু সংগ্রহ করতে সুন্দরবনে যায় তারা। ছাটা দিয়ে এগিয়ে যাওয়ার সময়ে সাতক্ষীরা রেঞ্জ এর শেষ সীমায় পৌছে গেওয়াখালী এলাকায় স্বল্প দুরত্বের মধ্যে মধ্যে অন্তত আটটি হরিণকে মরে পড়ে থাকতে দেখেন তারা। এছাড়া পাতকোষ্টা আর হংস রাজ এলাকাতেও একাধিক মৃত হরিণ পড়ে থাকার দৃশ্য স্বচক্ষে অবলোকনের বিষয়টি নিশ্চিত করেন এ দুই বনজীবি।

কাঁকড়া শিকারের জন্য পাশ (অনুমতি পত্র) নিয়ে সুন্দরবনে যাওয়া সোরা গ্রামের আব্দুর রহিমের ছেলে মোফাজ্জল হোসেন জানায় অভিন্ন কথা। তিনি বলেন, কাগা দোবেঁকী এলাকাতে অন্য জেলেদের সাথে তিনিও মরা হরিণের দেখা পেয়েছে। এসময় মৃত হরিণটি কংকালসার অবস্থায় পড়ে ছিল জানিয়ে তিনি আরও বলেন, শুকর বা অন্য কিছুতে না খাওয়া ঐ হরিণের চামড়া শুকিয়ে শরীরের সাথে লেপ্টে যাওয়ার মত অবস্থায় দেখতে পান তারা।

তিপ্পান্ন বছরের বন-বাদার জীবনে এভাবে হরিণ মরার দৃশ্য দেখেনি- উল্লেখ করে কয়রা উপজেলার ৪ নং কয়রা গ্রামের হযরত আলী সানা জানান, হরিণের এসব মৃত্যু স্বাভাবিক না। ‘বাঘে খেলে এভাবে হরিণ মরে পড়ে থাকার কথা না- জানিয়ে তিনি আরও বলেন পানি সমস্যার কারনে হরিনগুলো দেদারছে মরছে বলে আমাদের মনে হচ্ছে।

মধু সংগ্রহ করে ফিরে আসা ফারুক হোসেন নামের এক বনজীবি বলেন, গত শুক্রবার বিকালে আমরা ছয় সদস্যের দলটি বাড়িতে ফিরিছি। শিবসা, বাটুলিয়া, চামটা, সোনামুগুর ও আন্ধার মানিক এলাকায় মধু কাটার সময়ে নিজের চোখে আমরা ছয় সদস্যের দলটি অন্তত বিশটা মরা হরিণ দেখিছি। তিনি আরও বলেন, হরিণগুলোকে অনেক বেশী দুর্বল অবস্থায় দেখা গেছে। তাদের সামনে পড়া এলাকায় পৌছালে মরা ঐসব হরিণের অবশিষ্ট অংশ দেখা যাবে বলেও তিনি নিশ্চিত করেন।

তবে শুধুমাত্র এসব মৌয়াল আর মাছ/কাঁকড়া শিকারী জেলে না। বরং সুন্দরবনে যাতায়াতকারী আরও অসংখ্য বনজীবি সেখানে আশংকাজনকহারে হরিণ মারা যাওয়ার অভিন্ন তথ্য দেন। তাদের দাবি আগের যেকোন সময়ের তুলনায় সুন্দরবন এলাকার পানি মারাত্বক লবনাক্ত হয়ে গেছে। আবার অনাবৃষ্টির সুযোগে আবদ্ধ জায়গার পানি লতাপাতা পড়ে মারাত্বক বিষাক্ত হয়ে গেছে। এসব পানি পানের কারনে হরিণগুলো দেদারছে মরছে বলে দাবি তাদের।

হযরত আলী সানা জানান, আগের বছর শিবসা ও পশুর নদীর পানি দিয়ে তারা ভাত রান্না করে খেয়েছেন। কিন্তু এবছর সে পানিতে তারা গোসল পর্যন্ত করতে পারেনি। সুন্দরবনের অনেক স্থানের পানি শরীরে লাগলে তীব্র জ¦ালা যন্ত্রনার শিকার হওয়ার তথ্য দিয়ে বনজীবি তাইজুল ইসলাম বলেন, কোন কোন খালের পাশে হরিণ মরে থাকতে দেখা গেছে।

বিষাক্ত পানি খেয়ে তাদের মৃত্যু হয়ে থাকতে পারে জানিয়ে তিনি আরও বলেন, লবনাক্ততা বেড়ে যাওয়ার সাথে সাথে দীর্ঘ দিনের অনাবৃষ্টির সুযোগে পাতা পড়ে বিষাক্ত হয়ে গেছে অধিকাংশ জায়গার পানি। এছাড়া যে কোন কারনে তারা ঐসব এলাকায় বিচরণরত হরিণগুলোতে শাররীকভাবে মারাত্মক দুর্বল এবং ভাঙা স্বাস্থ্যের বলে দেখার বিষয়টি তিনিসহ অন্যরাও নিশ্চিত করেন।

হরিণ মারা যাওয়ার বিষয়ে শ্যামনগর উপজেলা প্রাণী সম্পদ অধিদপ্তরের ভেটোনারী সার্জন ডাক্তার জহিরুল ইসলাম জানান, বিষয়টি একান্ত বনবিভাগের। প্রাকৃতিকভাবেই সুন্দরবনের এসব জীব-জানোয়ার নিজেদের টিকিয়ে রাখতে অভ্যস্থ। তবে সত্যি যদি হরিণ মারা যাওয়ার ঘটনা ঘটে থাকে তবে এসব দেহ নির্দিষ্ট ল্যাবে নিয়ে পরীক্ষা করলে প্রকৃত কারন জানা যাবে।

যদিও বছরের এসময় গাছ ও ঘাসে যে নুতন ডাল/পাতা বের হয় সেগুলোতে নাইট্রেট পয়জনিং হয়ে থাকে। তবে হরিণ সত্যি মরে থাকলে কি কারনে মরছে তা পরীক্ষা না করে বলা সম্ভব না।

খুলনা বিভাগীয় বন কর্মকর্তা ড. আবু নাসের মহসীন হোসেন জানান, হরিণ মারা যাওয়ার একটা সংবাদ শুনে বনকর্মীরা বিভিন্ন এলাকায় তল্লাসী করেও তার সত্যতা পায়নি। এমন মরা হরিণ পাওয়া গেলে পরীক্ষার পর তার মৃত্যুর কারন চিহ্নিত করা সম্ভব ছিল।

তিনি আরও বলেন, প্রতিটি বাঘের জন্য সাত দিনে একটি করে হরিণের প্রয়োজন হয়। শতাধিক বাঘের এ সুন্দরবনে বড় সংখ্যার একটি হরিণ বাঘের খাবার হিসেবে চলে যায়। মাংস খাওয়ার পর পড়ে থাকা হাড় ও মাথা কিংবা কংকাল প্রত্যক্ষ করে বনজীবিরা ভুল ধারনা পেতে পারে।

এছাড়া অজ¯্র গুইসাপ বসবাসের সুন্দরবনে যত্রতত্র হরিণ পড়ে থাকার কথা নয়, জানিয়ে তিনি আরও বলেন, হরিণ মারা গেলে তা গুই সাপের খেয়ে ফেলার কথা। তবে কোন বনজীবি তাদেরকে (বনবিভাগকে) নির্দিষ্ট করে মরা হরিণের সন্ধান দিতে পারলে বিষয়টির সত্যতা নিশ্চিতসহ তার মৃত্যুর কারন জানা সম্ভব হবে।

প্রকৃতিগতভাবে হরিণসহ বনের অন্য জীবরা এমন জলবায়ু ও আবহাওয়ার সাথে অভিযোজিত হয়ে গেছে জানিয়ে তিনি বলেন আনবৃষ্টি, বিষাক্ত পানি বা অন্য কারনে হরিণ মৃত্যর বিষয়টি যথার্থ নয়।

 

Please follow and like us:

Check Also

ইমাম ও মুয়াজ্জিন কল্যাণ ট্রাস্টের আওতায় সুদমুক্ত ঋণ বিতরণ

রাকিবুল ইসলাম, আলিপুর,২৩শে এপ্রিল ২০২৪:সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসন ও ইসলামিক ফাউন্ডেশন সাতক্ষীরার আয়োজনে ইমাম ও মুয়াজ্জিন …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।