ধ্বংসের পথে সম্ভাবনাময় পোল্ট্রি শিল্প : উদ্বিগ্ন খামারিরা, চাই প্রনোদনা ও গবেষণা

বিলাল মাহিনী,অভয়নগর,যশোরঃ

আশির দশকের প্রথম দিকে মাত্র দেড় হাজার কোটি টাকা নিয়ে যাত্রা শুরু করে দেশের সম্ভবনাময় পোল্ট্রি শিল্প। ধীরে ধীরে এই আজ সেটা প্রায় ৩৫ হাজার কোটি টাকায় পৌঁছেছে। কিন্তু সেই সম্ভবনাময় শিল্প টা আজ ধ্বংসের পথে। অতিরিক্ত হারে বাচ্চা  খাদ্যে ও ঔষধের দাম বৃদ্ধি হওয়ায় এ শিল্প থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে দেশের ছোট বড় অনেক খামারী।সর জমিনে খামারীদের কাছে যেয়ে শোনা যায় বেশি দামে বাচ্চা ও খাদ্য ক্রয় করে মুরগি পালন করে  বিক্রয়ের সময় তারা নায্য মূল্য পাচ্ছেনা।তাতে করে খামারীদের লোকসান গুনতে হচ্ছে। সম্ভবনাময় এই শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে দরকার সরকারের সঠিক পদক্ষেপ; পোল্ট্রি ফিপও বাচ্চার দাম নির্ধারণ করা।
অভিভাবকহীন আজ বাংলাদেশের পোল্ট্রি শিল্প। পোল্ট্রি শিল্প বন্ধ হয়ে গেলে বাংলাদেশকে একটি অপ্রত্যাশিত করুন পরিণতির মোকাবিলা করতে হবে। বর্তমানে যে বেহাল দশা চলছে তা আপন গতিতে চলতে থাকলে খুব শিঘ্রই অপ্রত্যাশিত সে অবস্থার সম্মুখীন হতে হবে আমার আপনার তথা গোটা দেশের। সময় এসেছে বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে এবং অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিবেচনা করে এ শিল্পকে যে কোন মূল্যে রক্ষা করার। দিন দিন লোকসানের ধাক্কা সহ্য করতে না পেরে একে একে অনেক খামারি তাদের খামার গুটিয়ে ফেলতে বাধ্য হচ্ছেন।
বাংলাদেশের আবহাওয়া পোল্ট্রি চাষের জন্য অনেক বেশি অনুকূল বা বন্ধুত্ব সুলভ। বহু বছর আগ থেকে এখানকার মানুষ বিভিন্ন ধরনের স্থানীয় জাতের পাখি পালন করে আসছে। ব্রিটিশ শাসনামলে ঢাকার তেজগাঁওয়, নারায়ণগঞ্জ ও সিলেটে পোল্ট্রি খামার তৈরি করা হয়েছিল। পরবর্তীতে পাকিস্তান সরকার ১৯৫৮ সালে চট্টগ্রামের পাহাড়তলী, সীতাকুন্ডু, বরিশাল, যশােহর, খুলনা, রাজশাহীতে পোল্ট্রি (হাঁস-মুরগির) খামার তৈরি করে। গাজীপুর ছাড়িয়ে পোল্ট্রি শিল্প এখন সারা বাংলাদেশে বিস্তার ঘটেছে। গ্রামীণ অর্থনীতিতে নারীর ক্ষমতায়নে কৃষির পরই সবচেয়ে বড় অবদান রাখছে বাংলাদেশের পোল্ট্রি শিল্প। এখানে যেসব মানুষের জীবন জীবিকা জড়িত, তার প্রায় ৪০ শতাংশই নারী।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বৃহত্তর যশোরাঞ্চলে পাঁচটি হ্যাচারিতে প্রতিদিন চার লাখ মুরগির বাচ্চা উৎপাদিত হয়। প্রতিটি বাচ্চা উৎপাদনে খরচ হয় ৩২-৩৫ টাকা। করোনার প্রভাবে পোল্ট্রি মুরগির বেচাকেনায় ধস নেমেছিলো। এখন বাচ্চা ও ফিডের দাম বৃদ্ধিতে নাজেহাল খামারিরা। এতে বিপাকে পড়েছে উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। এ প্রসঙ্গে হ্যাচারি মালিকগণ জানান, ডিম পাড়ানোর চার মাস পূর্বে একটি মুরগি প্রস্তুত করা হয়। এ মুরগি টানা দেড় বছর ডিম দেয়। প্রতিদিন বাচ্চা উৎপাদনের জন্য ২১ দিনের ডিম ইনকিউবেটর মেশিনে চাপাতে হয়। একদিন বয়সী বাচ্চা বিক্রি করা হয়। বাচ্চা উৎপাদন বন্ধ করতে হলে কমপক্ষে ২১ দিন অপেক্ষা করতে হয়। আবার উৎপাদন প্রক্রিয়া একবার বন্ধ করলে পুনরায় চালু করা অনেক ব্যয় সাপেক্ষ। সে ক্ষেত্রে হ্যাচারি একেবারেই বন্ধ হয়ে যাবে। এতে প্রতিষ্ঠানটি শত শত কোটি টাকার লোকসানের মুখে পড়বে।
বর্তমানে অন্তত ৬ মিলিয়ন (৬০ লাখ) মানুষ পোল্ট্রি শিল্পে কর্মরত আছেন, ফলশ্রুতিতে এ শিল্পের উপর নির্ভর করে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জীবিকানির্বাহ করছে ১ কোটিরও বেশি মানুষ। তাই পোল্ট্রি শিল্প বাংলাদেশে আমিষের চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে একটি উল্লেখযোগ্য স্থান দখল করে আছে। গবেষণায় দেখা গেছে পোল্ট্রি উৎপাদনে মোট খরচের শতকরা ৬৫ থেকে ৭৫ ভাগ খরচ হয় শুধুমাত্র খাবারের পেছনে। সুতরাং খাবারের মূল্য কমানো বা নিয়ন্ত্রণে রাখা এবং এর সঙ্গে সম্পর্কিত বিষয়গুলোকে সহজতর করা একান্ত প্রয়োজন। পত্রপত্রিকা ও ডিজিটাল মিডিয়ার বদৌলতে জানা গেছে, গত ছয় মাসে পোল্ট্রি খাবারের দাম শতকরা ৩০ ভাগ বাড়ায় প্রতিটি ডিমে ১ দশমিক ৫০ টাকা ও প্রতিকেজি ব্রয়লারে ২৫-৩০ টাকা লোকসান গুনতে হয়েছে খামারিদের। অবশ্য পোল্ট্রি খাবারে কত ভাগ দাম বাড়লো আর কত টাকা লোকসান হলো সেটা সাধারণ ভোক্তাদের জানার বা বিবেচনারও বিষয় নয়। তাদের কাছে কম মূল্যে মুরগি ও ডিম খেতে পারাই বড় কথা।
একদিকে হ্যাচারি মালিকেরা লোকসান গুনছে কেননা তাদের বাচ্চা বিক্রি হচ্ছে না, অন্যদিকে খামারিরা বাচ্চা কিনে তা পালন করার সাহস পাচ্ছে না। পরিনামে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে একের পর এক মুরগি খামার। গত এক বছরে বাংলাদেশে পোল্ট্রি উৎপাদন গড়ে ১৮% কমেছে যা রীতিমত উদ্বেগের বিষয়। পোল্ট্রি উৎপাদনে মোট খরচের শতকরা ৬৫ থেকে ৭৫ ভাগ খরচ হয় শুধুমাত্র খাবারের পেছনে। সুতরাং খাবারের মূল্য কমানো বা নিয়ন্ত্রণে রাখা এবং এর সঙ্গে সম্পর্কিত বিষয়গুলোকে সহজতর করা প্রয়োজন।

পোল্ট্রি শিল্পের উন্নয়ন ও স্থিতিশীলতার জন্য দরকার-

মুরগি ও ডিমের দাম নির্ধারণ : সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার অভাবে বাংলাদেশের মানুষকে আজ অনেক দাম দিয়ে ডিম ও মুরগি কিনতে হচ্ছে। মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে ব্রয়লারের দাম ৩ থেকে ৪ গুন বেড়েছে। ক্রমেই মুরগি সাধারণ ক্রেতার ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে যাচ্ছে। তাই পোল্ট্রি মুরগির বাচ্চা, ফিড এবং উৎপাদিত মুরগির দাম নির্ধারণে সরকারি নিয়ন্ত্রন জরুরি। ট্যাক্স এবং ব্যাংক ঋণ: পোল্ট্রি খাবারে ট্যাক্স বসালে এমনিতেই ডিম ও মুরগির দাম বেড়ে যায়। পোল্ট্রি খাবার বিশেষ করে ভুট্টা আমদানির উপর ট্যাক্স না থাকা বাঞ্চনীয়। সাথে সাথে দেশে ভুট্টা চাষে চাষীদেরকে আরো বেশি উৎসাহিত করতে হবে।  ঝুঁকি বীমা ও সংকটকালীন ভর্তুকি প্রদান: বাংলাদেশের বীমা কোম্পানিগুলো পোল্ট্রি শিল্প উপযোগী বীমা পলিসি নিয়ে এগিয়ে আসতে পারে। দেশে বিদ্যমান পোল্ট্রি বিষয়ক সমিতিগুলো এ বিষয়ে বীমা কোম্পানিগুলোর সাথে প্রয়োজনীয় যোগাযোগ ও লবিং করতে পারলে পোল্ট্রি শিল্প চাঙ্গা হবে।
টিকা ও এন্টিবায়োটিক: মানসম্পন্ন টিকা উৎপাদনের জন্য দেশের সংশ্লিষ্ট অনুজীব বিজ্ঞানীদেরকে নিয়ে টিকা উদ্ভাবন ও উৎপাদিত টিকার প্রোটেকটিভ লেভেল নিয়মিতভাবে পরীক্ষা করে টিকার মান নিশ্চিত করতে হবে। বিদ্যুৎ ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন: প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করতে দেশের পোল্ট্রি বেল্ট এরিয়াতে বেশি বিদ্যুৎ সরবরাহের ব্যবস্থা করতে হবে। পাশাপাশি মুরগির বিষ্ঠা ও বর্জ্র ব্যবাহার করে বায়ো-বিদ্যুৎ (ইরড়-বষবপঃৎরপরঃু) তৈরি হতে পারে একটি নতুন বিকল্প উপায়। যার মাধ্যমে অতিরিক্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব। ডিম ও ব্রয়লার রপ্তানি:  দেশের চাহিদা মিটিয়ে বাড়তি ডিম, ব্রয়লার ও এক-দিনের বাচ্চা বিদেশে রপ্তানি করা যেতে পারে।
Please follow and like us:

Check Also

রাজাপুর আল- হেরা জামে মসজিদের কমিটি গঠন

সাদী হাসান, চাম্পাফুল প্রতিনিধিঃ কালীগঞ্জ উপজেলা রাজাপুর আল- হেরা জামে মসজিদে নতুন কমিটি গঠন করা …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।