সাতক্ষীরায় অক্সিজেন সংকটে ১০ জনসহ অসংখ্য মানুষের মৃত্যু: তদন্ত টীম গঠন: অক্সিজেন পাচারের অভিযোগ

আবু সাইদ বিশ্বাস:সাতক্ষীরা : অক্সিজেন সংকটের কারণে সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ ডেডিকেটেড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৮ জনসহ ১৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। তাদের মধ্যে আটজনের মৃত্যু হয়েছে অক্সিজেন সংকটে। এদের চারজন ছিলেন করোনা পজিটিভ। অন্যরা মারা গেছেন উপসর্গ নিয়ে। বুধবার বিকালে সাতক্ষীরা মেডিকেলে সেন্ট্রাল অক্সিজেনের প্রেসার কমে আসতে থাকে। সেই সংকট মুহূর্তে পর পরই আইসিইউতে দুজন, সিসিইউতে দুজন এবং সাধারণ ওয়ার্ডে আরও চারজনসহ আটজনের মৃত্যু হয়। রোগীদের স্বজনদের অভিযোগ— অক্সিজেন সংকট দেখা দিলেও তা পূরণ করতে কর্তৃপক্ষের গাফিলতিতে এসব রোগী মারা গেছেন। রাত ৮টার দিকে সেন্ট্রাল অক্সিজেন সরবরাহ স্বাভাবিক হয়। এদিকে এর আগে বুধবার সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত আরও সাতজনের মৃত্যু হয়। তাদের মধ্যে দুজন ছিল করোনা পজিটিভ। অন্যরা উপসর্গে মারা গেছেন।
বুধবার সন্ধ্যার পর থেকে মৃত্যুবরণকারীরা হলেন-আইসিইউ ইউনিটের করোনা পজেটিভ রোগী কালিগঞ্জের ভাড়াশিমলা এলাকার মৃত আব্দুল হামিদের ছেলে আকরাম হোসেন খান (৬৩), সিসিইউ ইউনিটের মারা যায় শহরের ইটাগাছা এলাকার মফিজুল ইসলামের স্ত্রী খাইরুন্নেছা (৪০), শহরের কুকরালী আমতলা এলাকার মনিরুজ্জামানের স্ত্রী করোনা আক্রান্ত নাজমা খাতুন, শ্যামনগরের সোনাখালি এলাকার কাশেম গাজীর ছেলে আশরাফ হোসেন, সাধারণ ওয়ার্ডের সন্ধ্যা ৭টার পর মারা যায় শ্রীউলা ইউনিয়নের বক্সার গ্রামের মৃত সিরাজুল ইসলামের ছেলে রবিউল ইসলাম পারভেজ (৫৪), কালিগঞ্জের জগন্নাথপুর এলাকার সৈয়দ আলি পাড়ের ছেলে আবু জাফর মো: শফিউল আলম তুহিন, আশাশুনির নৈকাটি এলাকর বেনু গাজির ছেলে আব্দুল হামিদ (৭৫)।
বুধবার রাত ৮টায় সরেজমিনে সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজে হাসপাতালের ৪র্থ তলায় আইসিইউ ইউনিট ও সিসিইউনিটের সামনে দেখা যায়, স্বজনদের আহাজারিতে ভারি হয়ে উঠেছে সেখানকার বাতাস। আইসিইউ ওয়ার্ডের সামনে রোগীর স্বজনদের হুড়োহুড়ি এবং কান্নার রোল পড়তে দেখা যায়।
সূত্রবলছে সাতক্ষীরা মেডিকেলে ৭৬টি বড় আকারের অক্সিজেন সিলিন্ডার রয়েছে। সংকট দেখা দিলেই তা স্বয়ংক্রিয়ভাবে অক্সিজেন সরবরাহ করে থাকে।এদিকে এখন পর্যন্ত ২৭৫ জন রোগী মেডিকেলে চিকিৎসাধীন। তাদের মধ্যে করোনা পজিটিভ ২৬ জন। অন্যরা করোনা উপসর্গ নিয়ে চিকিৎসাধীন। এদিকে গত ২৪ ঘণ্টায় ৯৫ জনের নমুনা পরীক্ষা করে ৫২ জনের করোনা পজিটিভ পাওয়া গেছে; যা হিসেবে ৫৫ শতাংশ।
আইসিইউ ইউনিটের আকরাম হোসেন খানের পুত্র তাজ মুহাম্মদ খান কান্না জড়িত কণ্ঠে বলেন, আমার বাবা করোনা পজেটিভ ছিলেন। গত ৪৫ দিন ধরে ভর্তি ছিলেন। কয়েকদিন ধরে শ্বাস কষ্ট দেখা দিচ্ছিল। গত কয়েকদিন ধরে এই হাসপাতালের সেন্ট্রাল অক্সিজিনের সমস্যা দেখা দিচ্ছিল। কিন্তু কর্তৃপক্ষ সেদিকে নজর দেয়নি। সে কারণে আজ কতগুলো রোগী মারা গেল। কর্তৃপক্ষের অবহেলার কারণে আমার বাবাকে হারালাম। তিনি আরও বলেন, সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা থেকে অক্সিজেন নেই। রাত ৮টা অক্সিজেন আসছে। এই সময়ে এই রোগীগুলো কিভাবে বাঁচবে।
তিনি আরও বলেন, বাবা যখন মারা গেছে। তখন ফোন দিয়ে আমাদের ডাকছে। আগে থেকে আমাদের জানানো হলে বাবার সাথে শেষ দেখা করতে পারতাম। এখানকার চিকিৎসার সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করছেন না বলেও অভিযোগ করেন। আমার বাবাকে হারিয়েছি। ভবিষ্যতে এভাবে যেন আর কেউ তার বাবাকে না হারায় সেজন্য তিনি কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। এব্যাপারে বিভাগীয় তদন্তের দাবীও জানান তিনি।
কলারোয়া উপজেলার বীরমুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার ও রোগীর স্বজন গোলাম মোস্তাফা বলেন, আমার স্ত্রী সিসিইউ ওয়ার্ডে ভর্তি। সিসিইউ ওয়ার্ডে অক্সিজেন বিপর্যয়ের কারণে ২জন মারা গেছে। আমার স্ত্রীকে আল্লাহ বাঁচিয়েছে বলে বেঁচে আছে। কেন এই বিপর্যয়। আমরা দেশ স্বাধীন করেছিলাম কী এ জন্য? বঙ্গবন্ধু কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আশু হস্তক্ষেপ কামনা করেন তিনি।
সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের করোনা ইউনিটের ফোকাল পার্সন ডা. মানস কুমার মন্ডল বলেন, বিকেল থেকে হাসপাতালের সেন্টার অক্সিজেন সিস্টেমের প্রেসার কমে যায়। সকালে এই বিষয়ে যথাযথ কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছিল। যশোর থেকে অক্সিজেন নিয়ে আসা হয়েছে। সন্ধ্যার কিছুক্ষণ পরপরই হাসপাতালেন সেন্ট্রাল অক্সিজেন সিস্টেম স্বাভাবিক হয়েছে।
সাতক্ষীরা সিভিল সার্জন হুসাইন ডা: শাফায়ত বলেন, মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সেন্ট্রাল অক্সিজেনের সংকট দেখা দেওয়ার কথা ছিলনা। সেন্ট্রাল অক্সিজেন ছাড়াও ৭০টির অধিক সিলিন্ডার আছে। তবে করোনায় ৪জন মারা গেছে। এখানে কর্তৃপক্ষের কোন গাফিলতি ছিলো কিনা বিষয়টি খতিয়ে দেখবে প্রশাসন।
এদিকে সাতক্ষীরা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে অক্সিজেন বিপর্যয়ে মারা যাওয়ার ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠন করেছে কর্তৃপক্ষ। তিন দিনের মধ্যে তদন্ত রিপোর্ট জমা দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
এ ঘটনা তদন্তে মেডিসিন বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ডা. কাজী আরিফ আহমেদকে প্রধান করে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন,সদর হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা ডা. মারুফ আহমেদ ও সামেক হাসপাতালের ডা. সাইফুল্লাহ। তাদেরকে তিন দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য বলা হয়েছে।
স্বজনদের অভিযোগ,অক্সিজেনের অভাবে মারা গেছেন কমপক্ষে ১০ জন রোগী। রাত আটটার দিকে যশোর থেকে অক্সিজেন সিলিন্ডারসহ কারিগরি বিশেষজ্ঞরা ঘটনাস্থলে পৌছে সমস্যার সমাধান করেন।
জেলা প্রশাসক হুমায়ুন কবির জানান, তত্বাধয়াককে আজকের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। প্রতিবেদন দেখে প্রয়াজন পড়লে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তদন্ত কমিটি গঠন করা হবে।
বিশেজ্ঞরা বলছে, গত এক মাসের মধ্যে ৩/৪ জন চিকিৎসক ছাড়া আর কোন চিকিৎসককে মেডিকেল কলেজের কোন ওয়ার্ডে যেতে দেখেননি কোন রোগী বা তাদের স্বজনরা। হাতে গোনা ৩/৪ জন চিকিৎসক ও ইন্টানি চিকিৎসকরা ২৪ ঘন্টা পরিশ্রম করে মেডিকেল কলেজের চিকিৎসা ব্যবস্থা বাঁচিয়ে রাখলেও অন্যারা বেসরকারী ক্লিনিক হাসপাতাল নিয়ে ব্যস্ত। ট্রাকে অক্সিজেন এনে অর্ধেক প্লান্টে দিয়ে বাকি অর্ধেক ঐ ট্রাকেই ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়। সিলিন্ডারেও অর্ধৈক অক্সিজেন ভরা হয়। এসব অভিযোগ এখন ভিতরের লোকজনই বলাবলি করছে। একটি চক্র এভাবে সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালকে হরিলুটের আখড়ায় পরিণত করে প্রকারন্তে রোগীদেরকে বেসরকারী হাসপাতাল ক্লিনিকে যেতে উৎসাহিত করছে। এমনকি টাকা নিয়ে রোগী ভর্তির মত অভিযোগও আমরা শুনতে পাচ্চি।

Check Also

মালয়েশিয়ার পাম তেলে ইইউ’র নিষেধাজ্ঞা বাংলাদেশের শ্রমবাজারে অশনি সংকেত

বন উজাড়, কার্বন নির্গমনের ঝুঁকি এবং পরিবেশের ভারসাম্য নষ্টগত কারণ দেখিয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ মালয়েশিয়ার …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।