সাতক্ষীরায় সমন্বিত পদ্ধতিতে বাণিজ্যিকভাবে হলুদ চাষে আগ্রহ বাড়ছে চাষিদের

আবু সাইদ বিশ্বাস:সাতক্ষীরা: হারানেরা গৌরাব ফিরিয়ে আনতে সাতক্ষীরা জেলায় বাণিজ্যিকভাবে হলুদ চাষ হচ্ছে। পলি দোঁয়াশ ও বেলে দোঁয়াশ প্রকৃতির উর্বর মাটি হওয়ায় গ্রামের সমতল উচুঁ জমিতে মসলা জাতীয় ফসল হলুদের আবাদ বাড়ছে। অন্য ফসলের পাশাপাশি সমন্বিত পদ্ধতিতে হলুদ চাছ করছে এখানকার কৃষকরা। চাহিদার তুলনায় এখানে উৎপাদন কয়েকগুণ বেশি। বিগত ১০ বছরের মধ্যে এবার সবচেয়ে বেশি জমিতে হলুদের চাষ হয়েছে। উৎপাদন থেকে শুরু করে হলুদের গুড়া উৎপাদন পর্যন্ত শত শত শ্রমিক এ পেশায় আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। ১০ কাঠা থেকে ৩/৪ বিঘা জমি পর্যন্ত হলুদের আবাদ করা হয়েছে। স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত এখনকার চাষীরা অন্যান্য ফসলের পাশাপাশি হলুদ চাষ করে আসছেন। কয়েক যুগের মন্দা কাটিয়ে জেলায় সমন্বিত পদ্ধতিতে হলুদ চাষে সাফল্যের মুখ দেখতে শুরু করেছেন হলুদ চাষিরা। হলুদের ক্ষেতে, কচু, ওল, কাকরোল, ঝাল, কচুরমুখি, পুঁইশাকসহ ক্ষেতের বেড়ায় বিভিন্ন সবজি চাষ করে লাভবান হচ্ছেন তারা। বর্তমানে হলুদের ক্ষেত পরিচর্যায় ব্যস্ত সময় পার করছে চাষিরা।
বহু প্রাচীন কাল থেকেই হলুদ নামক মসলাটি দক্ষিণ এশিয়া ও মধ্য পূর্বের দেশ গুলিতে ব্যাপক ব্যবহার পরিলক্ষিত হয়। তবে এটি কেবল মাত্র মসলা হিসেবে নয় মানুষে বিভিন্ন দৈনন্দিন অসুখ থেকে শুরু করে রূপচর্চা রক্ষার কাজেও হলুদের ব্যবহার সবার আগে। কৃষিগবেষকেরা বলছেন হলুদের মধ্যে একটি আশ্চর্য সমাধান লুকিয়ে আছে । আসলে হলুদের মধ্যে রয়েছে প্রচুর পরিমান ফাইবার, পটাশিয়াম,ভিটামিন বি-৬,কারকিউমিন,ম্যাগনেশিয়াম ও ভিটামিন-সি এছাড়া এন্টি ব্যাকটেরিয়াল,এন্টি অক্সিডেন্ট, এন্টি ভাইরাল ও এন্টি ইনফ্লেমেটোরি গুন যা “অলৌকিক ভেজষ” হিসেবে খ্যাতি এনে দিয়েছে।
বিশ্বজুড়ে বাংলাদেশি মসলার ভালো চাহিদার কারণে সাতক্ষীরায়সহ দেশে হলুদের গুরুত্ব বাড়ছে। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশে উৎপাদিত হলুদ ও মরিচের গুঁড়া রপ্তানি হয়ে আসছে। এমনকি কাঁচা হলুদ, শুকনা মরিচ, আদাসহ বেশ কয়েক ধরনের মসলা রপ্তানি হয়।
প্রযুক্তির উন্নয়ন ও হলুদের দাম বৃদ্ধি পাওয়াতে এ বছর জেলায় হলুদের আবাদ বেড়েছে। জেলা কৃষি স¤প্রসারণ অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১-২২ মৌসুমে জেলার সাতটি উপজেলায় মোট ৬৬৫ হেক্টর জমিতে হলুদ আবাদের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হলেও আবাদ হয়েছে ৭০৫ হেক্টর জমিতে। এর মধ্যে তালা উপজেলায় সবচেয়ে বেশি ৪১০ হেক্টর জমিতে হলুদ আবাদ হয়েছে। কালিগঞ্জে ১১০ হেক্টর জমিতে হলুদ আবাদের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। অন্যান্য উপজেলার মধ্যে সদরে ৭০ হেক্টর, কলারোয়ায় ৬০ হেক্টর, দেবহাটায় ০৫ হেক্টর, আশাশুনিতে ১৫ হেক্টর ও শ্যামনগরে ৩৫ হেক্টর জমিতে হলুদ আবাদ হয়েছে। ২০১৮-১৯ মৌসুমে জেলার সাতটি উপজেলায় মোট ৬৪৫ হেক্টর জমিতে হলুদ আবাদ হয়। চলতি মৌসুমে জেলায় ২ হাজার ৯৩৩ মে: টন হলুদ উৎপাদনের লক্ষ্য মাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এর মধ্যে সদর উপজেলায় ৩৬০ মে: টন, কলারোয়া উপজেলায় ৩১৫ মে: টন, তালয় ১৫৩০ মে: টন, দেবহাটায় ৪৫ মে: টন, কালীগঞ্জ উপজেলায় ৪৭৩ মে: টন, আশাশুনিতে ৬৭ মে: টন ও শ্যামনগরে ২০৩ মে: টন।
সরেজমিন দেখা যায়, চাষিরা হলুদের সাথে একই জমিতে ঝাল গাছ, বেগুন চাষ, মেটে আলু, ওলের চাকি চাষ করছেন। দেখা যায়, হলুদের সাথে সাথে একই সাথে এ সকল ফসল অতিদ্রুত ফলানো যায়। এতে ঐ কৃষকের নিজের পরিবারের চাহিদা পূরণ করে বাজারে বিক্রি করে অধিক লাভবান হওয়া সম্ভব।
চাষীরা জানায়, বিঘাপ্রতি ৫ থেকে সাড়ে ৫ মণ বীজ রোপণ করলে বছর শেষে ফলন ভাল হলে বিঘাপ্রতি গড়ে ৭০/৮০ মণ কাঁচা হলুদ উত্তোলন করা হয়। কাঁচা অবস্থায় ৭শ’ থেকে এক হাজার টাকা মণ বিক্রি করা হয়ে থাকে। শুকনা হলুদ কোন বছর ৫/৬ হাজার টাকা পর্যন্ত প্রতিমণ বিক্রি হয়ে থাকে।
কেউ কেউ অভিযোগ করে বলেন, কৃষি অফিসের কোন পরামর্শ এই এলাকার হলুদ চাষীরা পায়না। তারা জানায়, জমি থেকে হলুদ তোলা শেষ হলে এলাকার ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, ফড়িয়া, খুলনা, ঢাকা, কুমিল্লা ও চট্টগ্রাম থেকে আগত হলুদ ব্যবসায়ীরা চাষীদের নিকট থেকে হলুদ ক্রয় করে থাকে। হলুদ চাষে সহজ শর্তে ঋণ প্রদান বা সরকারীভাবে সহযোগিতা করা হলে হলুদ চাষ আরও বৃদ্ধি পাবে বলে জানান চাষিরা।
সাতক্ষীরা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক নুরুল ইসলাম বলেন, হলুদ বেশ লাভজনক ফসল হলেও উপকূলীয় জেলা হওয়ার কিছু আবাদি জমিতে লবণাক্ততার পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় ও জলাবদ্ধতার কারণে হলুদের আবাদ কমে গিয়েছিল। সেই সাথে দেখা দিচ্ছে পানিবদ্ধতা। এ দুই কারণে জেলার কৃষকরা হলুদ আবাদে আগ্রহ কমতে থাকে চাষিদের মাঝে। তবে আমরা অধিদফতরের পক্ষ থেকে কৃষকদের হলুদ আবাদের ক্ষেত্রে সবসময় প্রয়াজনীয় সহযোগিতা ও পরামর্শ দিয়ে থাকি। যার ফলে এ বছর আবাদ বাড়ছে।
আবু সাইদ বিশ্বাস:সাতক্ষীরা: ২৫/০৬/২০২১

Please follow and like us:

Check Also

নতুন যোগ হচ্ছে ২০ লাখ দরিদ্র

মূল্যস্ফীতির কশাঘাত মোকাবিলায় ২০ লাখ ২৬ হাজার দরিদ্র মানুষকে নতুন করে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।