ঘূর্ণিঝড় ইয়াস এর প্রভাবে উপকূলীয় বেড়ি বাঁধ ভেঙ্গে শতশত গ্রাম প্লাবিত: মৃত্যু ২: ৫০ বছরে প্রাণহানি ৪ লাখ( ভিডিও)

আবু সাইদ বিশ্বাস: সাতক্ষীরা: ঘূর্ণিঝড় ইয়াস এর প্রভাবে সাতক্ষীরায় হাদিউজ্জামান নামে এক জেলের মৃত্যু হয়েছে। মৃত ওই জেলের বাড়ি শ্যামনগর উপজেলার শেখপাড়া গ্রামের বাসিন্দা। এদিকে ঘূর্ণিঝড় ইয়াস এর তান্ডবে সুন্দরবন সংলগ্ন নদীতে ৬/৭ ফুট জোয়ারের পানি বৃদ্ধি পেয়ে পাউবো বাঁধ ছাপিয়ে শতাধীক গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। উপকূল রক্ষিত পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) বেড়ী বাঁধ ভেঙ্গে শ্যামনগর ও আশাশুনির ১০ ইউনিয়ন প্লাবিত হয়েছে। পুরো এলাকায় মৎস্য ঘের পানিতে তলিয়ে একাকার হয়ে গেছে। লাখ লাখ মানুষ পানি বন্দি হয়ে পড়েছে। স্কুল,কলেজ,মাদ্রাসা,মসজিদ,মন্দিরসবই এখন পানির তলে। কালিগঞ্জের বাণিজ্যিক এলাকা নাজিম গঞ্জবাজার পানিতে তলিয়ে গেছে। আশাশুনির প্রতাপনগর, আনুলিয়া ও শ্রিউলা ইউনিয়নের অর্ধশত গ্রাম তলিয়ে গেছে। ঘুণিঝড় আম্পানে মেরামতকৃত বেড়িবাঁধ আবারও ভাঙ্গনের কবলে পড়েছে।

কৈখালী ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান শেখ আব্দুর রহিম বলেন, সীমান্ত কালিন্দি নদীতে ৬/৭ ফুট জোয়ারের পানি বৃদ্ধি পেয়ে পাউবো বাঁধ ছাপিয়ে তার ইউনিয়নের ২২ গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। শ্যামনগর উপজেলার দ্বীপ ইউনিয়ন গাবুরা, পদ্মপুকুর, বুড়িগোয়ালিনী, মুন্সিগঞ্জ ও কৈখালী ইউনিয়নের অধিকাংশ পাউবো বাঁধ ছাপিয়ে জোয়ারের পানি লোকালয়ে প্রবেশ করেছে। মানুষের মনে চরম আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। গাবুরা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান জি.এম মাছুদুল আলম জানান, কপোতক্ষ নদে হঠাৎ জোয়ার বৃদ্ধি পাওয়ায় ইউনিয়নের লেবুবুনিয়া, গাঁগড়ামারি ৩নং এলাকায় পাউবো বাঁধ ভেঙ্গে পানি ভিতরে প্রবেশ করে ১৫টি গ্রাম তলিয়ে গেছে। পদ্মপুকুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান এড. আতাউর রহমান জানান, খোলপেটুয়া নদীতে পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় ইউনিয়নের অধিকাংশ পাউবো বাঁধ ছাপিয়ে পানি লোকালয়ে প্রবেশ করেছে। এসময় ঝাঁপা, সোনাখালী, পূর্ব ও পশ্চিম পাতাখালী সহ কামালকাটি এলাকা তলিয়ে যাবতীয় মৎস্য ঘের তলিয়ে গেছে। বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান ভবতোষ মন্ডল বলেন, খোলপেটুয়া নদীতে অস্বাভাবিক জোয়ারে অধিকাংশ পাউবো বাঁধ তলিয়ে জোয়ারের পানি ভিতরে প্রবেশ করেছে।মুন্সিগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আবুল কামেশ মোড়ল বলেন, চুনা নদীতে জোয়ারের পানি বৃদ্ধি পেয়ে বাউবো বাঁধ ভেসে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করে ১০ গ্রাম আংশিক প্লাবিত হয়েছে। মানুষ পানি বন্দি হয়ে পড়েছে। তাছাড়া ইউনিয়নের দক্ষিণ কদমতলা গ্রামের প্রায় দুই হাজার মানুষ সাইক্লোন শেল্টারে আশ্রয় নিয়েছে।
শ্যামনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আ.ন.ম. আবুজর গিফারী বলেন, তাৎক্ষণিকভাবে সরকারী সাহায্য হিসাবে প্রতিটি ইউনিয়নে নগত ২৫ হাজার টাকা ও ২টন করে চাউল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। তাছাড়া শুকনা খাবার সরবরাহ করা হচ্ছে।
এদিকে মঙ্গলবার (২৫ মে) দুপুরে পোনা মাছ ধরতে গিয়ে ফেনীর সোনাগাজীতে ছোট ফেনী নদীর চর চান্দিয়ার বাইরে চর এলাকায় জোয়ারের পানিতে ডুবে হাদিউজ্জামান নামে এক জেলের মৃত্যু হয়েছে। উপকূলীয় সোনাগাজী উপজেলার চরচান্দিয়ায় বাহিরের চরের ছোট ফেনী নদীতে থেকে রাত সাড়ে ১০টার দিকে ওই জেলের মরদেহ উদ্ধার করে ফায়ার সার্ভিস ও পুলিশ।সোনাগাজী মডেল থানার পরিদর্শক (ওসি) সাজেদুল ইসলাম পলাশ বিষয়টি নিশ্চিত করেন।ওসি জানান, মঙ্গলবার সন্ধ্যায় ছোট ফেনী নদীর বাইরের চরে ১০ থেকে ১২ জন জেলে মাছের পোনা ধরতে যায়। অন্যদিনের থেকে ৪-৫ ফুট বেশি উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসে অন্যরা বাঁচতে পারলেও হাদিউজ্জামান নদীর পানিতে তলিয়ে যায়। পরে পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিস তার মরদেহ উদ্ধার করে।
এদিকে ভোলার লালমোহনে ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের তান্ডবে গাছের ডাল ভেঙে মো: আবু তাহের (৪৯) নামের এক রিকশাচালকের মৃত্যু হয়েছে। মঙ্গলবার রাতে উপজেলার কালামা ইউনিয়নে এ ঘটনা ঘটে। নিহত মো: আবু তাহের একই এলাকার বাসিন্দা। তিনি পেশায় রিকশাচালক। এ ঘট্নার সত্যতা নিশ্চিত করে উপজেলা নির্বাহী অফিসার আল নোমান জানান, নিহত রিকশাচালকের পরিবারকে জেলা প্রশাসকের পক্ষ থেকে নগদ ২০ হাজার টাকা অর্থ সহায়তা দেয়া হয়েছে।
ঘূর্ণিঝড় ‘ইয়াস’ থেকে বাংলাদেশ ঝুঁকিমুক্ত বলে জানিয়েছেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমান। বাংলাদেশের উপকূলে ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের আঘাত হানার আর কোনো সম্ভাবনা নেই বলে জানিয়েছেন তিনি। বুধবার দুপুরে সচিবালয়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি বিষয়ক জরুরি সভায় প্রতিমন্ত্রী এ তথ্য জানান। ডা. এনামুর রহমান বলেন, আল্লাহতায়ালার কাছে কৃতজ্ঞতা জানাই, তিনি বাংলাদেশকে একটি প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় থেকে রক্ষা করেছেন। রক্ষা করেছেন এ দেশের উপকূলীয় অঞ্চলের জানমাল এবং ফসল ও মাছের ঘেরকে
এদিকে বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে মঙ্গলবার থেকেই বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের উপকূলীয় অঞ্চলগুলোতে ঝড়-বৃষ্টি অব্যাহত রয়েছে। আবহাওয়াার পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, গতকাল দুপুরে ঘূর্ণিঝড় অতিক্রমের সময় খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, বরগুনা, পটুয়াখালী, বরিশাল, ভোলা, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, ফেলী, চাঁদপুর ও চট্টগ্রম জেলায় ও এর অদূরবর্তী দ্বীপ ও চরগুলোতে ভারী ও অতি ভারী বর্ষণ হয়েছে।
গতকাল সকালে পশ্চিমবঙ্গের উপকূলবর্তী এলাকায় হানা দেয় ঘূর্ণিঝড় ইয়াস। তার দাপটে দক্ষিণ ২৪ পরগনার সুন্দরবন এলাকার নদী বাঁধ-সহ পূর্ব মেদিনীপুর জেলার বাঁধগুলি বিস্তৃর ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। ঘুর্ণিঝড়ের কারণে সেখানে মোট ১৩৪টি বাঁধ ভেঙে গিয়েছে। ফলে ১ কোটি মানুষ ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে।
সূত্র জানায় ষাটের দশকে নির্মিত উপকূলীয় বেড়িবাঁধ যথাযথ সংস্কার ও সংরক্ষণের নামে লুটপাটের ফলে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উপকূলীয় মানুষের জীবন যাত্রা। সর্বশেষ সুপার সাইক্লোন আম্ফানের তান্ডবে প্রায় এক-তৃতীয়াংশ বেড়িবাঁধ ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে অরক্ষিত হয়ে আছে। সাগরের জোয়ার-ভাটায় ডুবছে-ভাসছে প্রতিনিয়ত উপকূলীয় জনপদ। এরই মাঝে ঘূণিঝড় ইয়াস এর প্রভা্ে চরম ঝুঁকিতে আছে উপকূলীয় ২৫ জেলার প্রায় দশ কোটি মানুষ।

গবেষণা সূত্র জানায়, গত ৫০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ প্রাণহানি ঘটেছে ১৯৭০ সালের প্রাকৃৃতিক দুর্যোগে ৩ লাখ। এর আগে ১৯৬৫ সালে ঘণ্টায় ১৬১ কিলোমিটার গতি আসা ঘূর্ণিঝড়ে ১৯ হাজার ২৭৯ প্রাণহানি হয়। একই বছর ডিসেম্বরে ২১৭ কিলোমিটার গতিতে ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতে ৮৭৩ প্রাণহানি হয়। ১৯৬৬ সালের অক্টোবরের প্রাকৃৃতিক দুর্যোগে ৮৫০ জনের প্রাণহানি হয়। ১৯৮৫ সালের মে মাসের ঘূর্ণিঝড়ের গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ১৫৪ কিলোমিটার। এর আঘাতে ১১ হাজার ৬৯ প্রাণহানি হয়। ১৯৯১ সালের এপ্রিলে ২২৫ কিলোমিটার গতিতে আসা ঘূর্ণিঝড়ের জলোচ্ছ্বাসের উচ্চতা ছিল ৬ থেকে ৭.৬ মিটার। এই দুর্যোগে ১ লাখ ৩৮ হাজার ৮৮২ প্রাণহানি হয়। ১৯৯৭ সালের মে মাসে ২৩২ কিলোমিটার বেগে আসা প্রাকৃতিক দুর্যোগে ১৫৫ জনের প্রাণহানি ঘটে। ২০০৭ সালের নভেম্বরের সিডরে ২ হাজার ৩৬৩ জনের প্রাণহানি হয়। এই ঝড়ের গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ২২৩ কিলোমিটার। ২০০৯ সালের মে মাসের আইলায় ১৯০ প্রাণহানি হয়। সর্বশেষ ২০২০ সালের ২০ মে ঘুর্ণিঝড় আম্পানে ২০ জনের প্রাণ হাণি হলেও ও বেড়িবাঁধসহ ফসলাদিও ব্যাপক ক্ষতি হয়।
সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক সূত্র জানান, টেকসই বাঁধ নির্মানে নতুন মেগাপ্রকল্প গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এর মধ্যে খুলনার ১৪নং পোল্ডারে ৯৫৭ কোটি ৩৮ লাখ টাকা ও ৩১নং পোল্ডারে এক হাজার ২০১ কোটি ১২ লাখ টাকা এবং সাতক্ষীরার ৫নং পোল্ডারে তিন হাজার ৬৭৪ কোটি তিন লাখ ও ১৫নং পোল্ডারে ৯৯৭ কোটি ৭৮ কোটি টাকার প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। চলতি অর্থবছরে এসব প্রকল্পের কাজ শুরু হবে। তা শেষ হবে তিন বছরের মধ্যে।
১৯৬০ সালে পাকিস্থান আমলে নির্মিত উপকূল রক্ষার বাঁধগুলো শতভাগ নিরাপত্তা দিতে না পারায় উপকূলীয় জেলা সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, বরগুনা, পটুয়াখালী, ভোলা, বরিশাল, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর, নোয়াখালী, ফেনী, ও চট্টগ্রাম এলাকায় ৮ হাজার কিলোমিটার বেড়িবাঁধ চরম ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে।

 

Please follow and like us:

Check Also

নতুন যোগ হচ্ছে ২০ লাখ দরিদ্র

মূল্যস্ফীতির কশাঘাত মোকাবিলায় ২০ লাখ ২৬ হাজার দরিদ্র মানুষকে নতুন করে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।