ইসরাইল-ফিলিস্তিন যুদ্ধবিরতিতে বিশ্বনেতাদের প্রতিক্রিয়া গাজায় যুদ্ধবিরতি কার্যকর

ইসরাইলী আগ্রাসনে গাজায় বাস্তুচ্যুত কয়েক লাখ ফিলিস্তিনী
মুহাম্মদ নূরে আলম : ১১ দিনধরে চলমান ভয়াবহ যুদ্ধের পর অবশেষে ইসরাইল ও ফিলিস্তিন দুই পক্ষই যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছে। আর এ ক্ষেত্রে মধ্যস্থতা করেছে মিসর। যুদ্ধবিরতির খবরে ফিলিস্তিনে চলছে উৎসবের আমেজ। যুদ্ধবিরতি কার্যকরের পর গাজায় উল্লাস করেন হাজার হাজার মানুষ। যুদ্ধের কারণে ফিলিস্তিনের মুসলমানরা ঈদ উদযাপন করতে পারেনি তবে গতকাল শুক্রবার তারা ঈদ উৎসব উদযাপন করে। আর ফিলিস্তিনী গ্রুপ হামাস ও ইসলামিক জিহাদ এক বিবৃতিতে যুদ্ধবিরতি নিশ্চিত করেছে। এটি কার্যকর হয় গতকাল শুক্রবার ভোররাত ২টা থেকে (বৃহস্পতিবার ২৩.০০ জিএমটি)। খবর বিবিসির। বিবিসি জানিয়েছে, যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব নিয়ে ইসরাইলের জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ক মন্ত্রিসভা কমিটি বৈঠকে বসে। ইসরাইলী মন্ত্রিসভা মিশরের প্রস্তাবিত চুক্তিতে রাজি হয়ে যুদ্ধবিরতিতে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। এদিকে যুদ্ধবিরতির খবর প্রকাশ হওয়ার পরপরই গাজায় নতুন করে ইসরালি বিমান হামলা হয়, ইসরাইলে রকেট নিক্ষিপ্ত হয়। এদিকে ইসরাইলের প্রধান বিমানবন্দর বেন গুরিয়ানে সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য সকল ফ্লাইট বন্ধ করে দেয়া হয়। এতেই পরিস্থিতির নাজুকতা ফুটে ওঠে। এমনকি যুদ্ধবিরতির মধ্যেও কোনো কিছু নির্ধারিত হয়নি। এদিকে ইসরাইল-ফিলিস্তিন যুদ্ধবিরতিতে বিশ্বনেতারা শান্তির পক্ষে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন, জাতিসংঘের মহাসচিব, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট, মিসরীয় প্রেসিডেন্ট, মধ্যপ্রাচ্যে জাতিসংঘের দূত, জাতিসংঘে মার্কিন দূত, ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী, মালয়শিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী।
এদিকে যুদ্ধবিরতির কয়েক ঘন্টার পর ইসরাইল ফের পূর্ব জেরুসালেমে হামলা চালায়। পবিত্র শবে কদরের রাত থেকেই ফিলিস্তিনীদের উপর হামলা শুরু করেছিল দখলদার সন্ত্রাসী ইসরাইল। তাই রমজান শেষ করে ঈদ উদযাপন করতে পারেননি গাজাবাসী। গতকাল শুক্রবার সকাল থেকে ইসরাইল ও ফিলিস্তিনীদের মধ্যে যখন যুদ্ধ বিরতি কার্যকর হয় তখনই সেখানকার মুসলিমরা ঈদের খুশিতে মেতে উঠে। আন্তর্জাতিক সংগঠন সেভ দ্য চিলড্রেনের মতে, গাজার ৫০টি স্কুল ধ্বংস করেছে ইসরাইলী বাহিনী। এতে প্রায় ৪২ হাজার শিক্ষার্থীর স্কুলজীবন হুমকির মুখে পড়েছে। এদিকে ২০১৪ সালের পর এটাই ছিল দুই দেশের মধ্যে সবচেয়ে বড় যুদ্ধ। হামাস বলেছে, আল-আকসা ও জেরুজালেমের শেখ জারায় ইসরাইলী আগ্রাসন বন্ধের প্রতিশ্রুতি পেয়ে তারা যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছেন। অন্যদিকে, ফিলিস্তিনের ভূখণ্ড থেকে হামাসের ব্যাপক হামলার মুখে যুদ্ধবিরতিতে সম্মতি দিয়েছেন ইসরাইলী প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। গত বৃহস্পতিবার মন্ত্রিসভার জরুরি বৈঠকের পর ইসরাইলী সরকার এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যুদ্ধবিরতি নিয়ে নিজেদের অবস্থান মিসরকে জানিয়েছে ইসরাইল। এই যুদ্ধবিরতি নিয়ে আলোচনায় সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে মিসর। এর আগে ইসরাইলী প্রধানমন্ত্রীর সিনিয়র উপদেষ্টা মার্ক রিগেভ জানিয়েছেন, নির্দিষ্ট শর্তেই যুদ্ধবিরতি চুক্তি হতে পারে। সে শর্তে তেলআবিব ও জেরুজালেমে হামলা বন্ধ করতে হবে হামাসকে। গাজা থেকে রকেট হামলার কারণে সেখানকার বেসামরিক নাগরিকরা আতঙ্কের মধ্যে রয়েছেন। উল্লেখ্য যে, বিগত রমজান মাসের শেষদিকে জর্দান নদীর পশ্চিম তীরের বায়তুল মুকাদ্দাস শহর ও আল-আকসা মসজিদের মুসল্লিদের বিরুদ্ধে ইহুদিবাদী সেনারা ভয়াবহ দমন অভিযান শুরু করলে গাজা থেকে প্রতিরোধ যোদ্ধার রকেট বর্ষণ শুরু করেছিলেন। তাদের দাবি ছিল, ইসরাইল যেন আল-আকসা মসজিদ এবং এর নিকটবর্তী শেখ জাররাহ এলাকায় দমন অভিযান বন্ধ রাখে।
বিভিন্ন গণমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে দেখা যায়, হামাসের নেতারা বিজয় ভাষণ শুরু করেন ঈদের খুতবা দিয়ে। মঞ্চের সামনের দাড়িয়ে থাকা জনতা ঈদের তাকবীর দিতে শোনা যায়। গাজা উপত্যকা হামাসের রাজনৈতিক ব্যুরোর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ নেতা খলিল আল-হাইয়া তার ভাষণের শুরুতেই তাকবির দেন। আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু আল্লাহু আকবার ওয়ালিল্লাহিল হামদ। এরপর সমাবেত লোকদের উদ্দেশে তিনি বলেন, আজ আমাদের বিজয়ের ঈদ। হে রব, আপনার বহুত শুকরিয়া, আপনি আমাদের শত্রুদের ঠেকিয়ে দিয়েছেন, আমাদের জনগণকে বিজয় দিয়েছেন। জেরুসালেমকে বিজয়ী করেছেন, শেখ জাররাহকে বিজয়ী করেছেন, সকল স্থানের জনগণকে বিজয় দান করেছেন। তিনি বলেন, হে রব, আপনার বহুত শুকরিয়া, আজকের দুই উপলক্ষের ঈদ আমাদের নসিব করানোর জন্য, রমজানের শেষ হওয়ার এবং জেরুসালেম ও ফিলিস্তিনের সম্মান ও মর্যাদাকর বিজয়ের উপলক্ষ। ভাষণের এক পর্যায়ে সমাবেত হওয়া জনতা স্লোগান দিতে থাকে তেল আবিব আমাদের থেকে দূরে থাকো। ১১ দিন যুদ্ধের পর গত বৃহস্পতিবার রাতে ইসরাইল ও হামাস যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হওয়ার কথা ঘোষণা করে।
ইসরাইলী প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর অফিস জানায়, সিকিউরিটি ক্যাবিনেট সর্বসম্মতভাবে শর্তহীন একটি যুদ্ধবিরতির ব্যাপারে মিসরীয় উদ্যোগ গ্রহণ করার সুপারিশ করেছে। গতকাল শুক্রবার ভোর থেকে এই যুদ্ধ বিরতি কার্যকর হয়। এই কয়দিনে ইসরাইলী হামলায় গাজায় অন্তত ২৩২ জন নিহত হয়েছে। এদের মধ্যে শিশু ৬৫ জন। আর ইসরাইলে ২ শিশুসহ নিহত হয়েছে ১২ জন। গাজায় যুদ্ধবিরতি কার্যকরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও সংস্থার কূটনৈতিক প্রচেষ্টা জোরদার হয়েছে গত বৃহস্পতিবার। ফিলিস্তিনী এই ভূখণ্ডে মানবিক সঙ্কট চরম আকার ধারণ করায় বিশ্বের পরাশক্তিগুলো উভয়পক্ষকে যুদ্ধে বিরতি দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে। এদিকে ফিলিস্তিনীদের জন্য মানবিক সহায়তার আহ্বান জানিয়েছেন জাতিসংঘের প্রধান অ্যান্তনিও গুতেরেস।
অসম্ভবকে সম্ভব করেছে হামাস: দম্ভ গুঁড়িয়ে দিয়েছে ইহুদীদের : ফিলিস্তিনের প্রতিরোধ আন্দোলন হামাস যোদ্ধারা যে এবারের যুদ্ধে এতটা প্রতিরোধ গড়ে তুলবে এবং পাল্টা জবাবে কয়েক হাজার রকেট নিক্ষেপ করবে তা ঘুণাক্ষরেও কল্পনা করেনি ইসরাইলী বাহিনী। ফলে যে অহংকার ও মাত্রাতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস নিয়ে তারা হামলা শুরু করেছিল, তা কয়েকদিনের মধ্যেই পাল্টা তীর হয়ে বিঁধতে শুরু করে। বাস্তবে ধ্বংসযজ্ঞ ও প্রাণহানি হিসাব করলে ফিলিস্তিনীদের ক্ষয়ক্ষতি কয়েকগুণ বেশি হলেও পশ্চিমা মদদপুষ্ট পরাক্রমশালী ইসরাইলী বাহিনীকে যুদ্ধবিরতিতে বাধ্য করা হামাসের জন্য বিজয়ের সামিল বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন দীর্ঘ মেয়াদী যুদ্ধে হামাস জয় লাভ করবে।
এ বিষয়ে হামাসের বৈদেশিক রাজনীতি বিষয়ক প্রধান খালেদ মিশ’আল বলেন, অবরুদ্ধ গাজাভিত্তিক ফিলিস্তিনের প্রতিরোধ আন্দোলনগুলো ইসরাইলী সামরিক বাহিনীর দম্ভ এবং মর্যাদা চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিয়েছে। ফিলিস্তিনের আল-আকসা টেলিভিশন চ্যানেলকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে হামাসের শীর্ষ পর্যায়ের এ নেতা বলেন, ফিলিস্তিনীদের নতুন ইন্তিফাদার (পুনর্জাগরণ) কারণে আল-কুদসের জনগণ বুক ভরে নিঃশ্বাস নিতে পারছে। গাজা উপত্যকা আজ অসম্ভবকে সম্ভব করেছে। তিনি আরও বলেন, অধিকৃত পশ্চিম তীর এবং আল-কুদস শহরের জনগণকেও ঘুরে দাঁড়ানো প্রয়োজন এবং ইহুদিবাদী ইসরাইলের বিরুদ্ধে এই গণজাগরণ অব্যাহত রাখতে হবে।
এদিকে ইসরাইলের রাজনৈতিক বিশ্লেষক আকিভা এলদার বলেছেন, ফিলিস্তিনীদের বিভক্ত করার জন্য বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু সরকারের কৌশল ব্যর্থ হয়েছে। কাতারভিত্তিক গণমাধ্যম আল জাজিরাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি এ কথা বলেন। আকিভা বলান, আমি মনে করি গাজায় ফিলিস্তিনী সম্প্রদায়কে বিভক্ত করতে যে কৌশল ইসরাইল নিয়েছিল তা বহু বছর পর প্রথমবারের মতো ব্যর্থ হয়েছে। এই যুদ্ধবিরতির কারণে ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু তার পার্টনারদের কাছ থেকে সমর্থন হারাতে পারেন। কেননা তারা এই যুদ্ধবিরতিতে খুবই অসন্তুষ্ট। যুদ্ধবিরতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানিয়েছে, ইসরাইল সামরিক অভিযান বন্ধ করে যুদ্ধবিরতিতে রাজি বলে মিসরকে জানায়। রাতে প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু তার জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ক মন্ত্রিসভা কমিটির সঙ্গে বৈঠক করেন। বৈঠকে তারা যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়।
গাজায় বিজয়ের উল্লাস : যুদ্ধবিরতি ঘোষণার পর গাজা ও ফিলিস্তিনী এলাকাগুলোতে হাজার হাজার লোক রাস্তায় নেমে আসে, তারা বিজয়সূচক ‘ভি,’ সংকেত প্রদর্শন করে, পতাকা দোলায়। ধ্বংসস্তূপের মধ্যেই তারা বিজয়ের গান গাইতে থাকে। আল জাজিরার সংবাদদাতা সাফওয়াত আল-কালুত শুক্রবার সকালে বলেন, ফিলিস্তিনীরা আতশবাজি পুড়িয়ে, ফাঁকা গুলী ছুঁড়ে উল্লাস করছে। তিনি বলেন, হাজার হাজার লোক বিজয় উদযাপনের জন্য রাস্তায় নেমে এসেছে। হামাসের এক সিনিয়র কর্মকর্তা গাজার একটি পরিবারের সাথে সাক্ষাত করার পরিকল্পনা করছেন। ইসরইলি হামলায় তিনটি ভবনে বসবাসরত ওই পরিবারের ৪৫ জন নিহত হয়।
গাজা উপত্যকায় যুদ্ধবিরতিতে রাজি হয়েছে ইসরাইল ও গাজা নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিরোধ আন্দোলন হামাস। উভয় পক্ষই বিবৃতিতে যুদ্ধবিরতির কথা ঘোষণা করা হয়েছে। ১১ দিন যুদ্ধের পর দু’পক্ষ বৃহস্পতিবার রাতে যুদ্ধবিরতিতে একমত হয়। স্থানীয় সময় রাত দুটায় (২৩.০০ জিএমটি, বৃহস্পতিবার) যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়। মিসরের উদ্যেগে এই যুদ্ধবিরতি হয়েছে। অবশ্য এতে কোনো পূর্বশর্ত নেই। মিসর এখন আশা করছে, ইসরাইল ও গাজায় প্রতিনিধি পাঠিয়ে বিষয়টি চূড়ান্ত করার। হামাস কর্মকর্তারা বলছেন, তারা তাদের দুই শর্তের ব্যাপারে অনির্দিষ্ট ছাড় পেয়েছেন। যুদ্ধবিরতির ব্যাপারে তাদের দুই শর্ত ছিল শেখ জাররাহ এলাকা থেকে ফিলিস্তিনীদের বাস্তুচ্যুত করা যাবে না এবং আল-আকসা মসজিদ কমপ্লেক্সে ইসরাইলী পুলিশের উপস্থিতি থাকতে পারবে না।
ফিলিস্তিনে আজ ঈদ: দখলদার ইসরাইলী বাহিনীর সঙ্গে ফিলিস্তিনী প্রতিরোধ গোষ্ঠী হামাসের যুদ্ধবিরতি সমঝোতার পর আপাতত বন্ধ হয়েছে হামলা-সহিংসতা। ফলে প্রায় দু’সপ্তাহ পরে বুকভরে শ্বাস নিতে পারছে গাজাবাসী। দখলদারদের হামলার কারণে এবারের ঈদুল ফিতর ঠিকভাবে উদযাপন করতে পারেনি ফিলিস্তিনী মুসলিমরা। তারপরও প্রাণপণ লড়াই চালিয়ে গেছে তারা। তাই বিজয়ের সমান এই যুদ্ধবিরতি কার্যকরের পর স্বাভাবিকভাবেই উচ্ছ্বসিত ফিলিস্তিনের জনগণ। বৃহস্পতিবার রাত থেকেই সেখানে চলছে বিজয়োল্লাস। আজকের দিনটি হয়ে উঠেছে তাদের ঈদের দিন। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের খবর থেকে জানা যায়, যুদ্ধবিরতি কার্যকরের পরপরই গাজা, পূর্ব জেরুজালেমসহ ফিলিস্তিনের বিভিন্ন শহরের মানুষ রাস্তায় নেমে আসেন। এসময় মহান আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে নানা স্লোগান দেন তারা। খুশির আতশবাজিতে আলোকিত হয়ে ওঠে ফিলিস্তিনের আকাশ।
ব্যাপক হামলার মুখে যুদ্ধবিরতিতে সম্মতি নেতানিয়াহুর : ফিলিস্তিনের ভূখণ্ড থেকে হামাসের ব্যাপক হামলার মুখে যুদ্ধবিরতিতে সম্মতি দিয়েছেন ইসরাইলী প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। বৃহস্পতিবার মন্ত্রিসভার জরুরি বৈঠকের পর ইসরাইলী সরকার এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে। গাজায় বিবিসির প্রতিনিধি রুশদি আবুয়ালউফ এক টুইট বার্তায় লিখেছেন, যুদ্ধবিরতি আলোচনার সঙ্গে জড়িত সূত্র বিবিসিকে বলেছেন, যুদ্ধবিরতি নিয়ে নিজেদের অবস্থান মিসরকে জানিয়েছে ইসরাইল। এই যুদ্ধবিরতি নিয়ে আলোচনায় সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে মিসর।
এর আগে ইসরাইলী প্রধানমন্ত্রীর সিনিয়র উপদেষ্টা মার্ক রিগেভ জানিয়েছেন, নির্দিষ্ট শর্তেই যুদ্ধবিরতি চুক্তি হতে পারে। সে শর্তে তেল আবিব ও জেরুজালেমে হামলা বন্ধ করতে হবে হামাসের। গাজা থেকে রকেট হামলার কারণে সেখানকার বেসামরিক নাগরিকরা আতঙ্কের মধ্যে রয়েছেন।
গাজায় যুদ্ধবিরতি কার্যকরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও সংস্থার কূটনৈতিক প্রচেষ্টা জোরদার হয়েছে বৃহস্পতিবার। ফিলিস্তিনী এই ভূখণ্ডে মানবিক সঙ্কট চরম আকার ধারণ করায় বিশ্বের পরাশক্তিগুলো উভয়পক্ষকে যুদ্ধে বিরতি দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে। তবে গাজার ক্ষমতাসীন শাসকগোষ্ঠী হামাসের সঙ্গে ইসরাইলের লড়াই এখনও অব্যাহত আছে। আল-মায়াদিন টেলিভিশনকে ওসামা হামদান গতরাতে আরো বলেছেন, বায়তুল মুকাদ্দাস (জেরুজালেম) শহরের শেখ জাররাহ এলাকা এবং আল-আকসা মসজিদ থেকে ইসরাইলী সেনা প্রত্যাহারের ব্যাপারও আমরা (মধ্যস্থতাকারীদের মাধ্যমে) নিশ্চয়তা পেয়েছি। ইসরাইলের পক্ষ থেকে যুদ্ধবিরতি মেনে নেয়ার ঘোষণাকে ফিলিস্তিনীদের বিজয় বলেও জানিয়েছেন ওসামা হামদান। তিনি বলেন, ইহুদিবাদী ইসরাইলের এই সিদ্ধান্তের মাধ্যমে ফিলিস্তিনীদের বিজয় হয়েছে।
যুদ্ধবিরতি হলেও সতর্ক হামাস, চায় ইসরাইলী ধ্বংসযজ্ঞের ক্ষতিপূরণ: ফিলিস্তিনে ইসরাইলী আগ্রাসন চিরকালের মতো বন্ধ করতে হবে এবং গত ১১ দিনে গাজা উপত্যকায় দখলদার বাহিনী যে সহিংসতা চালিয়েছে তার ক্ষতিপূরণ দিতে হবে বলে দাবি জানিয়েছেন হামাসের রাজনৈতিক ব্যুরোর সদস্য এজাত আল-রশিক। ফিলিস্তিনী প্রতিরোধ গোষ্ঠীর এই নেতা ইসরাইলকে সতর্ক করে আরও বলেছেন, যুদ্ধবিরতি শুরু হলেও তারা এখনো ট্রিগারে হাত রেখেছেন। অর্থাৎ ইসরাইল চুক্তি লঙ্ঘন করলেই তার যোগ্য জবাব দেবে ফিলিস্তিনী যোদ্ধারা। রশিক বলেন, এটি সত্য যে, যুদ্ধ আজ শেষ হয়েছে। তবে ইসরাইলী প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুসহ গোটা বিশ্বের জানা উচিত, আমাদের হাত এখনো ট্রিগারে রয়েছে। আত্মরক্ষায় আমরা এই অঞ্চলে প্রতিরোধ সক্ষমতা বৃদ্ধি অব্যাহত রাখব।
কাতারের দোহায় রয়টার্সকে দেয়া সাক্ষাৎকারে এজাত আল-রশিক বলেন, জেরুজালেমের আল-আকসা মসজিদ রক্ষা এবং পূর্ব জেরুজালেম থেকে ফিলিস্তিনীদের উচ্ছেদ রোধ করা হামাসের অন্যতম লক্ষ্য। ফিলিস্তিনের জনগণ আমাদের সঙ্গে রয়েছে। এ প্রতিরোধই আমাদের দেশ ও পবিত্র স্থানগুলোকে রক্ষা করবে। ১৯৮৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়া হামাস ২০০৬ সালের নির্বাচনে অধিকাংশ আসনে জয় লাভ করে গাজার নিয়ন্ত্রণ নেয়। ফলে গাজা উপত্যকায় ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের নিয়ন্ত্রণ খুবই কম। আব্বাস ও তার দল ফাতাহর নিয়ন্ত্রণে রয়েছে ইসরাইল অধিকৃত পশ্চিম তীর। আর গাজার নিয়ন্ত্রণ তার প্রতিদ্বন্দ্বী হামাসের হাতে। হামাসকে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইল সন্ত্রাসী সংগঠন বললেও এ গোষ্ঠীর মতে, তারা ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার জন্য লড়ছে।
ইসরাইলী আগ্রাসনে গাজায় বাস্তুচ্যুত কয়েক লাখ ফিলিস্তিনী: ইসরাইলী বোমা হামলা গত ১১ দিনে অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় ৯০ হাজারেরও বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। ফিলিস্তিনে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক সমন্বয় কার্যালয়ের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এই তথ্য। বাস্তুচ্যুতদের বেশিরভাগই আশ্রয় নিয়েছেন জাতিসংঘের রিলিফ অ্যান্ড ওয়ার্কস এজেন্সির আওতাভুক্ত আশপাশের ৫৮টি স্কুলে। অনেকে আশ্রয় নিয়েছেন আগে থেকেই বাস্তুচ্যুত হওয়া পরিবারগুলোর সঙ্গে। বাস্তুচ্যুতদের সাহায্য ও গাজার ভেঙে পড়া স্বাস্থ্য ব্যবস্থা পুনর্গঠনে অবিলম্বে ৭০ লাখ ডলারের আর্থিক সাহায্যের আবেদন জানিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। গত ১০ মে শুরু হওয়া এ সংঘাতে নিহত হয়েছেন মোট ২৩২ জন ফিলিস্তিনী। নিহতের তালিকায় রয়েছে ৬৫ শিশুও।
ইসরাইল-ফিলিস্তিন যুদ্ধবিরতিতে বিশ্বনেতাদের প্রতিক্রিয়া: টানা ১১ দিন রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ের পর অবশেষে যুদ্ধবিরতিতে রাজি হয়ছে দখলদার ইসরাইলী বাহিনী ও ফিলিস্তিনের ইসলামী প্রতিরোধ আন্দোলন হামাস। আক্ষরিকভাবে এটি যুদ্ধের বিরতি হলেও এই ঘটনা ফিলিস্তিনী যোদ্ধাদের কাছে বিজয়ের সমতুল্য। ফলে স্বাভাবিকভাবেই যুদ্ধবিরতি কার্যকরের পর রাস্তায় নেমে বিজয়োল্লাস শুরু করেছে তারা। ইসরাইল-ফিলিস্তিনের এই যুদ্ধবিরতি নিয়ে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন বিভিন্ন দেশ ও সংস্থার প্রধানরা। এক নজরে দেখে নেয়া যাক কে কী বলেছেন-
জাতিসংঘের মহাসচিব: জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেছেন, শান্তি পুনরুদ্ধার ছাড়াও ‘দ্বন্দ্বের’ মূল কারণ সমাধানে একটি গুরুত্বপূর্ণ সংলাপ শুরু করায় ইসরাইলী ও ফিলিস্তিনী নেতাদের বাড়তি দায়িত্ব রয়েছে বলে মনে করি। মঅবরুদ্ধ গাজা উপত্যকার বিষয়ে তিনি বলেন, এটি ভবিষ্যৎ ফিলিস্তিনী রাষ্ট্রের অবিচ্ছেদ্য অংশ এবং এই বিভাজনের অবসান ঘটিয়ে সত্যিকারের জাতীয় পুনর্মিলনের জন্য কোনো প্রচেষ্টা বাকি রাখা উচিত নয়।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট: মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেছেন, আমরা জাতিসংঘসহ অন্য আন্তর্জাতিক অংশীদারদের সঙ্গে গাজার জনগণের জন্য দ্রুত মানবিক সহায়তা প্রদান এবং গাজা পুনর্র্নিমাণ চেষ্টায় আন্তর্জাতিক সহায়তা জোরদারে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আমি বিশ্বাস করি, ইসরাইলী ও ফিলিস্তিনীদের সুরক্ষা ও নিরাপত্তার সঙ্গে বেঁচে থাকা এবং স্বাধীনতা, উন্নয়ন ও গণতন্ত্র উপভোগের সমান অধিকার রয়েছে। আমার প্রশাসন এ বিষয়ে নিরলস কাজ করে যাবে।
মিসরীয় প্রেসিডেন্ট: মিসরের প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ এল-সিসি বলেছেন, আনন্দের সঙ্গে জানাচ্ছি যে, আমি প্রেসিডেন্ট বাইডেনের কাছ থেকে একটি ফোনকল পেয়েছি। আমরা ইসরাইল ও গাজার মধ্যকার বর্তমান বিরোধকে শান্ত করতে পারে এমন একটি সূত্রে পৌঁছানোর বিষয়ে দৃষ্টিভঙ্গি বিনিময় করেছি। কূটনীতির মাধ্যমে সব পক্ষের দ্বন্দ্ব নিরসনই আমাদের লক্ষ্য।
মধ্যপ্রাচ্যে জাতিসংঘের দূত: মধ্যপ্রাচ্যে নিযুক্ত জাতিসংঘের শান্তিদূত টর ওয়েনেসল্যান্ড বলেছেন, গাজা ও ইসরাইলের মধ্যে যুদ্ধবিরতিকে আমি স্বাগত জানাই। সহিংসতায় ভুক্তভোগী ও তাদের প্রিয়জনদের প্রতি আমার গভীর সমবেদনা রইল। জাতিসংঘের ঘনিষ্ঠ সহযোগিতায় শান্তি পুনরুদ্ধারে সহায়তার জন্য আমি মিসর ও কাতারের প্রশংসা করি। এবার ফিলিস্তিন গড়ার কাজ শুরু হতে পারে।
জাতিসংঘে মার্কিন দূত: জাতিসংঘে মার্কিন দূত লিন্ডা থমাস-গ্রিনফিল্ড বলেছেন, এখন আমাদের অবশ্যই স্থায়ী শান্তিপ্রতিষ্ঠার দিকে আরও এগিয়ে যেতে মনোনিবেশ করতে হবে। আর গাজায় প্রচুর পরিমাণে জরুরি মানবিক সহায়তার জন্য সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।
ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী: ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডমিনিক রাব বলেছেন, ইসরাইল ও গাজার যুদ্ধবিরতির খবরকে স্বাগত। এটি স্থায়ী করতে এবং বেসামরিক প্রাণহানির অগ্রহণযোগ্য চক্র ভাঙতে সব পক্ষকে অবশ্যই কাজ করতে হবে।
মালয়েশীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী: মালয়েশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিশামউদ্দিন হুসেইন বলেছেন, ইসরাইলী হামলা শত শত লাশ ফেলে গেছে, কয়েক হাজারকে আহত করেছে। সহিংসতায় ভুক্তভোগী সবার জন্য গভীর সমবেদনা জানাচ্ছে মালয়েশিয়া। এবার ফিলিস্তিনী জনগণের জন্য মানবিক ও পুনর্র্নিমাণ সহায়তায় নজর দেয়ার পালা।

Check Also

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গাড়িবহরে হামলা মামলার সাজাপ্রাপ্ত পলাতক আসামি গ্রেফতার

প্রাণনাশের উদ্দেশ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গাড়িবহরে হামলা মামলার সাজাপ্রাপ্ত পলাতক আসামি ইয়াছিন আলীকে গ্রেফতার করা …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।